মেথুপাড়া : ক্ষুদীরাম দাস

মেথুপাড়া
ক্ষুদীরাম দাস

এক.
মেথুপাড়া। সবার মুখে মুখে এই পাড়ার নাম। অনেক দূর থেকেও এই পাড়ার নাম সকলেই জানে। এমনকি মেথুপাড়া থেকে বিশ কিলোমিটার দূরের গ্রাম অথবা শহরের মানুষও এই পাড়ার নাম জানে। কেউ এই পাড়া না চিনলেও অন্তত নামটি তার কানে গেছে।

অনেক ঘৃণিত একটি শব্দ মেথুপাড়া। আর সেই সাথে অবহেলিত ও নিন্দিত এই পাড়ার মানুষগুলো। এইপাড়ায় সভ্য সমাজের কেউ আসে না।

এমনকি এই পাড়ার মানুষের সাথে কেউ মিশেও না। এই পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে আশপাশের কোনো ছেলেমেয়েরাও খেলাধুলা করে না, পড়াশোনাও করে না। মানুষজন তাদের ধারে কাছে ঘেঁষতেও চায় না। রাস্তা দিয়ে হেঁটে চললে, কিম্বা বাজারে গেলে সবাই তাদের থেকে দূরে দূরে থাকে।

একপাশ দিয়ে হেঁটে গেলে, দূর থেকে দেখলে রাস্তার অপর পাশে চলে যায়। মেথুপাড়ার মানুষজন একেবারে কোণঠাসা জীবনযাপন করে।

এটা এখন তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। গা সইয়ে গেছে, এমনকি এটাকে তারা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। মেথুপাড়ার মানুষজন তেমন কিছু মনে করে না।

তার মনে করে, তাদের জীবনই বুঝি এমনই। এখান থেকে তারা আর কোনোদিন ফিরে আসতে পারবে না। এই নিন্দিত জীবনই তাদের মেনে নিয়ে চলতে হবে।
মেথুপাড়ার মানুষজনকে ঘৃণা করার কারণ আছে। সেটা হলো, তারা মানুষের বাড়িঘর, রাস্তার আবর্জনা, বাজার ঝাড়– দিয়ে বেড়ায়। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তারা টয়লেট পরিস্কার করে। সে কারণে, মানুষজন তাদের প্রচÐ রকম ঘৃণার চোখে দেখে। তাদের ধরা ছোঁয়া কোনো কিছু অন্যরা খেতে চায় না। মেথুপাড়ার জনসংখ্যা বেশি হলেও দিনের বেলায় কাউকে বাড়িতে পাওয়া যাবে না। সকাল হলেই সকলে চলে যায়, দূরদূরান্তে মানুষের টয়লেট পরিস্কার করতে, বাজার ঝাড়– দিতে, অফিস ঝাড়– দিতে। তবে মানুষ তাদের ঘৃণা করলেও, তাদের চাহিদা কিন্তু কোনো অংশে কম নয়।

একবার শহরের একসাহেব তাদের পাড়ার এক মেয়েকে শহরে নিয়ে যায়। মেয়েটি দেখতে শুনতে খুবই ভালো ও সুন্দরী। মেয়েকে সে নিজের মেয়ের মতো লালন পালন করে এবং তাকে পড়াশোনা শেখায়। মেয়েটি মেট্রিক পাস করে। এরপর সে একদিন মেথুপাড়া নিজের বাপের বাড়িতে চলে আসে। মেয়েকে দেখতে পেয়ে সকলে অবাক হয়। শহরে থেকে কতো স্ন্দুরী হয়েছে। তাকে মেথুপাড়ার মেয়ে বলে মনেও হয় না। আর মেয়েটিও নিজের বাপের বাড়ির অবস্থা দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। অবুঝ থাকতে চলে গিয়েছিলো। তাই তার বেশি কিছু মনে নেই। আর এখন এসে তার নিজের গোষ্ঠীর এমন পরিস্থিতি মোটেও মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু বাস্তবিক সবই সত্যি। সেটা তো তাকে মেনে নিতেই হবে। কিছুদিন থাকার পর সে আমার শহরে চলে যায় সেই পালিত বাবার কাছে।

দুই.
আকাশ সকাল বেলা এসে হোটেলে ঢুকে নাস্তা করছে। এই হোটেলে সাধারণ আকাশ কোনোদিন এর আগে আসেনি। আজ এই প্রথম আসলো। আকাশ যখন নাস্তা করছিলো তখন তার চোখ দূরে রাস্তার অপর পাশে চলে যায়। সে দেখতে পেলো এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এর আগে আকাশ অনেক মেয়েকে দেখেছে, কিন্তু এই মেয়ের মতো এতো সুন্দরী সে আর আগে কখনো দেখেনি। তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করেই হোটেল বিল মিটিয়ে ছুটে চললো মেয়েটিকে আরেক নজর দেখার জন্যে। তখন তার ইচ্ছে করছিলো এক দৌঁড়ে ঐ মেয়েটির কাছে চলে যেতে। কিন্তু দৌঁড় দিলে মানুষজন খারাপ মনে করবে। তাই কিছুটা দ্রæত গতিতে হেঁটে চললো। রাস্তা পার হয়ে মেয়েটির পিছন পিছন চললো।

