দেখা হলো শশীলজ

ক্ষুদীরাম দাস :

দূর থেকে ‘শশীলজ’ নামটি শুনেছিলাম। পত্রিকার পাতায় বা বইতেও পড়েছি। কিন্তু সত্যি সত্যি শশীলজ একদিন দেখার সুযোগ হবে সেটা ভাবিনি। সেই সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বেড়াতে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহ কাচিঝুলি মোড় আত্মীয়ের বাড়িতে। জানতে পারলাম, কাছাকাছিই রয়েছে শশীলজ। তো এই সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। সময় সুযাগ মতো দ্রুত শশীলজ দেখতে চলে গেলাম স্বপরিবারে।

সেদিন ছিলো ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ খ্রীঃ। সকালেই স্বপরিবারে রিক্সাযোগে শশীলজ দু’নয়ন ভরে দেখার জন্যে ছুটলাম। গেইটের কাছে রিক্সা থামতেই শশীলজের চতুর্দিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। মনটা আনন্দে ভরে গেলো। রিক্সা থেকে নেমে টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম। আহা! পুরোনো ঐতিহ্যে ভরপুর দৃশ্য! ইতিহাসের জীবন্ত স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে চারিদিকের পরিবেশগুলো। আর গৃহগুলোতে রয়েছে জমিদারি ভাব!

ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত শশীলজ। মহারাজা শশীকান্ত আচার্যের বাড়িটিই শশীলজ। এটি ময়মনসিংহের রাজবাড়ি নামেও সমধিক খ্যাত ও পরিচিয় বহন করে। তার কিছুদূরেই রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ। একজন শিক্ষিত বয়স্ক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলাম, শশীলজ সম্পর্কে। তিনি বললেন, এই বাড়িটির ও বাড়িতে যারা থাকতো তাদের নিয়ে করুণ ইতিহাস রয়েছে। সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কেউ ছিলো না। তাই সন্তানহীন অবস্থায় গৌরীকান্তের মৃত্যুর পর বিধবা পতœী বিমলা দেবী দত্তক নিলেন কাশীকান্তকে। কাশীকান্তের কপালও মন্দ ছিলো ভীষণ। দীর্ঘ রোগযন্ত্রণায় ভুগে সন্তানহীন অবস্থায় তিনিও পরলোকগমন করলেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে কয়েক পুরুষ পর্যন্ত দত্তকই নিতে হলো। এর বেশি কিছু জানি না ইতিহাস।

শুনেছি, সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর শাসনামলে ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী জনপদে যুক্ত হলো সোনালি মাত্রা। প্রায় ৪১ বছর জমিদারি পরিচালনার সময় তিনি বহু জনহিতকর কাজ করলেন। ময়মনসিংহে স্থাপন করলেন একাধিক নান্দনিক স্থাপনা। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে নয় একর ভূমির ওপর একটি অসাধারণ দ্বিতল ভবন নির্মাণ করলেন সূর্যকান্ত। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে এই ভবনের নাম রাখা হলো শশীলজ। বিখ্যাত এই ভবনটি ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলো। তখন সূর্যকান্ত আচার্য খুবই মর্মাহত হয়েছিলো। ১৯০৫ সালে ঠিক একই স্থানে নতুনভাবে শশীলজ নির্মাণ করেন পরবর্তী জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। পরবর্তীতে শশীলজের সৌন্দর্যবর্ধনে তিনি সম্পন্ন করেন আরও কিছু সংস্কার কাজ। তখন শশীলজ হয়ে ওঠে অনিন্দ্যসুন্দর।

আমরা দেখলাম, জীর্ণদশার ভবনটি দেখলেই আন্দাজ করা যায়, একসময় জৌলুশ ছিল বেশ। শশীলজের মূল ফটকে রয়েছে ১৬টি গম্বুজ। দেখতে বেশ চমৎকার। শুনেছি, ৩৬টি ঘরের প্রতিটিতেই ছাদ থেকে ঝুলছে ঝাড়বাতি। ভেতরে প্রবেশ করে আরো আশ্চর্য ও আনন্দিত হলাম প্রতিটি ঘরেই রয়েছে ছাদ থেকে ঝুলন্ত একই রকম দেখতে অতি চমৎকার ঝাড়বাতি। সাধারণ বাসভবন ছাড়াও বাড়িটিতে রয়েছে নাচঘর, স্নানঘর। স্নানঘরে রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ। আমাদের মতো যারা দেখতে এসেছিলো, তারা বলাবলি করছিলো যে, এই সুড়ঙ্গপথেই নাকি মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো।

