ক্ষুদীরাম দাসের ছোট গল্প : কষ্ট

ক্ষুদীরাম দাস :

কমিল দাদাকে দেখে অনন্ত মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। সাথে সাথে মনের দুঃখটা আড়াল করতে দু’চোখের জল মুছে নিলো তাড়াতাড়ি।

আজ অনন্তের মনটা ভীষণ খারাপ। তার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। এটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অনন্ত খুব স্বাভাবিক হওয়ার ভঙ্গিতে বললো ঃ কমিল দাদা এক কাপ চা খাবেন নাকি?

আজ অনন্তের কথার সুরটা অন্য রকম শোনাচ্ছে। এর আগে কখনো এরকম তাকে দেখা যায় না। সবসময় হাসিখুশিই ছিলো। ফুরফুরে মেজাজে সবার সাথে কথা বলতো। তাই সকলে তাকে খুব ভালোবাসতো। অনন্ত চায়ের কাপগুলো ধুতে ধুতে আবার বললো ঃ দাদা, এককাপ চা বানাবো নাকি?
একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বললো কমিল ঃ বানাওতো ভাই তাড়াতাড়ি!

চায়ের কাপগুলো গরম পানিতে ধুয়ে এককাপ দুধ চা তৈরি করলো। একটা পিরিচের উপর রেখে কমিল দাদার সামনে এনে হাতে ধরিয়ে দিলো। বেশ কিছু সময় নীরব থেকে কমিল চাপ খেতে লাগলো। আর আড়চোখে অনন্তের দিকে বার বার তাকিয়ে দেখছিলো। অনন্তকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার কিছু একটা হয়েছে। এর আগে কখনো তাকে এ রকম মোটেও দেখা যায়নি। চা খাওয়া শেষ করে কাপটা টেবিলের উপর রেখে অনন্তের দিকে তাকিয়ে বললো ঃ অনন্ত, তোমার মনটা খারাপ মনে হচ্ছে!
অনন্ত ঃ হুম! আমার মনটা খুবই খারাপ!
কমিল ঃ কেন?
অনন্ত ঃ মাথায় বাড়ি পরেছে।
কমিল ঃ মাথা ফেটেছে নাকি!
অনন্ত ঃ না।
কমিল ঃ তাহলে কী হয়েছে? তোমার তো মাথা ফাটা দেখতেও পাচ্ছি না। অথচ বলছো তোমার মাথা ফেটেছে?
অনন্ত ঃ আমার বুকটাও ফেটে গেছে। আমি শেষ হয়ে গেছি।আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।
কমিল ঃ তোমার কোনো কথাই আমি বুঝতে পারছি না। তোমার কীসের অভাব আছে বল তো দেখি, তোমার জন্যে কিছু করতে পারি কিনা!
অনন্ত ঃ ভোর ৬টা থেকে এই ছোট দোকানে খেটে মরি; আর রাত এগারটা অথবা বারটার দিকে বাড়িতে যাই, আপনাদের ভালোবাসায় ভালো টাকাই কামাই করি। আমার অভাব থাকবে কেনো?
কমিল ঃ তাহলে সমস্যা কী তোমার?
অনন্ত ঃ চলে গেছে?
কমিল ঃ কে চলে গেছে?
অনন্ত ঃ নীলা চলে গেছে।
কমিল ঃ মানে তোমার বউ নীলা চলে গেছে?
অনন্ত ঃ হুম, সে চলে গেছে দাদা। সে আমায় ছেড়ে চলে গেছে। সে আর আসবে না।
কমিল সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। কমিলের ভাবনার জগৎটা এলোমেলো হয়ে গেছে। এটা কীভাবে হলো, কোনো হলো। কী স্বার্থপর! কী স্বার্থপর! মেয়েটা কী স্বার্থপর! কমিল কিছুতেই ভাবতে পারছে না। বড় কষ্টের পাহাড় কমিলের হৃদয়ে আঘাত করলো। অনন্তের দিকে তাকিয়ে দেখছে তার চোখে জল ঝরছে। মাঝে মাঝে ঘাড়ে থাকা গামছা দিয়ে দু’চোখের জল মুছে নিচ্ছে।
একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে অনন্ত বললো ঃ আমার আর বেঁচে থেকে কী লাভ দাদা!
কমিল ঃ জানি, তুমি বড় কষ্ট পেয়েছো। আমার কথায় তোমার এখন আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে। কারণ, আমিই তোমাকে বলতাম বেশি। আর আমার কথাটাই সত্যি হয়ে গেলো।
অনন্ত ঃ আমি তো এভাবে চিন্তাও করিনি। মনে করেছিলাম, বউকে পড়ালেখা করালে সে জীবনে উন্নতি করবে, আমার সংসার উন্নতি করবে, আমরা ভালো থাকবো। তাই দিনরাত পরিশ্রম করেই যেতাম।
কমিল ঃ তোমার চিন্তা ভালো ছিলো বটে। এতে তোমার কোনো দোষ ছিলো না। তোমাকে এখনো দোষারোপ করি না।
অনন্ত ঃ না দাদা। আপনার কথাটাই ঠিক ছিলো। নীলা তো ম্যাট্রিক পাস করেছে মাত্র। পড়াশোনায়ও ভালো। গরীরবের মেয়ে পড়াশোনা বেশিদূর করাতে পারেনি। আমি কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম আগ্রহ নিয়ে। কিন্তু সে যে এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে সেটা তো আমি ভাবিনি।
কমিল ঃ আমি দুঃখিত! আমি তো তোমাকে মজা করেই কথাগুলো বলতাম। কিন্তু সেই মজার কথাগুলো যে এভাবে সত্যি হয়ে যাবে সেটা তো ভাবিনি কোনোদিন।
অনন্ত ঃ হয়তো মজা করেই বলেছিলেন। কিন্তু আপনার কথাই ঠিক ছিলো।
কমিল মাঝে মাঝেই বলতো অনন্তকে, তুমি তোমার বউকে কলেজে ইন্টারে ভর্তি করিয়েছো। সে কলেজে কী করছে তার খোঁজ খবর নিও। কলেজে যদি সে কারো হাত ধরে চলে যায় তখন তুমি কাঁদবে। তোমার তখন কিছুই করার থাকবে না। এসব কথা শুনলে অনন্ত হাসতো। কিন্তু কোনোদিন সে এটা ভাবেনি যে সেই মজা করে বলা কথাগুলোই একদিন সত্যি হয়ে যাবে। কমিল আর কোনো কথা বলতে চাইলো না। কারণ, তার বলার আর কিছুই নাই। নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছে। তাই কোনো কথা না বলে চাপের বিল পরিশোধ করে উঠে চলে এলো।