আকাশ এমন ভাব করছে, যেন অন্তত কেউ মনে না করতে পারে যে, মেয়েটির পিছু নিয়েছে সে। এক সময় আকাশ একেবারে মেয়েটির কাছাকাছি চলে আসলো। আকাশ সমান তালে হাঁটতে লাগলো। কোনোভাবেই সাহস করতে পারছে না কথা বলার জন্যে। কী করবে, কীভাবে কথা বলার সূত্র বের করবে সেই চিন্তা করতে লাগলো। আকাশ অনেকটা সাহস করে বললো ঃ দিদি শুনছেন?
মেয়েটি থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকালো। আর বললো ঃ আপনি কী আমাকে বলছেন কিছু?
আকাশ ঃ জি¦, আপনাকে বলছিলাম।
মেয়েটি ঃ বলুন।
আকাশ ঃ এখানে কী কোনো বাসাভাড়া পাওয়া যাবে দিদি?
মেয়েটি ঃ পাওয়া যাবে না কেন? অবশ্যই বাসাভাড়া পাওয়া যাবে! এখানে অনেক বাসা খালি পড়ে আছে। আমি গিয়ে দেখুন।
আকাশ ঃ আপনি কি একটু পথ দেখাতে পারেন?
মেয়েটি ঃ আপনার পরিচয়!
আকাশ ঃ আমি ঐ পাড়াতে থাকি।
মেয়েটি ঃ আমিও তো ঐ পাড়াতেই থাকি। তবে শেষ মাথায়।
আকাশ ঃ কী আশ্চর্য! আমিও একই পাড়াতে থাকি, অথচ আপনাকে আমি কোনোদিনই দেখতে পাইনি। অথবা আপনাকে আমি কেনো জানি চিনতেই পারছি না। কোনোদিন দেখেছি বলেও মনে পড়ছে না।
মেয়েটি ঃ আমিও তো আপনাকে চিনি বলে মনে হয় না। এটা হতেই পারে।
আকাশ ঃ আপনি কি আমার উপর বিরক্ত হচ্ছেন?
মেয়েটি ঃ আপনার কি তাই মনে হচ্ছে?
আকাশ ঃ অবশ্য সে রকম কিছু নয়। অন্তত ভদ্রতার খাতিরে এসব বলতে হয় কিনা তাই বলছি।
মেয়েটি ঃ সমস্যা নেই।
আকাশ ঃ আপনার নামটি কী জানতে পারি?
মেয়েটি ঃ আমার নাম অপূর্বা!
আকাশ ঃ আর আমার নাম আকাশ!
মেয়েটি ঃ আমি আমার বাড়ির কাছাকাছি চলে আসছি। দয়া করে আমার পিছু আর আসবেন না। মানুষ দেখলে সন্দেহ করতে পারে।

আকাশ ঃ আপনি ঠিকই বলেছেন। দেখুন না, আমি কতো বোকা। বোকার মতো একটা অচেনা মেয়ের সাথে হেঁটে চলেছি। আর তাও আবার কথা বলতে বলতে। মানুষ দেখলে নির্ঘাত কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে।
মেয়েটি ঃ দয়া করে আর আসবেন না।
আকাশ ঃ ঠিক আছে।
কথাটি বলেই আকাশ থমকে দাঁড়ালো। ভাবলো, মেয়েটির অন্তত নামটি জানা হলো। আর কোন বাড়ির মেয়ে সেটাও বুঝতে পেরেছি।

