গণকবর : আযাহা সুলতান

এখানে আমার বাবার কবর
এখানে পাশের ঘরের চাচা মাহির হোচেন
এখানে বাবার বন্ধু কাকা নন্দলাল
এখানে আমাদের পূর্ববাড়ির ভোলামিয়ে—কালাচান
এখানে পাশের গ্রাম ভবেশ্বরের জগৎপাল ও চন্দ্রমোহন—

এটা বাংলার গণকবর

এখানে দাঁড়ালে রাখতে পারে কে চোখের জল
এখানে তাকালে ফেলতে পারে কে পলক চোখের
এখানে এলে আবেগাপ্লুত হৃদয় ফিরতে পারে কার বাড়ি
বিষাদের সাগর থেকে ভেসে ওঠে না কার—বারবার
ভেসে ওঠে না চোখের সামনে সেই বর্বরতার চিত্র—বীভৎস দৃশ্যাবলি
ভেসে ওঠে না মানসনেত্রে মনস্তাপের ঘৃণ্য দৃশ্যপট

বন্ধু শোন!

এই তবে শোনাচ্ছি সেই শিহরিত গল্প—করুণকাহিনি—
কোলাহল নগর—নিঝুম-নিস্তব্ধ অন্ধকার শহর
এখানে শিয়াল-কুকুরেরা করছে টানাটানি লাশ
ওখানে দাউদাউ জ্বলছে বাড়িঘর
নদীতে ভেসে যাচ্ছে লাশের সারি
কতক গলিত মুণ্ডু ছাড়া কোনেক অঙ্গহীন রক্তমাখা
শকুনে খেয়েছে কতক
হয়তো সদানন্দ ভাই কারও
কারও শান্ত স্নেহের ধন
হয়তো ভেসে যাচ্ছে মা কার কিবা ধর্ষিতা বোনটি

কূলে বসে কাঁদছে ন-বোধ নয় বছরের শিশুটি

ভুলা যায় কি কখনো কারবালার মতো শোকের মাতম?
বাংলা ও বাঙালির রক্তদানের ইতিহাস?
ভুলা যায় কি কখন?
ভুলা যায় না—ভুলা যায় না—
ভয়ার্ত মন
তরতর কাঁপন
ছলছল চোখে জল
চাপা ক্রন্দন
মৃত্যুকূপের জীবন—

এসব দৃশ্য দেখার শক্তি কার?

পাশের বাড়িতে মাতমের চিৎকার
আকাশের বুকে শোকের তুফান
বাতাসের গায়ে বারুদের গন্ধ
গুলির শব্দে আতঙ্কিত বাংলা—বাংলার প্রাণিকুল

পাখির মতো মরছে মানুষ—মরে আছে—

পড়ে আছে লাশ খালেবিলে—হাটেবাজারে—পথেঘাটে রাস্তায়
পড়েছি ইতিহাস—জেনেছি শোকার্ত ও মর্মাহত কথা
শুনেছি দুঃখের শোকগাথা কাহিনি—
এদেশ ভুলে গেছে আজ অতীতের সব যন্ত্রণা
ভুলতে পারিনি—পারি না আমি—পারে না অনেকে
গভীর ঘুমে এখনো শুনি—
সে ধর্ষিতা মা-বোনের অনুনয়বিনয়—কাতরোক্তি—করুণমিনতি
হায়েনার কবল থেকে রেহায় পায়নি—পাননি—
শুনি—সেই বাঁধভাঙা কান্নার দমফাটা চিৎকারের আহাজারি
দেখি—নিদারুণ চোখের করুণচাহনি
কারে বাঁচাতে পারছি নে আমি
স্বপ্নে হাউমাউ করে চিৎকারিয়ে কাঁদছি
আমার কান্নার চিৎকার কেউ শুনতে পাচ্ছে না—পায়নি
চোখের সামনে বাবার লোহুলোহান নিথর দেহ পড়ে আছে
পড়ে আছে আরও লাশের পাশে লাশ—গণলাশ—
লাশের যেন সওদাগরি—কারবার
নিরুপায়—কিছুই করতে পারছি নে অভাগায়

সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা ভুলা কি যায়? যায় না—যাবে না—

ভুলতে পারি না—পারব না
পূর্বজনদের আত্মত্যাগের কথা
এক সাগর রক্তের শোকগাথা কাহিনি
ভুলা যায়নি—ভুলা যাবে না
সেই রক্তের কাফনে রাঙা রক্তিম ইতিহাস
আরেক কারবালা বাংলার
আরেক ইতিহাস পৃথিবীর
দেখেছিল পৃথিবী—
কীভাবে বনেছিল লাল-সবুজের পতাকা
পরাধীনের শৃঙ্খলভেড়ি থেকে মুক্ত হলাম আমরা
আমাদের মা-বাবা-ভাই-বোনেরা রক্ত দিয়েছিল বলে
আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা

তারা কি পেল সম্মানের কবর?

বন্ধুগণ!
আর কেন, কীসের আন্দোলন?
কভু—কখনো শাহবাগ!
কভু—কখনো শাপলাচত্বর!
এভাবে-ওভাবে—কোনো অজুহাতে চলছে—চলে আসছে—
কখনো ভাঙচুর
কখনো জ্বালাপোড়া
হামেশা—দেশের ভেতরে কেন এ অশান্তির মহড়া?
কোন শান্তিপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ বাঁচামরার লড়াই?
হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে কে পেয়েছে শান্তি?
কার হয়েছে উন্নতি? সদ্গতি?
অন্ধের পা-তলে আর কত পিষ্ট মানব ও মানবতা
আর কত?
আর কত খুনের রঙে রঞ্জিত হবে দেশ—দেশের মাটি

ভাইয়েরা!

হাসতে পারি না আর
বিদ্রূপের হাসিতে বড়বেশি জ্বালা
দৈত্যের কবল থেকে মুক্ত হতে পেরেছি ঠিক
কিন্তু—
কিন্তু হায়েনা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি কি?
এদেশ এখনো কি রাক্ষসের হাতে জিম্মি নয়?
দেশ—ধর্ম—জাতির জন্যে যুদ্ধ জায়েজ
তবে জায়েজ নয় স্বার্থের লড়াই
সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধ হয়েছে—হবে—হোক—
তবে—
তবে না হোক যুদ্ধ ধ্বংসের
হোক বিনয়ীসোচ্চারে মৌনমিছিল
আভাসের ভাষায় হোক তীব্রপ্রতিবাদ
তাতে না, জ্বলবে কোনো লোকালয়
না, হবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি
সবার অন্তর হোক দরদে দরদি—সহানুভূতিতে ভরা
বিশ্ব হতে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ুক বাংলা ও বাঙালির ত্যাগের মহিমা
আমাদের রাজনীতি হোক—সন্ধি হোক
রাজনীতি হোক অহিংস—সন্ধি হোক দৃষ্টান্ত
আমাদের সন্তানদের না হোক হিংসুটে মন—হিংস্র আচরণ
আমরা হিংসুটে হলে আমাদের সন্তানেরা হবে হিংস্র

ভাই আমার—বন্ধু আমার

একবার ভেবে দেখো নিরলে ও নিভৃতে বসে
ভেবে দেখো গভীর মনোযোগে—
কী পেলাম আমরা?
দেশকে কী দিলাম—দিচ্ছি আমরা?
কী করছি আমরা?
সন্তানদের দিয়ে যাব—শিখিয়ে যাব—
হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরার ও মারার এবং অমানুষ বনার শিক্ষা?
শেখাব ভেদাভেদ—শত্রুমিত্র ও আপনপর—
শেখাব পরশ্রীকাতরতা?

দেশ কী? দেশপ্রেম কী?

