নাফ নদ ভাঙনে নিঃস্বদের ঠাঁইয়ের আকুতি

মো: ফারক আলম, টেকনাফ:

নাফ নদে বিলীন হয়ে গেছে টিনের ঘর, গাছপালা, চাষের জমিসহ সবকিছু। তাও একবার নয়, চার চারবার। নদের তাড়া খেয়ে আবুল কালাম (৬০) এখন আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়ায়। নাফ নদের তীরে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে পুরোনো সেই ঘরের সীমারেখা দেখানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। বলছিলেন, প্রতিনিয়ত পানির সঙ্গে যুদ্ধ করেই জীবন চলে তাদের। লবণ চাষ আর মাছ ধরাই এ দ্বীপের বাসিন্দাদের মূল পেশা। তবে বছর পাঁচেক হলো নদে মাছ শিকারও বন্ধ। আর ঘর নামের যে আশ্রয়, সেটিও একেবারেই ক্ষণস্থায়ী।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় আবুল কালাম বলেন, ‘নাফ নদে পানি বাড়লে ঘরত থাহিত ন পারি (ঘরে থাকতে পারি না)। জোয়ার আইলে অন্য ঘরত যাইগই (অন্যে ঘরে যাই)। বাডা (ভাটা) অইলে ঘরত আই-ই (ঘরে আসি)। আরা হডে যাইউম (আমরা কোথায় যাব)? আরার যাইবার জাহা নাই (আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই)। আরারে এককান থাহিবার জাহা দন (আমাদের থাকার একটি জায়গা দিন)।’
টেকনাফ থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে সীমান্ত সড়কের পূর্বে নাফ নদের পাড়ে জালিয়াপাড়ার অবস্থান। বর্তমানে সেখানে ১০০ পরিবারের প্রায় পাঁচশ মানুষের বসতি। প্রতিনিয়ত তারা পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবনযাপন করছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙনকবলিত জালিয়াপাড়ার বিভিন্ন স্থানে এখনো ধ্বংসলীলার চিত্র স্পষ্ট। বেশকিছু জায়গায় উপড়ে যাওয়া গাছের মূল পড়ে রয়েছে। ভাঙনের মুখে পড়ে বিলীন হওয়ার পথে রয়েছে দুটি বিদ্যালয়ের ভবন। অনেকের ঘরের পাশের মাটি ভেঙে পড়েছে। কেউ কেউ ঘর সরিয়ে নিচ্ছেন অন্য কোথাও। কেউ কেউ নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় জিও বাঁধের পাশেই তুলেছেন ঘর।

দ্বীপের বাসিন্দারা জানান, টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত শাহপরীর দ্বীপ। এখানে ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১৩টি গ্রামে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসতি ছিল। তবে সাগর ও নাফ নদ ভাঙনের ফলে গত ১০ বছরে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছেন। এখনো ভাঙন থামেনি দ্বীপটিতে। বিশেষ করে দ্বীপের পশ্চিম-পূর্বদিকে প্রতি বর্ষা মৌসুমে ভাঙন শুরু হয়। এর বাইরেও এখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত নতুন সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। জীবিকার সন্ধানে তাই অনেকেই বাধ্য হয়েছেন দ্বীপ ছাড়তে।

ভুক্তভোগীরা জানান, বছরে একাধিকবার তাদের বাড়ি নদে বিলীন হয়ে যায়। বারবার বাড়ি ভাঙা-গড়ার ফলে তাদের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় কষ্ট। নদের ভাঙনে মাথা গোঁজার এক টুকরো ঠাঁইও থাকে না। এর পরও নদের ধারেই আশ্রয় নিয়ে কোনো মতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। অথচ তাদের দুর্দশার সেই খবর নেয় না কেউ।
ইউনিয়ন পরিষদের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দ্বীপটির ৫৫ শতাংশ মানুষ (৩৫-৭০ বছর বয়সী) এরই মধ্যে চার থেকে ছয় বার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। অর্ধেক মানুষের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। কৃষিজমি বিলীন হওয়ার পর অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন এবং এ সংখ্যা বাড়ছেই।