দ্বিতীয় দিন আবার ওদের দু’জনের সাথে দেখা হলো। তাড়াতাড়ি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললো। বলতে বলতে একসময় আকাশ সুযোগ পেয়ে নিজের মনের কথা অপূর্বাকে বলে দিলো। অপূর্বা কোনোভাবেই তার কথায় মোটেও রাজি হলো না। তাছাড়া একজন অপরিচিত মানুষের সাথে দু’দিনের পরিচয়ে বিশ^াস করাটা যেমন উচিত হবে না, তেমনি প্রেমে জড়িয়ে যাওয়াটাও বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। অপূর্বা খুবই চিন্তায় পড়ে গেলো। আকাশ কোনো হোটেলে গিয়ে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দিলো। অনেক পীড়াপীড়ির পর রাজি হলো। ওরা দু’জন দূরত্ব বজায় রেখে হোটেলে ঢুকলো, যেন কেউ তাদের চিনতে না পারে।
আকাশই আগবাড়িয়ে বললো ঃ কী চিন্তা করছেন?
অপূর্বা বললো ঃ আপনি আমাকে কেনো এ ধরনের প্রস্তাব দিলেন?
আকাশ ঃ তোমাকে আমার ভালো লেগেছে তাই!
অপূর্বা ঃ আপনি কি আমার সম্পর্কে কিছু জানেন?
আকাশ ঃ মানে?
অপূর্বা ঃ মানে আমি কোথাকার মেয়ে? কী আমার আসল পরিচয় এসব আর কি!
আকাশ ঃ তুমি শিক্ষিত মেয়ে, অন্তত কিছুটা হলেও পড়াশোনা করেছো। আর তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে, তোমার অনেক গুণ আছে, স্মার্ট মেয়ে। এর চেয়ে আর কী জানার থাকতে পারে?
অপূর্বা ঃ একটা মেয়ের সম্পর্কে তো ছেলেরা অনেক কিছু জানতে চায়।
আকাশ ঃ সে ধরনের আমার কিছু জানার দরকার নেই। আমি তোমাকে পছন্দ করি, ভালো লাগে।
অপূর্বা ঃ সুতরাং তোমাকে বিশ^াস করাটা কি আমার ভুল হবে না তো।
আকাশ ঃ অবশ্যই না।
অপূর্বা ঃ কিন্তু আমার সমস্যা আছে।
আকাশ ঃ কোন সমস্যার কথা বলছো?
অপূর্বা ঃ মেথুপাড়ার কোনো মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে পারবে?
আকাশ ঃ যদি সে তোমার মতো হয় তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।
অপূর্বা ঃ কেন আপত্তি নেই তোমার?
আকাশ ঃ কারণ, সে তোমারই মতো। সুতরাং কেনো তাকে আমি অবহেলা করবো?
অপূর্বা ঃ না না না, তা কী করে হয়? ঐ পাড়ার মানুষকে সকলেই ঘৃণা করে, নিন্দা করে, অবহেলা করে।
আকাশ ঃ তার মানে! তুমি কী বলতে চাও?
অপূর্বা ঃ আমি ঐ পাড়ারই মেয়ে!
আকাশ উঠে দাঁড়ায়। তুমি এটা কী বলছো? আকাশ অনেক সময় পর্যন্ত একদৃষ্টিতে অপূর্বার দিকে তাকিয়ে থাকে। এর আগে কখনো এভাবে দীর্ঘসময় পর্যন্ত তাকিয়ে থাকেনি। মনে হচ্ছে নতুনভাবে অপূর্বাকে দেখছে। এমনভাবে দেখছে, যেন বাজার থেকে লাউ কেনার সময় মানুষ যেভাবে পরীক্ষা করে দেখে ঠিক সেইভাবেই দেখছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে আকাশ বুঝতে পারলো, আসলে অপূর্বাকে সেই মানুষ বলে মনে হয় না। আকাশ বললো ঃ তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?
অপূর্বা ঃ না, মোটেও করছি না। একেবারে সত্যি কথাই বলছি।
আকাশ ঃ তাতে আমার মোটেও সমস্যা নেই।
অপূর্বা ঃ তুমি কি আমার কথা বিশ^াস করছো?
আকাশ ঃ অবশ্যই বিশ^াস করছি।
অপূর্বা ঃ তুমি ভাবছো, আমি তোমার সাথে মজা করছি। আসলেই আমি ঐ মেথুপাড়ারই মেয়ে। সত্যি বলছি। ছোট বেলায় শহুরে বাবু আমাকে নিয়ে আসে এবং আমাকে বড় করে। তিনি আমাকে পড়াশোনা করে বড় করেছেন।
আকাশ ঃ আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি তোমাকেই বিয়ে করবো।
অপূর্বা বিশ^াসের দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায়। অপূর্বার বিশ^াসের জায়গাটা আরো গাঢ় হয়ে যায়। শতভাগ বিশ^াস করা শুরু করে আকাশকে।

তিন.
আকাশ বিছানা থেকে উঠে সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। অপূর্বা তাকে সাহায্য করে। অপূর্বাও সেজেগুজে বসে অপেক্ষা করছে আকাশের জন্যে। আজ আকাশ নিজের বউকে নিয়ে মেথুপাড়া যাবে। কিন্তু অপূর্বা কিছুটা বিমর্ষ। সে ভাবে, ওখানে গেলে হয়তো আকাশের কিছুই ভালো লাগবে না। ভালো লাগারও কথা নয়। কারণ, সেখানে কোনো মানুষ সাধারণত যায় না। মেথুপাড়ার সমস্ত মানুষই অশিক্ষিত। আধুনিকতা সেখানে নেই, বিদ্যুৎ থাকলেও শিক্ষার আলো সেখানে নেই। মানুষের অবহেলার শিকার মানুষগুলো অজানা অন্ধকারে বসবাস করছে। সেখানে গেলে হয়তো আকাশের মোটেও ভালো লাগবে। আবার আকাশকেও সাহস করে বাড়ন করতে পারছে না। সে তো যাবেই, আর যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতও হয়েছে।

একসময় আকাশের সমস্ত প্রস্তুতি শেষ হয়। আকাশ মোটর সাইকেল বের করে, এবং আড়াই ঘন্টার পথ অপূর্বাকে নিয়ে রওনা হয়। একসময় তারা পৌঁছে যায় মেথুপাড়ায়। আকাশ দেখলো, সত্যিই এখানে মানুষজন আসে না কেনো। কিন্তু আকাশ এসেছে। আকাশের আসায় সকলেই খুবই খুশি হয়েছে। মেথুপাড়ায় আনন্দের বন্যা বইয়ে গেছে। সবাই অপূর্বার প্রতি খুবই খুশি যে, অন্তত একটি মেয়ে শিক্ষার আলো পেয়েছে, আর সে ভালো স্বামী পেয়েছে। আকাশ ভালো স্বামী না হলে তো এমন একটি জায়গায় আসার কথা নয়।

