যাকাত প্রদানের গুরুত্ব

মুসাদ্দেক আল আকিব :

 

ইসলামের ৫টি স্তম্বের তৃতীয় স্তম্বই হলো যাকাত। আল্লাহ এবং রসূল (সা.) এর প্রদত্ব শরীয়ার প্রবেশ দ্বার হলো ঈমান। একজন ঈমানদারের শারীরিক ইবাদাতে সমগ্র দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করে নামায। আর আর্থিক ইবাদাতে সমগ্র দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করে যাকাত।

যাকাত প্রদানে আল্লাহর আদেশ :
তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও এবং যারা রুকূ করে তাদের সাথে রুকূ কর। সুরা বাকারা-৪৩

“হে মু’মিনগণ ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি যা ভূমি হতে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর ; এবং উহার নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করার সংকল্প করিও না : অথচ তোমরা উহা গ্রহণ করিবার নও, যদি না তোমরা চক্ষু বন্ধ করে থাক। এবং জেনে রাখ যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।” সুরা বাকারা-৬৭

“শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতার নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা এবং অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। আল্লাহ্ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।” সুরা বাকারা-৬৮

যাকাতের অর্থ :
যাকাত আরবী শব্দ زكوة থেকে গেৃহীত। যার অর্থ পবিত্রতা বা পরিশুদ্ধতা। যাকাতের আরো অর্থ রয়েছে। যেমন বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি ক্রমবৃদ্ধি বরকত, প্রশংসা ইত্যাদী। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় জীবন যাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন পূরনের পর অবশিষ্ট সম্পদ এক বছরকাল অতিক্রম করলে ঐ সম্পদ থেকে আল্লাহ প্রদত্ব নির্দিষ্ট অংশ নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলে।

আল্লাহ বলেন, “হে নবী! তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদকা (যাকাত) নিয়ে তাদেরকে পাক পবিত্র করো, (নেকির পথে) তাদেরকে এগিয়ে দাও এবং তাদের জন্য রহমতের দোয়া করো।” সূরা তাওবাহ-১০৩

যাদের উপর যাকাত ফরয :
প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন সকল মুসলিম নর-নারীর উপর যাকাত প্রদান করা ফরয। যদি সে মৌলিক প্রয়োজনের অধিক (নিসাব পরিমান) সম্পদ বা অর্থ এক চঁন্দ্র বৎসর অতিক্রম করে। তবে তার উপর পূর্ববর্তী এক বৎসরের যাকাত দেয়া ফরয।

যেসব মালে যাকাত ফরয হয় :
১. পশু ও জন্তু সম্পদের যাকাত: উষ্ট্রের সংখ্য ৫-৯ টি হলে =১টি ছাগী, আবার ১০-১৪ টি হলে =২টি ছাগী এবং ১৪-১৯টি পর্যন্ত =৩টি ছাগী। এভাবে পর্যায়ক্রমে গরু-মহিষ কমপক্ষে ৩০টি হলে ১ বছর বয়সী ১টি বাছুর যাকাত ফরয। তবে শর্ত মালিকানায় একবছর অতিবাহিত হওয়া। ছাগল ও ভেড়া কমপক্ষে ৪০টি হতে ১২০টিতে ১টি ছাগী, ১২১টি হতে ২০০টি পর্যন্ত ২টি ছাগী এভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ঘোড়া ও উট পালন করলে তার যাকাত আদায় করতে হবে।

২. স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত: সাড়ে সাত ভরি পরিমাণ স্বর্ণ বা এর তৈরি অলংকার, রৌপ্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি বা এর অলংকার অথবা স্বর্ণ-রৌপ্য উভয়ই থাকলে উভয়েরই মোট মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের সমান হলে, তার বাজার মূল্য ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।

৩. ব্যবসায় পণ্যের যাকাত: ব্যবসায়ের মজুদ পণ্যের মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের মূল্যের বেশী হলে তার উপর ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।