শশীলজের মূল ভবনের সামনে রয়েছে বাগান। সেই বাগানের মাঝখানে আছে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা। চারিদিকে অতি চমৎকার ফুল গাছ। মূল ভবনের পেছনভাগে দেখলাম একটি ঘর। একজন মধ্য বয়সী মহিলা তার ছেলেমেয়েকে বুঝিয়ে বলছেন যে, এটি একটি দোতলা স্নানঘর। এই স্নানঘরে বসে রানী পাশের পুকুরে হাঁসের খেলা দেখতেন। মধ্যবয়সী মহিলার কথা শুনে আমি আশ্চর্য হচ্ছিলাম। মূল ভবনটির পেছনে একচিলতে উঠান। সবুজ ঘাসের আঁচল পাতা সেই উঠান পেরোলেই একটি অপরিসর জলাশয়। জলাশয়ের পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে দুটি জরাজীর্ণ ঘাট থাকলেও দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বিতল স্নানঘাটটির সৌন্দর্য সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ। আমি দেখলাম, পুকুরটির ঘাট মার্বেল পাথরে বাঁধানো। মূল ভবনের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ রয়েছে; তাই সেখানে ছবি তুলতে পারলাম না। কিন্তু পুকুরটির ঘাট অতি চমৎকার মার্বেল পাথরে বাঁধানো। সেখানে দু’একটা ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না।

বাড়িটির আশপাশে দেখলাম, দুষ্প্রাপ্য ও প্রচীন গাছপালা। শুনেছি, এই শশীলজেই ধারণ করা হয়েছিলো হুমায়ূন আহমেদ রচিত বিখ্যাত ধারাবাহিক নাটক অয়ময়-এর পর্বগুলো, যা বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিলো। সেই নাটকে এটি ছিল জমিদারের বাড়ি। মানুষজন বলে থাকেন, এই নাটকের পরিচিতির পরেই স্থানীয়দের কাছে এই বাড়িটি জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

‘বাপরে বাপ! কী সুন্দর বাড়িডা! কী বালা লাগে রে! সামনে, ভেতরে কী সুন্দর দেখায়! এই বাড়ির হলঘরে বাদ্য-বাজনা হইত। নর্তকীরা নাচত। বাড়ির মধ্যে ফোয়ারা, এত যুগ আগে এইডা যে কেমনে চালাইত আমার মাথায় ডুকে না। এতদিন হয়ে গেলো, তবুও কী সুন্দর আছে।’ -কথাগুলো বলছিলেন একজন দর্শনাথী। আর আমিও শুনে বিমোহিত ও আশ্চর্য হচ্ছিলাম।

আমার পরিবার ছাড়াও বেশ কিছু দর্শনার্থীও এসেছেন বাড়িটি দেখতে। আমি কল্পনার দৃষ্টি ফেলে ভবনের দিকে এগিয়ে গেলে কয়েকটি খোলা জানালা আমার চোখে পড়লো। সেগুলো বাতাসে নড়ছে। তা দেখে মনে হলো যে, ভেতরে হয়তো এখনো জমিদারের বসবাস।

যাহোক, দেখা হলো শশীলজ! ঐতিহাসিক একটি বাড়ি দেখা হলো বলে নিজেকে খুব ভাগ্যবান বলে মনে করছিলাম। এতোদিন বইতে পড়েছিলাম; কিন্তু বাস্তবে দেখতে পেয়ে খুবই ভালো লাগছিলো। প্রায় প্রতিদিনই ঐতিহ্যবাহী ‘শশীলজ’ দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসে। দুপুর গড়িয়েছে, পেটে ক্ষিধেও চেপেছে; তাই তাড়াতাড়ি পুনরায় স্বপরিবারে রিক্সাযোগে আত্মীয়ের বাড়ি ফিরে এলাম।