একজন বয়স্ক লোক আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে আকাশের কাছে এসে বললো ঃ বাবা, তুমি আমাদের এখানে আসছো, আমরা খুবই খুশি হয়েছি। আমরা ভাবতেও পারি না যে, তুমি আমাদের মতো মানুষের জায়গায় আসবা। তাছাড়া আমাদের মেয়েকে তুমি বিয়ে করেছো, এটা স্বপ্নে ছাড়া হয়ই না।

আকাশ ঃ সেও তো মানুষ! আর সে শিক্ষিত একটা মেয়ে। অপূর্বার মধ্যে অনেক শিক্ষা আছে। কেন তাকে আমি ভালোবাসতে পারবো না? তার তো অনেক যোগ্যতা আছে।

বয়স্ক লোক ঃ তুমি বড় মনের মানুষ বাবা। আমরা তোমাকে পেয়ে খুবই খুশি।

আকাশ দেখতে পেলো, দূর থেকে ভদ্র সমাজের মানুষগুলো তার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ চোখের দৃষ্টিতে আকাশকেই নিন্দা করছে। কেউ কেউ বলছে, কী ধরনের রুচির মানুষরে! এই লোকটা তো ভদ্র সমাজেরই হবে। দেখতেই খুবই সুন্দর। সে তো ইচ্ছে করলে ভালো সমাজের মেয়ে বিয়ে করতে পারতো। এমন মেথুপাড়ার মানুষ সে কেনো বিয়ে করলো। লোকটার মধ্যে রুচি বলতে কিছুই নেই। আবার কেউ কেউ বললো, লোকটাকে ফাঁসিয়েছে ঐ পাড়ার মানুষজন।

আকাশের এসব আর ভালো লাগছিলো না। শুধু তার মনে প্রশ্ন জাগে, কেনো এই মেথুপাড়ার মানুষদের ঘৃণা করে সবাই।

সন্ধ্যায় মেথুপাড়া লোকে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সবাই আকাশকে দেখতে আসে। আকাশ সকলকে অনুরোধ করে যেন সকলে তার কথা শুনবার জন্যে আসে। তার কথামতো সকলে সন্ধ্যায় একজায়গায় জড়ো হলো। বিশাল জায়গায় খুবই সুন্দর করে সাজালো। আকাশ বুঝতে পারলো, মেথুপাড়ার মানুষদের কোনো টাকা পয়সার অভাব নেই। অভাব শুধু মানুষের সম্মান পাওয়ার, গুরুত্ব পাওয়ার। সে সকলের উদ্দেশ্যে বললো, আমি দেখতে পেলাম যে, আপনাদের এখানে কোনো কিছুর অভাব নেই। শুধু অভাব রয়েছে শিক্ষার। আপনারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। অথচ এই শিক্ষা আপনাদের খুবই দরকার। আপনারা আপনাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠান। তাহলে তারা শিক্ষার আলো পাবে। লেখাপড়া না করলে জগতকে চিনতে পারা যায় না, নিজেকেও চিনতে পারা যায় না। আপনারা যদি শিক্ষা অর্জন করেন তাহলে আপনারা সব জায়গায় সম্মান পাবেন, আপনাদের সম্মানের জায়গা তৈরি হবে।

একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে বললো ঃ কীভাবে কী করতে হয় সেটা তো বাবা আমরা জানি না।
আকাশ বুঝতে পারলো সমস্যা কোন জায়গায়। পরের দিন সুন্দর করে দরখাস্ত লিখলো, আর মেথুপাড়ার ৩০ জন ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। স্কুলে যাওয়ার সময় আশপাশের মানুষজন হা-করে তাকিয়ে রইলো। সকলেরই মনে প্রশ্ন ওরা কোথায় যাচ্ছে? তারা দেখলো, এতোগুলো ছেলেমেয়ে সকলেই স্কুলের উদ্দেশ্যে চলেছে। স্কুলের গেইট দিয়ে প্রথমে কেউ তাদের ঢুকতে দিতে চাইলো না। পরে আকাশ নিজেই প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বললো। প্রধান শিক্ষক জানালেন, যদি আমরা ওদেরকে স্কুলে ভর্তি করি তাহলে আমাদের স্কুল থেকে সমস্ত ছেলেমেয়ে অন্য স্কুলে চলে যাবে। অথবা তারা আমাদের স্কুলে আর পড়তে চাইবে না। সুতরাং আমরা আমাদের স্কুল নষ্ট করতে চাই না। তোমরা বরং অন্য স্কুলে চেষ্টা কর।

