করতোয়া ট্র্যাজেডি : ছোট ভাইয়ের হাত ধরে বেঁচে গেল বড় বোন

এন এ রবিউল হাসান লিটন, পঞ্চগড় জেলা প্রতিনিধিঃ

দুই ভাই-বোনের বেঁচে যাওয়ার সে দিনের লোমহর্ষক গল্প জানায় আপন ভাই-বোন দু’জনে। ২৫ সেপ্টেম্বর রবিবার দুপুরে বোদা উপজেলার মাড়েয়া আউলিয়ার ঘাটে নৌকা ডুবে যাওয়া নৌকায় যাত্রী ছিলো মাড়েয়া উচ্চ বিদ্যলয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র তর্পণ রায় এবং একি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে বোন ঈশিতা কলি রায়।

আউলিয়া ঘাট দিয়ে প্রায় ১০০ জন যাত্রীর সংঙ্গে তারা দুই ভাই বোন মিলে যাচ্ছিল বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া অনুষ্ঠানে। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ যাত্রী নিয়ে যাওয়া নৌকায় উঠে পরে তারা। একটু এগুতেই নৌকায় পানি ওঠা শুরু করে। পরক্ষণেই নৌকায় লাগানো শ্যালোর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই নৌকাটি তলিয়ে যেতে শুরু করে। শুরু হয় যাত্রীদের আত্যচিৎকার। বাঁচাও বাঁচাও চিৎকারে কেঁপে ওঠে আকাশ বাতাস। নৌকার সকল যাত্রী পানিতে ডুবে যেতে থাকে। তার সাথে ডুবতে থাকে ভাই-বোন ঈশিতা কলি রায় এবং তর্পণ রায়। পানিতে ডুবতে থাকার সময় সাঁতার জানা ছোট ভাই বড় বোনকে এক হাত ধরে টানতে টানতে অনেকটা সময় তারা বাঁচার চেষ্টা করে। এর পরে উদ্ধারকারী নৌকায় তোলা হায় তাদের।

ঈশিতা-তর্পণ মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের সর্দারপাড়া গ্রামের কৈলাশ চন্দ্র রায় এবং সুচিত্রা রানীর দুই সন্তান। তারা দুইজনই মাড়েয়া উচ্চ বিদ্যলয়ের শিক্ষার্থী।

বড়বোন ঈশিতা জানায়, “সাঁতার জানতাম। কিন্তু ওড়নায় আমার দুই পা আটকে যায়। আমি খালি ডুবছি আর উঠছি। আর সবাইকে ডাকছি। এমন সময় আমার ছোট ভাই তর্পণ আমার হাত ধরে টানতে থাকে। আমাকে একটি নৌকার কাছে নিয়ে আসে। পরে নৌকাটিতে উঠি। এরপর আর কিছু বলতে পারিনা। বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হওয়ার পর জ্ঞান ফেরে। এই স্মৃতি কোনদিন ভুলতে পারবো না। বেঁচে আছি এটা বিশ্বাসই হচ্ছেনা। আমার যেন পূ্র্ণর জন্ম হয়েছে।”

ছোট ভাই তর্পণ জানায়, “নৌকাটা ডুবতে থাকলে আমি সাঁতার কাটতে থাকি। পাশে আমার বোন হাবুডুবু খাচ্ছে। আর চিৎকার করে লোকজন ডাকছে। আমি তখন বোনের একটি হাত ধরে ফেলি। এরপর তাকে টানতে থাকি। একটি নৌকা এগিয়ে আসে। আমরা নৌকায় উঠে পড়ি।”

সে দিনের সেই নৌকাডুবিতে এখন পর্যন্ত ৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবান কিছু মানুষ বেঁচে যায়। এদের মধ্যে তর্পণ ও ঈশিতা দু’ভাই- বোন ভাগ্যবান।

তাদের পিতা কৈলাশ চন্দ্র রায় বলেন, “আসেপাশে যেভাবে মানুষ মারা গেছে তাতে ঈশ্বরের কৃপায় আমার সন্তান দু’টো বেঁচে আছে এটাই অনেক বড় পাওয়া।”

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় চতুর্থ দিনের উদ্ধার কাজ চলছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ জনে। বুধবার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকালে করতোয়া নদী থেকে কোন মরদেহ উদ্ধার করা হয়নি।

এদিকে জেলা প্রশাসনের জরুরি তথ্য কেন্দ্রের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৬৮ জনের মধ্যে ৬৫ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ৩ টি মরদেহের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। শনাক্তের কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে ৪ জন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দীপঙ্কর রায়।

মৃতদের মধ্যে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ৪৫ জন, দেবীগঞ্জের ১৭ জন, আটোয়ারীর ২ জন ও ঠাকুরগাঁওয়ের ৩ জন পঞ্চগড় সদর ১ জন রয়েছেন। ৬৭ জনের মধ্যে নারী ৩০ জন, পুরুষ ১৭ জন এবং ২১টি শিশু রয়েছে।

এই মর্মান্তিক ঘটনায় পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পঞ্চগড় জেলায় ৩ দিনের (২৭, ২৮, ২৯ সেপ্টেম্বর) শোক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে।

এর আগে গত রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের করতোয়া নদীর আড়াইটার ঘাটে বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রোববার দুপুরে মহালয়া দেখতে আউলিয়া ঘাট দিয়ে নৌকায় বদশ্বেরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বীর প্রায় শতাধিক মানুষ। নৌকাটি ছাড়ার শুরুতেই দুলতে থাকে। এক পর্যায়ে দুলতে দুলতে নদীতে গিয়ে ডুবে যায়।

এদিকে নৌকাডুবির ঘটনায় গঠিত তদন্তে কমিটির প্রধান ও জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায় জানান, ইতোমধ্যে উদ্ধারকৃত বেশিরভাগ মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের সৎকারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাথাপিছু ২০ হাজার এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।