দেশ মানে কি আমার একার নিজস্ব একটি ভূখণ্ড?
নাকি আমার একান্ত ব্যক্তিগত নিজের সম্পদ?
নাকি একমাত্র জাতিগত বসবাসের স্থান?
নাকি একমাত্র ধর্মজাতির আবাস?
দেশ মানে—আমার ঘর, আমার বাড়ি
আমার পাড়াপ্রতিবেশি, আমার আপনপর
দেশ মানে—মানুষ-মনুষ্যত্ববোধ
দেশ মানে—সর্বজনীনতা—সার্বজনিক—সর্বভূতে দয়া—
একে-অপরে হাসাহাসি, মাতামাতি, ডাকাডাকি ও ভালোবাসাবাসি
দেশ মানে—একে-অপরের সুখদুঃখ ভাগাভাগি
দেশ মানে—আমার বিদ্যাপীঠ—আমার সহপাঠী—স্কুল-কলেজ-মক্তব-মাদ্রাসা
আরাধ্য-আরাধনালয়, উপাস্য-উপাসনালয়—
এবাদতখানা—মসজিদ-মঠ-মন্দির-গির্জা
দেশ মানে—হাটখোলা, রথখোলা, মিলনমেলা ও মিলনকেন্দ্রের বাজার

দেশ মানে এ নয়, রাতদিন মিছিলমিটিং, আন্ধা-আন্দোলন, জ্বালাপোড়া,
হাতাহাতি, লাঠালাঠি, মারামারি, কাটাকাটি এবং রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা!
দেশ মানে এ নয়, হাতে লাঠি—বুকে ব্যানার এঁটে ‘আগুনজ্বালা’ ‘আগুনজ্বালা’
উস্কে দেওয়া ভাষণ ও প্রতিবাদসভা—
দেশ মানে নয়—নয়—এ নয়

দেশ মানে—সুখ, দেশ মানে—শান্তি
দেশ মানে—ভ্রাতৃভাব—মাতৃটান
দেশ মানে—একটি ভূখণ্ড—একটি মানচিত্র—
একটি ভূখণ্ডে বিভিন্ন জাতি ও নৃগোষ্ঠীর একসাথে পথচলা
এবং—
এবং জাতিধর্ম ও জাতিবর্ণনির্বিশেষে একসাথে অসংখ্য লোকের বসবাস
এটাই দেশ, এটাই দেশের আকৃতি-প্রকৃতি
এটাই প্রত্যেক দেশের ইতিঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি

এটাই দেশপ্রেম

হাঁস মরলে মিছিল!
মাছ মরলে মিছিল!
সভায় সভায় মিছিলে মিছিলে মিটিঙে মিটিঙে আন্দোলনে আন্দোলনে লাভ কার?
‘মার মার’ ‘কাট কাট’ রক্তারক্তি খুনোখুনি মারণেমরণে ধ্বংসবিধ্বংসে ক্ষতি কার?
নিজের সম্পদের ক্ষতি করে পরের লাভ তো করা যায়
তবে—
তবে বিনিময়ে নিজের শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই—কিছু নাই

কার কোন অধিকার হরণ হয়েছে ভাই?

এটাই কি দেশপ্রেম?
এটাই কি দেশের সৌন্দর্য?
না না—এটা দেশপ্রেম নয়
এটা দেশের সৌন্দর্য নয়—
দেশপ্রেমের নামে স্বার্থ হাসিল—সৌন্দর্যের অভিশাপ

কদর্যের কোনো কিছু তৈরি করা অতি সহজ—
সহজ নয়—সর্বদর্শী—সার্বকালিক প্রশংসনীয় সৌন্দর্যের কোনো কিছু সৃষ্টি করা
অরে বাঙাল, বাঙাল হয়ে আর থাকবে কতকাল!
বোকা, এবার একটু জ্ঞানটা খাটাও-না একবার—
লড়ছি কেন আমি? মরছি কেন আমি?
লাভটা কার?