আকাশ বললো, ঠিক আছে, আপনি যদি ওদেরকে স্কুলে না নিতে চান, তাহলে দরখাস্তে মন্তব্য করে দিন। তাহলে আমরা অন্য স্কুলে চেষ্টা করবো। কারণ, তারাও তো এই দেশেরই নাগরিক। তাদেরও স্কুলে ভর্তি হওয়ার অধিকার আছে। তাদের অধিকার আপনারা কেড়ে নিতে পারেন না।
প্রধান শিক্ষক বললেন, বাবাজি তুমি আমাদের ক্ষতি করো না।
এর মধ্যে বেশ কয়েকজন অভিভাবক এসে হাজির হলো। বিষয়টি বুঝতে পেরে বললেন, আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের এই স্কুলে আর পড়াবো না। কারণ, মেথুপাড়ার ঘৃণিত লোকদের সাথে আমাদের সন্তানরা মোটেও পড়বে না।
আকাশ তার কাছাকাছি গিয়ে বললো, এটা আপনার মানসিকতার পরিচয়। আপনি বিষয়টি মোটেও বুঝতে চাইছেন না। তাই একথা বলছেন।
অভিভাববক ঃ আপনার কথা আমাদের আর বোঝার দরকার নেই।
আকাশ ঃ আমি ওদের এই স্কুলেই ভর্তি করিয়ে নেবো।
অভিভাবক ঃ এখানে ওরা ভর্তি করাতে পারবেন না।
আকাশ ঃ এটা তো নিশ্চয় আপনার স্কুল নয়।
অভিভাবক ঃ অবশ্যই আমাদের স্কুল।
আকাশ ঃ তাহলে এটা মেথুপাড়ার ছেলেমেয়েদেরও স্কুল। তাদেরও অধিকার আছে এখানে ভর্তি হবার। তারা শিক্ষার আলো পাবে।

আরেকজন অভিভাবক এগিয়ে বললেন, আকাশ বাবা, তুমি তো বিষয়টি বুঝতে চাইছো না। মেথুপাড়ার ওদেরকে পাড়াশোনা করার দরকার নেই। ওরা তো চিরজীবন এভাবেই বংশপরম্পরায় এভাবে চলে আসছে। এভাবেই ওদের থাকতে দেও না! ওদের লেখাপড়ার কী দরকার!
আকাশ ঐ লোকটি মাথা হতে পাঁ পর্যন্ত একবার ভালো করে তাকালেন। তারপর বললেন, আপনারা তো শিক্ষা পেয়েও অন্ধকারে আছে। আপনাদের মধ্যে তো কোনো শিক্ষার আলোই নেই। আমি তো শিক্ষার আলো দেখতে পাচ্ছি না! তাহলে কী প্রদীপের নিচে অন্ধকার! আপনাদের মধ্যে তো মনুষ্যত্ব বলতে কিছুই নেই।

লোকটি আশ্চর্য হয়ে বললো, এসব তুমি কী বলছো। ওদের জন্যে তোমার এতো মাথ ব্যথা কেনো?
আকাশ একটু বিজ্ঞের মতো বললো, আমি যে ওদের আত্মীয় তাই। আর মধ্যে শিক্ষার আলো আছে। আপনারা তো অমানুষের মতো ওদেরকে দূরে রেখে দিয়েছেন।
তারপর আকাশ প্রধান শিক্ষককে বললেন, যদি শিক্ষকরা ওদেরকে স্কুলে ভর্তি না নেয়, তাহলে আমি ওদের পক্ষ হয়ে লড়াই করবো। আইনের আশ্রয়ও নিতে পারি। শিক্ষা অফিসে আপনাদের সম্পর্কে জানাবো। ওরা এই স্কুলে ভর্তি হবে। এজন্যে যদি অন্য সকল ছাত্র-ছাত্রী স্কুল ছেড়ে চলে যায়, তাহলে তাই হবে।
প্রধান শিক্ষক দেখলেন, ওদেরকে ভর্তি না করিয়ে কোনো উপায় নেই। আগপিছ না ভেবে তিনি সকলকে ভর্তি করালেন। এই কারণে বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুল থেকে নিয়ে গিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করিয়েছে।

চার.
মেথুপাড়ার সকল ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে যায়। এভাবে দুই বছর কেটে গেলো। কিন্তু মেথুপাড়ার ছেলেমেয়েরা স্কুলে গিয়েও শান্তি পায় না। অন্যান্য ছেলেমেয়েরা ওদেরকে ক্ষ্যাপায়। ঘৃণা ও নিন্দার চোখে দেখে। এগুলো মোটেও ওদের ভালো লাগে না। তাছাড়া মেথুপাড়ার মহিলার মানুষের বাসায় কাজের লোক হিসেবে কাজ করে বলেও নিচু জাত বলে নিন্দা করে। আবার টয়লেট পরিস্কার করে বলে ‘মেথর মেঘর’ বলে গালাগালি দিতেও থাকে। এটা নিয়ে বেশ কয়েকবার শালিশ বিচারও হয়েছে। স্কুলের শিক্ষরাও অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।
কিছুদিন পর আকাশ স্কুলে যায় এবং পরিস্থিতি জেনে চিন্তা করতে থাকে, কী করা যায়।
অবশ্য আকাশের পক্ষে মেথুপাড়ার মানুষের জন্যে কিছু করা অসম্ভব বলে কিছু নেই। এই আকাশ মেথুপাড়ার মানুষের জন্যে আশির্বাদ হয়ে এসেছে। এটা মেথুপাড়ার সকল মানুষই বুঝতে পারে। তাই মেথুপাড়ার সকলেই তাকিয়ে থাকে তার সিদ্ধান্তের উপর। একদিন স্কুলে গিয়ে ছেলেমেয়ে ও অভিভাবকদের এ বিষয়ে অনেক বুঝিয়েছে। শিক্ষকদেরও বুঝিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তাদের বিরক্ত করা থেমে থাকে না।
আকাশ অনেক ভাবতে থাকে। কী করা যায়!