আবুল কালাম জানান, যেভাবে নাফ নদের জোয়ারে ভাঙন ধরেছে, এখানেও বেশি দিন আর থাকা যাবে না। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর থেকেই আর ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না। এখন নাফ নদের তীরে যেখানে নৌকা ভাসছে, সেখানে একসময় প্রায় ৩০০ পরিবারের একটি পাড়া ও রাস্তাঘাট ছিল। সবই নদের বুকে হারিয়ে গেছে।

দ্বীপের বাসিন্দা মো. হানিফ জানান, নাফ নদ ভাঙার আগ্রাসনে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। অভাবের কারণে ঘরের কাছে ভাঙন চলে এলেও তা সরানোর সুযোগ নেই। সম্পদশালীরা এলাকা ছেড়ে চলে গেলেও তাদের মতো নিঃস্বরা কোথাও যাওয়ার সুযোগ পান না। তাই এ নদের পাড়ে পরিবার নিয়ে টিকে থাকতে হেলে পড়া ঘরের চারদিকে রশি টানা দিয়েছেন।

হানিফ বলেন, আগামী দু’তিন বছরের মধ্যে বাকি জায়গাটুকুও নাফ নদের বুকে হারিয়ে যাবে। তাই এখানেও বেশি দিন থাকা সম্ভব হবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া উপহারের আশ্রয়কেন্দ্রের ঘরে ঠাঁই দিলে হয়তো সুদিন ফিরত।

আরেক বাসিন্দা ফাতেমা বেগম জানান, দ্বীপের চারদিকে পানি থাকলেও সুপেয় পানির তীব্র কষ্টে ভুগতে হয় তাদের। একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে সমুদ্রের লোনাপানি ধীরে ধীরে এই এলাকাকে মরুভূমি বানিয়ে দিচ্ছে।

এ সময় নুর জাহান ও মনজুর আলমসহ অনেকেই ভিড় করে তাদের করুণ গল্প শোনান। এদের সবাই বাপ-দাদার জমিজমা হারিয়ে এখন নিঃস্ব। তাই প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়কেন্দ্রে ঘর পাওয়ার আশায় দিন গুনছেন তারা।

স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুস সালাম বলেন, তার এলাকার প্রায় পাঁচ শ মানুষ নাফ নদের পাড়ে জীবনযাপন করছেন। ১২ বছর আগে শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমে বাঁধ ভাঙায় প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের ঘরবাড়ি সাগরে তলিয়ে যায়। সেই বাঁধটি পুনর্নিমাণ হলেও নতুন করে নাফ নদে ভাঙন ধরেছে। এর ফলে ভাঙা-গড়ার এই দ্বীপে মানুষগুলো বেঁচে থাকতে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই আমার অনুরোধ, এসব অসহায় মানুষকে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়কেন্দ্রে হস্তান্তর করা হোক।

সাবরাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নাফ নদের পাড়ে বসবাসকারী মানুষগুলো পর্যায়ক্রমে আশ্রয়স্থল হারাচ্ছেন। তাদের অন্যত্র সরানো যায় কি না সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।’

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুজামান বলেন, নাফ নদের তীরে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিতে থাকা গৃহহীনরা যেন প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পায়, সে ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি সেখানে ভাঙনরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কক্সবাজারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপসহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, নাফ নদের পাড়ে দুটি বিদ্যালয়সহ যেসব বসতি রয়েছে সেগুলো রক্ষায় গত বছর ৪০ লাখ টাকায় বেড়িবাঁধ দেয়া হয়েছিল। তবুও ভাঙন রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ বছরও কয়েক দিনের মধ্যেই ভাঙন রোধে সেখানে কাজ শুরু হবে।