৪. কৃষি সম্পদের যাকাত: কৃষির উৎপন্ন ফসলের ক্ষেত্রে এ যাকাত আদায় করতে হবে তার নাম ওশর। এ ক্ষেত্রে নিসাব হলো, সেচবিহীন জমির ফসলের শতকরা ১০ ভাগ এবং সেচপ্রদানকৃত জমির ফসলের শতকরা ২০ অংশ। আবার নিসাব পরিমাণ ২৬ মন ১০ সের মতান্তরে ৩০ মন না হলে ওশর দিতে হবে না।

৫. মধুর যাকাত: ৫ অসাকের মূল্য হিসেবে মধুর নিসাব ধার্য হবে। অর্থাৎ ৬৫৩ কিলোগ্রাম হলে তাতে ওশর দিতে হবে।

৬. খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদের যাকাত: খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদে এক-পঞ্চমাংশ যাকাত দিতে হবে।

৭. নগদ টাকা ও মজুদ সম্পদের যাকাত: নগদ টাকা বা মজুদ ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের মূল্যামানের বেশী হলে তার ওপর শতকরা ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।

যে সব সম্পদের যাকাত দিতে হয় না :
১. নিসাবের কম পরিমাণ সম্পদ।

২. নিসাব বছরের মধ্যেই অর্জিত ও ব্যয়িত সম্পদ।

৩. ব্যবহার্য সামগ্রী।

৪. শিক্ষা উপকরণ।

৫. ঘর-বাড়ী, দালান-কোঠা যা বসবাস কিংবা কলকারখানা হিসেবে ব্যবহৃত।

৬. যন্ত্রপাতি ও সাজ সরঞ্জাম।

৭. ব্যবহার্য যানবাহন।

৮. ব্যবহার্য পশু, ঘোড়া যেহেতু জিহাদের কাজে ব্যবহার করা হয় আর তা যেহেতু বর্ধনশীল নয় তাই এর উপর কোন যাকাত নেই। আবার ক্রীতদাসের উপরও কোন যাকাত নেই। কারণ রাসূল(সাঃ) বলেছেন, ঘোড়া ও ক্রীতদাসের উপর কোন যাকাত নেই।

৯. ওয়াকফকৃত সম্পত্তি।

১০. পোষা পাখি ও হাঁস মুরগী।

কোন কোন খাতে যাকাত দিতে হবে :
যাকাত ব্যয়ের খাত ৮টি। আল্লাহ বলেন, “সাদাকা তো কেবল নিঃস্ব (ফকির), অভাবগ্রস্ত (মিসকীন) ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য (যাকাত সংক্রান্ত কাজে নিজুক্ত), যাহাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাহাদের জন্য (যাদের মন জয় করা প্রয়োজন), দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রন্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহ্র বিধান। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” সুরা তাওবাহ-৬০
যাদেরকে যাকাত দেয়া যায় না :

যাকাত শুধুমাত্র মুসলিমদের প্রাপ্য। কোনো অমুসলিম যাকাত পাবে না। মুসলিম নামধারী কোনো বে-নামাজি বা প্রকাশ্যে শিরক বা কুফরীতে লিপ্ত থাকে এমন ব্যক্তিকেও যাকাত দেয়া যাবে না। নিজের পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তানদেরকে যাকাত দেয়া যায় না। তবে অগ্রাধীকার ভিত্তিতে নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ভাই, বোন, চাচা, মামা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনকে যাকাত দেয়া যাবে।

যাকাত ইসলামী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রদান করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে মুমিন নিজেই আদায় করবে। উত্তম হলো একক বা একাধিক ব্যক্তির যাকাত একত্রিত করে স্থায়ী দারিদ্রতা বিমোচনমূলক প্রকল্প চালু করা। এর মাধ্যমে যাকাত গ্রহীতা ব্যক্তিকে সচ্ছল করে তোলা।

আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন, আমিন।

১৭ এপ্রিল ২০২০, ২২ শাবান ১৪৪১, ৪ বৈশাখ ১৪২৭