অনেক ভেবে আকাশের মাথায় ভিন্ন রকম বুদ্ধি আসলো। সে মেথুপাড়ার মানুষদের মানুষের অবহেলার হাত থেকে রক্ষা করবে। সে সকলকে নিয়ে আরেকদিন সন্ধ্যায় বসে। মেথুপাড়ার প্রতিটা মানুষ একত্রিত হয় আকাশের কথা শুনবার জন্যে। সকলে উপস্থিত হলে আকাশ বললো, আপনারাও মানুষ। আপনাদেরও অন্য দশজনের মতো বেঁচে থাকার অধিকার আছে। সুন্দর জীবন, সম্মানের জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আপনাদের সেই অধিকার হারিয়ে গেছে। আপনাদের মহিলারা মানুষের বাসায় কাজের লোক হিসেবে কাজ করে, আপনারা পায়খানা পরিস্কার করেন, এজন্যে আপনাদের মানুষ ঘৃণা করে। বাসায় কাজের লোক হিসেবে কাজ করেন বলে, মানুষ আপনাদের সাথে খারাপ আচরণ করে। তারা আপনাদের মারধরও করে। অবহেলার চোখে দেখে। সুতরাং যে কাজে নিন্দা বেশি, ঘৃণা বেশি সেই কাজ আপনারা করবেন না। যদি আপনারা এ থেকে রক্ষা পেতে চান তাহলে আমি আপনাদের ভিন্ন পথ দেখাবো। এটা আপনারা বিশ^াস করুন যে, যে কাজ ঘৃণার বুঝতে হবে সেই কাজ করা মোটেও উচিত নয়। যে কাজে মানুষ মানুষকে ভালো চোখে দেখে না, মানুষ মনেই করেনা সেই কাজ করা মোটেও উচিত নয়। সেই কাজ ত্যাগ করা উচিত নয়। সেই কাজ ছেড়ে দেয়া উচিত। যে কাজে নিজের ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয়, সম্মান নষ্ট হয় সেই কাজে যাওয়া মোটেও উচিত নয়। বাসায় কাজ করেন বলে মানুষ আপনাদের অবহেলা করে। সুতরাং মানুষের বাসায় কাজ করার দরকার নেই।

আকাশ তাকিয়ে দেখলো, তারা প্রায় শতাধিক লোক এই কাজের সাথে জড়িত। সকাল হলেই ছুটে চলে এলাকায় মানুষের টয়লেট পরিস্কার করতে, বাসাবাড়ি ঝাড়ৃ দিতে, কেউ যায় বাসায় কাজ করতে। সুতরাং এতোগুলো মানুষকে বিকল্পভাবে কাজের ব্যবস্থা করাটা একটু কঠিন হলেও আকাশের পক্ষে অসম্ভব নয়। আকাশ বাছাই করে ত্রিশজনকে পরিস্কার জানিয়ে দিলো যে, আপনারা জানিয়ে দেবেন যে আপনারা আর তাদের কাজ করছেন আগামী মাস থেকে। আগামী মাস থেকে আপনারা শহরে গিয়ে কারখানায় কাজ করবেন। প্রতিদিন সকালে হেঁটে গিয়ে প্রধান সড়কে যাবেন। তারপর লোকাল বাসে করে দশ টাকার বিনিময়ে শহরে চলে যাবেন। বিকেলে কাজ শেষে আবার বাসে করে বাড়িতে চলে আসবেন। আপনারা যাদের কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন, তারা তখন আপনাদের পরিবর্তে অন্য মানুষ খুঁজবে, অর্থাৎ তারা আপনাদেরই কাউকে না কাউকে কাজ করার প্রস্তাব দিবে, তখন আপনারা কাজের বিনিময়ে দ্বিগুণ টাকা দাবি করবেন। অন্যথায় তাদের কাজ করতে যাবেন না। তাছাড়া ওদের কাজ করার মতো সময়ও তো আপনাদের কারোর নেই।