দুই.
নীলা অনেকটা বিরক্তির সুরে বলে চেঁচিয়ে বললো ঃ আনিকা শুন, তুই আমার বান্ধবী বলেই আমি তোর কাছে মনের কথাগুলো বলছি। আমার জায়গায় তুই হলে কী করতি। আমি এখন অনার্স পাস করেছি। এখন একজন চা দোকানদারের বউ হয়ে আমি থাকবো নাকি। এটা কি মানায় নাকি।
আনিকা ঃ সেই চা দোকানদারই তো তোকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলো, তাই না। এটা তো কোনোভাবেই তুই অস্বীকার করতে পারবি না।
নীলা ঃ এটা ভাগ্য! আর জীবনটা আমার। সুতরাং সিদ্ধান্তটাও আমার। তাছাড়া মানানসইয়েরও তো একটা বিষয় আছে।
আনিকা ঃ এটা তো যুক্তির কথা হলো না। কিন্তু আমার তো মনে হয়, এটা মোটেও তোর ঠিক হচ্ছে না।
নীলা ঃ তোর কথায় আমার বিবেককে মোটেও নাড়া দিচ্ছে না। তাছাড়া তোর কথা শুনতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না।
আনিকা ঃ তুই এখন যার সাথে চলে গেলি সে তো বেকার।
নীলা ঃ একদিন চাকুরি হবে।
আনিকা ঃ সে কেমন সেটা তো তুই ভাবলি না।
নীলা ঃ সে শিক্ষত এবং ধনী পরিবারের ছেলে।
আনিকা ঃ আর তুই!
নীলা ঃ আমার শিক্ষার যোগ্যতা।
আনিকা ঃ আর সেই যোগ্যতার জায়গায় অনন্তই তোকে নিয়ে এসেছিলো। সেটা ভুলে গেলে চলবে না। একদিন তো তুই তাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলি। তখন তো তোর সবই ভালো লাগতো। আর তোকে পড়ানোর জন্যে দিনরাত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেছে। শুধু তোর জন্যেই!
নীলা ঃ হয়তো করেছে। সেটা তার লাভের জন্যেই।
আনিকা ঃ তাহলে–
নীলা ঃ এখন সেটা তার ভাগ্য! আর জীবনটা যেহেতু আমার, সিদ্ধান্তটাও আমার।
আনিকা ঃ কিন্তু একজনকে এভাবে দুঃখ দিয়ে তুই বাঁছবি কী করে? এটা কি স্বার্থপরতা হয় না?
নীলা ঃ আমাকে আর কোনোদিন এভাবে কথা বলার জন্যে মোটেও ফোন করবি না।

