ক্ষুদীরাম দাসের ছোট গল্প : স্মৃতির কষ্ট

তাপসকে দেখেই রবিন চিনতে পারলো। প্রায় দুই যুগ পরেও তাপসের চেহারা একই রকম রয়ে গেছে। তাই তাকে না চিনতে পারার কোনো কারণ নেই। এদিকে তাপসও রবিনকে দেখেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ‘দাদা, দাদা, কেমন আছেন?’ বলেই দৌঁড়ে ছুটে আসলো। তাপর হাত ধরে রবিনকে অফিসে নিয়ে গেলো।

রবিন তাপসের অফিসটা দেখে খুবই পছন্দ করলো। মনে মনে খুবই আনন্দ পেলো যে, এই স্কুলেই এক সময় পড়াশোনা করেছিলাম। আর এখন এখানেই তার চাকুরি হয়েছে। এই জেলায় এই প্রাইমারী স্কুলের বেশ সুনাম রয়েছে। এমন একটি স্কুলে পড়াশোনা করতে পারা বড় ভাগ্যের ব্যপার। এই স্কুলে পড়াশোনা করেছে এমন অনেক ছেলেমেয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভালো ভালো অবস্থানে রয়েছে। এটা ভাবলেই খুবই আনন্দ লাগে মনে।

বিদেশীদের দ্বারা পরিচালিত একটি হোস্টেল ছিলো। সেখানে একশত ছেলে পড়াশোনা করার মতো সুযোগ ছিলো। বিদেশীরা গরীব ছেলেদের এখানে এনে পড়াশোনা করায়। তখন রবিন ও তাপসও একসাথে পড়াশোনা করেছিলো। হোস্টেলের সব ছেলেকেই এই প্রাইমারী স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ ছিলো।

তাপস রবিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে অফিসে গেলো। একটি চেয়ার টেনে বললো ঃ রবিন দাদা, বসেন এখানে।
রবিন অফিসের চারিদিকে তাকিয়ে মুখে হাসি নিয়ে বসতে বসতে বললো ঃ তাপস, তোমাকে দেখে খুবই ভালো লাগছে।
তাপস ঃ এর মধ্যে আপনারও অবদান রয়েছে। একটু হলেও আপনার অবদান রয়েছে।
রবিন ঃ সেটা কী রকম অবদান? আমি তো তোমার জন্যে কিছুই করিনি! কী আশ্চর্য, আমাকে নিয়ে তুমি এসব কী বলছো?

তাপস ঃ হোস্টেল জীবনে কোনোদিন আমাকে আপনি ফিরিয়ে দেননি। যখনই আপনার কাছে অঙ্কের জন্যে গিয়েছি, তখনই আপনি আমাকে সেই অঙ্ক বুঝিয়ে দিলেন। আপনার কাছ থেকে দুঃখ পেয়েছি- সে রকম কিছুই মনেই পড়ছে না। শুধু আমি কেনো, আমার সাথে যারা পড়তো, এমনকি যারা আমার নিচের ক্লাসে পড়তো, তাদের কাউকে আপনি ফিরিয়ে দেননি। আপন ভেবে আপনি অঙ্ক বুঝিয়ে দিলেন। সেটা আমার এখনো মনে আছে।

রবিন ঃ এসব বিষয় আমার মনে নেই। হয়তো আমার ভালো লাগতো, আমি তোমাদের পড়াশোনায় একটু সাহায্য করেছিলাম মাত্র।
তাপস ঃ সেটাই তো অনেক বড় ছিলো। আর এই স্কুলে আমাদের ম্যাডামরাও আছেন। যাদের কাছে আমরা পড়েছিলাম। তারা এখনো এই স্কুলেই চাকুরি করে। আমি খবর পাঠাচ্ছি।

রবিন ঃ আরে থাক, থাক, ওদেরকে ডাকার দরকার নেই। আমি তো আর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই।
তাপস ঃ তবুও দাদা, আপনি এসেছেন তারা জানতে পারলে অনেক বেশি খুশি হবে। অবশ্য আমরা আধা ঘন্টা কথা বলতে বলতে ছুটি হয়ে যাবে। তখন সবই অফিসেই আসবে। সে সময় তাদের সাথে কথা বলা যাবে। থাক তাহলে আমি খবর দিবো না। তারা এসেই আপনাকে দেখবে, আর আশ্চর্য হয়ে যাবে।