এদিকে ঐ ত্রিশজন কর্মএলাকার মালিকদেরকে জানিয়ে দিলো, আগামী মাস থেকে তারা আর কাজ করবে না। এতে ঐ ত্রিশজন মালিক বিষয়টি বুঝতেও পারলো না কী হতে চলেছে। তারা মনে করলেন, একজন চলে গেলে তো আরেকজনকে পাওয়া যাবে। কিন্তু তারা মেথুপাড়া থেকে বিকল্প কাউকে পেলো না। একদিন যায়, দু’দিন যায়, ওদের ভাবনা আরো বেড়ে যায়। বাড়ির মহিলারা একদিন করতে পারে, দু’দিন করতে পারে-এরপর আর পারে না। তারা টেনশন বাড়তে থাকে। তাছাড়া টয়লেটগুলোও নোংরা হয়ে গেছে। দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। কিন্তু পরিস্কার করানোর মতো কাউকে পাচ্ছে না। মেথুপাড়া থেকে অন্য কাউকে যে আনবে তারও কোনো উপায় নেই। কেউই আসতে চায় না।
এদিকে কারখানার বড় বাবুর সাথে কথা ত্রিশজন কর্মীকে কাজে ঢুকিয়ে দিলো। কারখানার বড় বাবুও খুবই খুশি এমন শ্রমিকদের পেয়ে। সুতরাং ওই ত্রিশজন প্রতিদিন বাসে করে শহরে যায় এবং কাজ শেষে বাড়িতে চলে আসে মেথুপাড়ায়।
এরপরের মাসে আকাশ স্কুল ও স্কুলের পাশর্^বর্তী এলাকায় কর্মরত মেথুপাড়ার মানুষের তালিকা করে। সেখানেও প্রায় পঁত্রিশ জনের মতো লোক পাওয়া গেলো। তাদের সকলের নাম নিয়ে শহরের বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক হিসেবে আকাশ তাদের নিযুক্ত করলো। আর একমাসের নোটিশে তারাও সকলে কাজ ছেড়ে দিলো।
ঐ এলাকার মানুষজন হতবিহŸল হয়ে পড়লো। তারা অবাক হয়ে গেলো, এটা কী করে সম্ভব! চারিদিকে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। ঘৃণিত এই কাজ করার মতো মানুষ তারা আর খুঁজে পাচ্ছে না। কাজের লোক হিসেবে যারা ছিলো, তাদেরও চিন্তার শেষ নেই। কাজের লোক থাকায় বাড়ির মহিলাদের অলস সময় কাটতে হতো। বাড়ির কাজ করার মতো অভ্যাস বাড়ির বউদের মোটেও ছিলো না। বাড়ির মেয়েদেরও অবস্থা একই রকম। বাড়ির কাজ তারা করতে পারতো না। এসব কাজ কাজের লোকে করবে এর রকম একটা সেন্টিমেন্ট তাদের তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। তারাও খুবই টেনশনে পড়ে গেলো। কেউ কেউ আবার মেথুপাড়ায় ছুটে গেলো, যদি বা কাজের লোক হিসেবে কাউকে পাওয়া যায়! কিন্তু সে রকম কাজ করার মতো তারা কাউকে পেলো না। আবার দু’একজন রাজি হলেও আগের চেয়ে চারগুণ টাকা দাবি করে। এটা শুনে তারাও চলে আসে। চারিদিকের মানুষজন দিশেহারা হয়ে যায়। ভদ্র সমাজের মানুষগুলো অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। বাড়ির বউরা অশান্তি শুরু করে দেয়, ‘কাজের লোক নিয়ে আসো, কাজের লোক নিয়ে আসো, আমি এসব কাজ করতে পারবো না, আমরা কেনো এসব কাজ করবো, এসব কাজ আমাদের কারা মানায় না’ ইত্যাদি বলতে থাকে।
আবার টয়লেট পরিস্কার করার কথা তো চিন্তাতেই আনতে পারে না। স্কুলের অবস্থাও খারাপ হতে শুরু করেছে। টয়লেটগুলো নোংরা হয়ে গেছে। পরিস্কার করার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। কয়েকজন শিক্ষক মেথুপাড়ার ছেলেমেয়েদের দিয়ে পরিস্কার করাতে চাইলো। কিন্তু তারা বললো, এটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা যদি পরিস্কার করি, তাহলে তো আমরা স্কুলে থাকতে পারবো না। স্কুলের সকলে আমাদের ‘মেথর’ বলে গালাগালি করবে ও ঘৃণা করবে। অপরদিকে অভিভাবকরাও চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এভাবে আর কতদিন চলা যায়। স্কুলের টয়লেটের অবস্থা খুবই খারাপ; আবার বাড়িতে টয়লেটগুলোও অপরিস্কার হয়ে আছে। বাড়িতে কিম্বা স্কুলে ছেলেমেয়েরা টয়লেটে যেতে পারে না। নোংরা হয়ে গেছে টয়লেটগুলো। মেথুপাড়ার কাউকে পরিস্কার করতে বললে, ওরা এতো টাকা দাবি করে যে একজন শিক্ষকের একমাসের বেতন। সেটা কী করে সম্ভব।