আনিকার অনুযোগ নীলার মোটেও ভালো লাগছিলো না। তাই ফোনটা কেটে দিয়ে রেখে দিলো।

তিন.
কমিল রিক্সা থেকে নেমে দেখলো অনন্তের ছোট চায়ের দোকানটি নেই। পাশের দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলো। তারা বললো-অনন্তের বউ চলে গেছে বলে সেও এখন আর এখানে চা দোকান করবে না। নীলার স্মৃতি তাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। তাই চায়ের দোকানটি আজই সকালে বিক্রি করে দিয়েছে। দোকানের সব মালামাল নিয়ে গেছে। সে আর এখানে থাকবে না বলেছে।

কমিল আর রিক্সায় উঠে ছুটে চললো অনন্তের কাছে। কোথায় থাকতে পারে অনন্ত, অনুমান করে চলে গেলো স্টেশনে। গিয়ে দেখলো, অনন্ত বাসের জন্যে অপেক্ষায় আছে।

রিক্সা থেকে নেমে কমিল বললো ঃ কোথায় যাচ্ছো অনন্ত?
অনন্ত ঃ দূরে দাদার বাড়ি চলে যাচ্ছি।
কমিল ঃ তোমাকে সান্ত¡না দেবার আমার কোনো ভাষা নেই।
অনন্ত ঃ এসব ব্যথার জন্যে সান্ত¡না দেবার কোনো ভাষা থাকে না। এটা আমার দোষেই হয়েছে। সত্যিই আমার উচিত হয়নি তাকে শিক্ষিত করার জন্যে কলেজে ভর্তি করানো। যদিও আপনাদের মজা করা কথা ছিলো, কিন্তু বাস্তবে এটাই সত্যি। বিয়ে তো সমানে সমানেই হয়েছিলো। আর আমি উপকার করতে গিয়ে সবকিছুই অসমান করে দিয়েছি। স্বার্থপরতা হানা দিয়েছে।
কমিল ঃ এখন এখানে দাঁড়িয়ে কিসের অপেক্ষা করছো?
অনন্ত ঃ বাসের অপেক্ষা করছি।
কমিল ঃ তোমার মনের কষ্টের জন্যে আমি দুঃখিত!
অনন্ত ঃ না দাদা, আপনি এভাবে বলছেন কেনো? একটু কষ্ট হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আমার। আপনার সাথে আমার দেখা হবে, যোগাযোগ অবশ্যই হবে। যে চলে গেছে সে তো আমার মন থেকেই চলে গেছে। সুতরাং এখানে বাধা দেয়ার কিছুই নেই। আর সে যেহেতু মনের আনন্দে চলে গেছে, তার জন্যে দুঃখ করে কী লাভ হবে আমার!
একটি বাস এসে থামলে অনন্তের সামনে। পিছনে কমিলের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার দেখা হবে দাদা।

অনন্ত চলে গেলো। ঠিক তখনই রাস্তার অপর দিকে বিপরীত দিক থেকে অন্য একটি বাস এসে থামলো। নীলা বাস থেকে নামলো, সাথে অপরিচিত একজন যুবক। রাস্তার অপর পাশ থেকে কমিলকে দেখতে পেয়ে রাস্তা পার হয়ে আসলো। কমিল সেটা মোটেও খেয়াল করেনি। অনন্তের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো বাসটি যতদূর চোখের আড়াল না হয়। কমিল অনন্তের ব্যাথা উপলব্ধি করতে লাগলো। অনন্তের চায়ের দোকানে গিয়ে আর চা খাওয়া হবে না বন্ধদের নিয়ে আড্ডা দেয়া।

সামনে দাঁড়িয়ে নীলা বললো ঃ কমিল দাদা কেমন আছেন?
কমিল থতমত খেয়ে চেতনায় ফিরে এসে তাকিয়ে দেখলো নীলা দাঁড়িয়ে আছে, সাথে একজন যুবক। বুঝতে আর বাকি রইলো না কমিলের। একজন স্বার্থপর মানুষের সাথে স্বাভাবিক কথা বললে সবকিছু হালকা হয়ে যাবে। তাই মুখটা ঘুরিয়ে কথার জবাব না দিয়ে হেঁটে চললো কমিল।

-সমাপ্ত-