৮০ ভাগ প্রসূতিকেই সিজারিয়ানে বাধ্য করার বিষয়টা দুঃখজনক!

সোমবার
২৭ জুলাই ২০২০ খ্রিস্টাব্দ
১২ শ্রাবণ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ
০৫ জ্বিলহজ্ব ১৪৪১ হিজরি

 

সম্পাদকীয় ….

‘সোনারগাঁয়ে লাইসেন্সবিহীন বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৮০ ভাগ প্রসূতিকেই সিজারিয়ানে বাধ্য করছে’

আগে হতো, কিম্বা এখনো গ্রামে শতভাগ গর্ভবতী মহিলার নরমাল ডেলিভারী হয়ে থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে গর্ভবতী মহিলাদের জটিল সমস্যা দেখা দিলে শুধুমাত্র তখনই বাধ্য হয়ে সিজারিয়ান করা হতো। নরমাল ডেলিভারী হয়ে কোনো শিশুর জন্ম হলে সেই শিশু হয় স্বাভাবিক সুস্থ শিশু। এতে মা ও শিশু উভয়ই সুস্থ থাকে ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। আর এটাই প্রাকৃতিক! যা আদিকাল থেকে হয়ে আসছে। আর প্রতিটি নারীই গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব করবে নরমালভাবে-এটাকে তারা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে।

অসুস্থতার কারণে অনেক গর্ভবতী মহিলার ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে অতীতে। তখন তাদেরকে বিভিন্ন খারাপ উপাধীতে ভূষিত করা হতো। যা ছিলো শিক্ষার অভাবে তখনকার সময়ে কুসংস্কার! এখন সেসব কুসংস্কার দূর হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আশির্বাদে গর্ভবতী মহিলারা নরমালভাবে সন্তান প্রসব না করতে পারলে তাদেরকে সিজারিয়ান করে মা ও শিশুকে রক্ষা করা যায়। এটিকে আমরা দুর্ঘটনা বলতে পারি।

প্রিয় সময়ে ‘সোনারগাঁয়ে লাইসেন্সবিহীন বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৮০ ভাগ প্রসূতিকেই সিজারিয়ানে বাধ্য করছে’ শিরেনামে প্রকাশিত সংবাদসূত্রে আমরা জানতে পারলাম অদ্ভুত বিষয়। তবে এটা শুধু সেখানেই যে হচ্ছে তা নয়, শহরকেন্দ্রীক প্রায় হাসপাতালগুলোতেই এমন ঘটনা ঘটছে। আমরা সংবাদের মাধ্যমে আরো জানতে পারলাম, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ৮০ ভাগ সন্তানই প্রসব হচ্ছে সিজারিয়ানে। আঁৎকে উঠার মতো ঘটনা। সচেতন মহল এটা পরিস্কার জানে যে, অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানে সন্তান প্রসব করলে মা এবং সন্তান উভয়ই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে।

তবে বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। সুস্থ থাকার জন্যে, স্বাস্থ্যের পরীক্ষার জন্যে এজন গর্ভবতী মহিলাকে ডাক্তারের পরামর্শ নিতেই হয়। সন্তান ও মাকে সুস্থ থাকার জন্যে পরামর্শের পাশাপাশি ঔষধও গ্রহণ করতে হয়; যা’ চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী এটা ভালো। কিন্তু সন্তান প্রসবের সময় সিজারিয়ানে বাধ্য করাটা অন্যায়-যা’ সচেতন মহল মাত্রই অপছন্দ করবেন।
ক্ষেত্র বিশেষে মহিলাদের সিজারিয়ানে উৎসাহিতও করা হয় বিভিন্নভাবে মোটিভেশন দিয়ে। এটাও গ্রহণযোগ্য বিষয় নয়। আমরা জানি যে, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের চেতনা এবং বেদনানাশক ওষুধ মাকে গ্রহণ করতে হয়। যার প্রভাব গিয়ে পড়ে মা ও নবজাতকের উপর। পরবর্তীতে অস্ত্রোপচারে গর্ভ নষ্টের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। আরো যে সমস্যাটি দাঁড়ায় সেটি হলো, পরবর্তীতে শিশু মারাও যেতে পারে।

সিজারিয়ানে সন্তান প্রসব করলে সন্তানকে শাল দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে শুরু করাটা সমস্যা হয়। ফলে শিশুটি মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হয়। এসব ক্ষেত্রে অসতর্কতার কারণে প্রতিবন্ধী শিশু হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এতো কিছুর পরেও সিজারিয়ানে সন্তান প্রসবের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটা ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলে। আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, এসব হলো হাসপাতাল কিম্বা ক্লিনিকগুলোর বড় ব্যবসা।