অপরদিকে পরিশ্রমী শ্রমিক পেয়ে আকাশের উপর কারখানার মালিকরা খুবই খুশি। আকাশ শুধু তাদের বলেছে, যেন তাদের অন্তত মানুষ হিসেবে দেখা হয় ও সম্মান যেন করা হয়। কারখানার মালিকরাও সেভাবে শ্রমিকদের উপর খুবই যতœ নেয়। আকাশকে আরো উৎসাহিত করে যেন আরো শ্রমিক তাদের কারখানায় নিয়ে আসে।
এবার আকাশ চিন্তা করে, মেথুপাড়ার অন্য সকলকে একসাথে কাজ ছাড়িয়ে শহরের নতুন কারাখানায় যুক্ত করাবে। আর আকাশ সেটাই করলো। এভাবে মেথুপাড়ার প্রতিটি পরিবারের মানুষ ঘৃণিত কাজ ছেড়ে দিলো। চারিদিকে মানুষজন দিশেহারা হয়ে গেলো।
মেথুপাড়ার ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হয়ে উঠলো, শহরের ছোঁয়া পেয়ে সকলেই বুঝতে শিখলো জীবনের অর্থ। এলাকার মানুষও মেথুপাড়ায় ভিন্ন চিত্র দেখতে পেলো। ওরা আর কোনোদিনই মানুষের বাসায় কাজ করতে যায় না, মানুষের টয়লেট ও পায়খানা পরিস্কার করতে যায় না।
ভদ্র সমাজের মানুষগুলো এখন উল্টো সুরে চলছে। তারা একেঅপরকে বলছে, ‘কোনো কাজই ঘৃণার নয়, কোনো কাজই অসম্মানের নয়, নিজের কাজ নিজে করলে কোনো লজ্জা নেই।’ এসব শুনে মেথুপাড়ার লোকজন হাসে।
মেথুপাড়ার ছেলেমেয়েরা স্কুলে গিয়ে জানতে পারে, এখন অন্যান্য সহপাঠীদের পরিবারগুলো কেমন চলছে। সাজু মেথুপাড়ার চালাক ছেলে। আর সে এগিয়ে গিয়ে সহপাঠী সবুজকে বললো ঃ তোদের বাসার কাজের লোক কে থাকে রে?
সবুজ ঃ কেনো আমার মা করে?
সাজু ঃ ছি! ছি! ছি! এটা তো নিন্দার কাজ। এতো নিচু কাজ কীভাবে করে?
সবুজ ঃ নিজের কাজ নিজে করলে ছোট হয় নাকি?
সাজু ঃ অবশ্যই হয়। এতো জাত যায়। সম্মান নষ্ট হয়। আর তোদের বাড়ির টয়লেট পরিস্কার করে কে?
সবুজ ঃ কোনোদিন আমার মা করে, কোনোদিন আমার বাবা করে, কোনোদিন আমিও করি।
সাজু ঃ ওয়াক থু! ছি! ছি! ছি! এটা তোরা পরিস্কার করিস।
ওরা কথা বলছে, এমন সময় অনেক সহপাঠী এসে সেখানে জড়ো হলো। তারা ওদের কথা শুনছিলো।
সাজু আবার বললো ঃ এই ঘৃণিত কাজ তোরা করিস। তোরা তো ভদ্র সমাজের লোক। এসব কাজ তো তোদের দিয়ে মানায় না। আমি আজই স্যারকে বলবো, আমি আর এই স্কুলে পড়বো না।
সবুজ ঃ কেনো পড়বি না? স্কুলের সবারই মা বাবা বাড়ির কাজ করে। মায়েরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে। কোনো কাজ কি ছোট আছে নাকি।
সাজু ঃ অবশ্যই ছোট আছে। এখন তোমরা এই যুক্তি দিচ্ছ। কেনো, তখন তোমরা এই যুক্তি দিতে পারনি? এখন তো তোমরাও আমাদের মতো মেথুপাড়ার মানুষ হয়ে গেলে।
এরই মধ্যে স্কুল ছুটি হয়ে গেলো। সকলে স্কুল থেকে বের হলো, সাজুর সাথে মেথুপাড়ার অনেক ছেলেমেয়ে ছিলো। তারা সকলে একসাথে অন্য ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে প্রতিবাদের ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলতে থাকলো,
মেথর!
তোরা সব মেথর!
তোদের বাড়ির সকলেই মেথর!
মেথর!
মেথর!
মেথর!
মেথর!
ওদের এভাবে নিন্দা করতে দেখে ভদ্র সমাজের কিছু অভিভাবক তাকিয়ে রইলো। কিন্তু প্রতি উত্তরে কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলো না। কারণ, ভাষা ওরা হারিয়ে ফেলেছে।
মেথুপাড়ার সকলেই বাজারে যায়। সব জায়গায় তারা সম্মানের সাথে চলতে থাকে। আর তাদের দেখলে ভদ্র সমাজের লোকদের মনে হয়, যেন ওরা আঙ্গুল উঁচিয়ে বলছে,
মেথর!
মেথর!
মেথর!
মেথর!
এভাবে দীর্ঘদিন কেটে যায়। কয়েক প্রজন্ম চলে যায়। ওখানে এখন বড় বড় শিক্ষিত লোকের বসবাস। মেথুপাড়া নামটি রয়েই গেছে। তবে সেটা মেথুপাড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিশাল এলাকা জুড়ে নামটি বিস্তৃত!