বন্ধু, শোন—জেনে রেখো—

কোনো নেতানেত্রী কার—কারও ভালো করেনি—করবে না
কোনো মানুষ কারও ভালো দেখেনি—দেখবে না
দুনিয়াটা স্বার্থেই কায়েম—স্বার্থেই ভরা
কেউ কারও ভালোর ভিত্তিতে হাঁটে না—চলে না
মানুষ মনে রাখে শুধুই তিক্ততা—শুধুই দুঃখকষ্ট, আঘাত ও যন্ত্রণা
উপকার—উপহার কেউই মনে রাখে না

জান দেবে তুমি? দিতে পারো—

বিনিময়ে পাবে শুধুই ধিক্কার ও ধিক্কার
ভাই বলো—বন্ধু বলো—যতই আপনজন বলো—
তোমার ত্যাগের দাম কেউ দেবে না
কেউই বুঝবে না তোমার ব্যথা কী
কেউই ভাগ করে নেবে না তোমার দরদ
মানুষ কেবলই স্বার্থ বুঝে—স্বার্থের ভিত্তিতে হাঁটে
স্বার্থ যেখানে বড় না সেখানে ভুলেও কেউ পা রাখে না—রাখবে না
মনে রেখো—মনে রেখো এটা—মনে রেখো কথাটা

আগন্তুকেরা! শোনো—

যেই স্বাধীন পতাকাতলে তোমরা জন্মেছ
সেই স্বাধীন পতাকার মর্যাদা তোমরা রেখো
ভুলে যেয়ো না পূর্বপুরুষদের আত্মত্যাগের কথা
ভুলে যেয়ো না বাহান্ন-একাত্তরের রক্তসাগর ও রক্তের ইতিহাস
ভুলে যেয়ো না রক্তলালে এই বাংলা হয়েছিল কারবালার ময়দান—
অতীত ভুলে যাওয়া ঠিক না—মনে রাখা দরকার

অতীত ভুলে যাওয়া জাতি থাকে না জাতির পর্যায়ে

কার বিপক্ষে করছ—করবে বিদ্রোহ
নিজের বিরুদ্ধে কি করা যায় লড়াই?
দেখো—ভাবো—চিন্তা করো সবখানেই তো আপন আর আপনালির বাস
তবে কেন তুমি—তোমরা জ্বলছ—জ্বলবে—
এত দিলজ্বলে—দিলজ্বলা!
জেনো রেখো, জ্বালাময়ী জীবনে কোনো শান্তি নেই
কে হেনেছে—হানছে তবে তোমার—তোমাদের সম্মানে আঘাত
সম্মানের চেয়ে মানবতা অনেক ঊর্ধ্বে জেনো—

বন্ধু!

আমি শান্ত থাকতে পারছি না—পারি না
যতক্ষণ দেশে থাকবে অশান্তির মহড়া—
জ্বালাপোড়া—ক্ষয়ক্ষতি—রক্তারক্তি—খুনোখুনি—মারামারি—কাটাকাটির রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা
আমি শান্ত থাকতে পারব না
তুমি শান্ত আছ? শান্তিতে থাকো
ঘুমিয়ে আছ? ঘুমিয়ে থেকো
আমি ঘুমোতে পারছি নে—পারি না—

বন্ধু!

আমার প্রার্থনা—তোমারও হোক—
আর কোনো গণকবর কাম্য নয়
কাম্য নয় কোনো শোকের মাতম ও মৃত্যুর আহাজারি
কাম্য নয় আর কোনো ধ্বংসলীলা—রক্তক্ষয়ী লড়াই ও ফ্যাসাদ
কাম্য নয় কোনো ক্ষয়ক্ষতি—
শান্তির দৃষ্টান্ত হোক এদেশ—এদেশের মাটি
এই মাটিতে হোক শুদ্ধ গণতন্ত্রের চর্চা
হোক ভালোবাসাবাসি প্রতিষ্ঠা
প্রতিষ্ঠিত হোক শান্তি ও সমৃদ্ধির বাংলা
তবেই সম্মানিত আমরা—উন্নত জাতি
স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক

এদেশ আমাদের—আমরা এদেশের সন্তান—

এসো হাতে হাত রাখি
যে যেখানে আছি
মানব ও মানবতা বড় দেখি
এসো—শুদ্ধের স্বরে প্রার্থনা করি—
বাংলা হোক সমৃদ্ধিশালী—সম্প্রীতির দেশ
সুখ ও শান্তির মাটি
বাঙালি হোক বিশ্বে একমাত্র তুলনাহীন জাতি
এসো—
এসো হাতে হাত রাখি…

২ পৌষ, ১৪১৯—কানঞ্চ নগর, চট্টগ্রাম