আরেকটি বিষয় পরিস্কার যে, অনেক মহিলারা সিজারিয়ানেই সন্তান প্রসবে বেশি আগ্রহী। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আবার অনেকের কাছে এটা ফ্যাশন বা আধুনিকায়ন বলেও পরিগণিত। কেউ কেউ আবার নরমালভাবে সন্তান প্রসবের যাতনা সইতে পারবে না বলে সিজারিয়ানের দিকে ঝুঁকে। কারো কারো মতে এটা অত্যন্ত গর্হিত একটা বিষয়। কেউ কেউ আবার অপব্যাখ্যাও করেন যে, সিজারিয়ানে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা নাকি খুবই মেধাবী ও বুদ্ধিমান হয়ে থাকে, তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। এটা মোটেও যুক্তিসঙ্গত কথা নয়, বরং খোঁড়া যুক্তি। সুতরাং একদিকে গর্ভবতী মহিলাদের আগ্রহ; অন্যদিকে ডাক্তারদের টাকা কামাইয়ের উপায়-দু’টো দিকের যোগসূত্রে সিজারিয়ানের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এটা পরিস্কার যে, গ্রামের পরিবারগুলোতে গর্ভবতী মহিলাদের জন্মগ্রহণকারী প্রায় শিশুই নরমাল, বলা চলে শতভাগ। কিন্তু শহরকেন্দ্রীক পরিবারগুলোতে প্রতিটি পরিবারই বলা চলে সিজারিয়ানের আওতায়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই? এমন পার্থক্য কেনো?

প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায় যে, শহরে হাসপাতালগুলোতে প্রসূতি মায়েরাই চিকিৎসার জন্যে গেলে তাদেরকে অপারেশন করতে উৎসাহিত করা হয়। তাছাড়া পরিসংখ্যান করলে বোঝা যাবে যে, এসব ক্ষেত্রে আশি শতাংশেরও বেশি সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেয়া হয়। ধনী গরীবের দিক থেকে পরিসংখ্যান করলে সে ক্ষেত্রে দেখা যাবে, যারা যতো বেশি ধনী সিজারিয়ানের হার হার ততো বেশি। অর্থাৎ এখানে টাকার দাপটই মুখ্য। তাছাড়া শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের দিক থেকেও একই কথা খাটে যে, শিক্ষিত পরিবারগুলোতেই পরিসংখ্যানের হারটা বেশি চলে যায়। তাছাড়া সর্বদিক চিন্তা করলে এটা পরিস্কার যে, একজন মহিলার দিক থেকেই ‘হ্যা’ সূচক সম্মতিটা চলে আসে। অপরদিকে হাসপাতাল তথা ডাক্তারদের হাসি মুখে ‘ইয়েস’ বাহ্বা তো রয়েছেই।

প্রকাশিত সংবাদের আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, ‘নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার ১৮টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে একটি ছাড়া কোনো হাসপাতালেরই লাইসেন্স নেই।’ এই বিষয়টিও মোটেও সন্তোষজনক নয়। সচেতন ও বোদ্ধামহল মোটেও এ বিষয়টিকে মেনে নিতে পারে না। প্রশ্ন জেগে উঠে তখন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের উপর, যারা এসব হাসপাতাল নির্মাণ ও চালানোর ক্ষেত্রে অনুমোদন প্রদানের ক্ষমতা রাখেন। প্রকাশিত সংবাদে অনেকগুলোর হাসপাতালের নাম উঠে এসেছে। সুতরাং খুব দ্রুত সেসব হাসপাতালের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি। শুধু সেখানকার হাসপাতালই নয়, সারা বাংলাদেশে এ রকম প্রচুর হাসপাতাল রয়েছে, যেগুলো এভাবেই দিনের পর দিন চলে আসছে।

কথা হলো, শর্তাবলী পূরণ করতে পারলেই লাইসেন্স পাওয়া যেতে পারে-এটা ভালো দিক। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় যে, একদিকে শর্তাবলী পূরণ করেনি; অপরদিকে লাইসেন্স না পেয়ে কীভাবে হাসপাতালগুলো চলে? আর এ ধরনের হাসপাতাল যদি লাইসেন্সবিহীন দাপটের সাথে চলতে পারে, তাহলে সেখানে তো গর্ভবতী মহিলাদের সিজারিয়ানে উৎসাহিত করা মোটেও বিষয়ই নয়।

এসমস্ত বিষয় বিবেচনায় এনে, বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরী। অপরদিকে ভারী চিন্তার বিষয় যে, যদি অসাধু কিছু কর্মকর্তাদের কারণে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর লাইসেন্স না হয় তাহলে সেগুলো চলবে কীভাবে? তাছাড়া অবৈধ ঘোষণা করে হাসপাতালগুলো বন্ধ করলেও সমস্যায় পরবে সাধারণ রোগীরা। সুতরাং সর্বদিক বিবেচনা করার জন্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।