রবিন ঃ কোন কোন ম্যাডামকে দেখতে পাবো?
তাপস ঃ তিনজন ম্যাডাম রয়েছেন। আর অন্যরা বয়স হওয়াতে চলে গেছেন। নতুনদের দিয়েই স্কুল চালানো হচ্ছে।
রবিন অফিসের এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিলো। তখনই চোখে পড়লো অফিসের একটি বোর্ডের দিকে। একেবারে অফিসের কোণায় কাঠের তৈরি বোর্ডে সবার উপরে রবিনের নাম লেখা রয়েছে। রবিন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

রবিনের চোখের দিকে নজর পড়লো তাপসের। সে লক্ষ্য করলো রবিন দাদার দৃষ্টি সেই বোর্ডের দিকে চলে গেছে। সেটা বুঝতে পেরেই তড়িঘড়ি করে বললো ঃ বোর্ডে লেখা আপনার নামটা আমি সবসময় দেখি। আর আপনাকে স্মরণ করি। আমাদের হোস্টেলের মধ্যে একমাত্র আপনিই সুনামের সাথে পড়াশোনা করেছেন। ভালো ছাত্র হিসেবে আমাদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। অবশ্য এখনো পর্যন্ত হোস্টেলের কোনো ছেলে আপনার সুনামের পাশে দাঁড়াতে পারেনি।

স্কুলের ঘন্টা বেজে উঠলো। একে একে স্কুলের ম্যাডামরা তাপসের অফিসে আসলো। কোনো শিক্ষকই রবিনকে চিনতে পারছিলো না। কিন্তু ঐ তিনজন ম্যাডামই শুধুমাত্র রবিনকে চিনতে পারলো। নিজের ছাত্রকে সকল শিক্ষকই চিনতে পারে। আর যদি সেই ছাত্র হয় পড়াশোনায় ভালো তাহলে তো কথাই নেই। শিক্ষকের মনে মনে আলাদা দাগ কেটে নেয়।
তিন ম্যাডাম রবিনকে দেখতে পেয়ে খুবই খুশি হলো। সকল শিক্ষক যখন অফিসে আসলো তখন তাপস সকলকেই তাদের স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে রবিনকে পরিচয় করিয়ে দিলো। আর রবিনের সফলতার কথাও সকলের সামনে উপস্থাপন করলো।

একজন ম্যাডাম খুবই গর্বের সাথে বলে উঠলো ঃ আমাদের এই ছাত্র রবিন খুবই ভালো ছাত্র। আমাদের অফিসে যে এতো বোর্ডের নাম রয়েছে তাদের মধ্যে রবিনের নামও রয়েছে। টেলেন্টফুলে বৃত্তি পেয়েছিলো। সে বছর আমরা খুবই গর্ব করেছিলাম। তাকে নিয়ে অনেক আনন্দ করেছিলাম। হোস্টেলের গরীব ছেলেদের মধ্যে সেই একমাত্র টেলেন্টফুলে বৃত্তি পেয়েছিলো।

আরেকজন ম্যাডাম বললো ঃ সে তো আমার ছাত্র ছিলো। আমার ক্লাসেই পড়াশোনা করেছে। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে। সবার চেয়ে ভালো ছাত্র ছিলো। তাই তো সে টেলেন্টফুলে বৃত্তি পেয়েছিলো।

অন্য ম্যাডাম মনের আনন্দে বললো ঃ আমার ক্লাসে সে হয়তো পড়েনি। কিন্তু আমি তাকে প্রাইভেট পড়িয়েছিলাম। সে অবশ্য খুবই ভালো ছাত্র। ভালো ছাত্র হিসেবে সকলের কাছেই সে পরিচিত ছিলো।
তারপর এই কথা সেই কথা বলতে বলতে তাদের আলোচনা একসময় শেষ হলো। সকলেই স্কুল থেকে চলে গেলো। আর এদিকে রবিনের সাথে তাপসের আলোচনা চলতেই থাকলো। তাদের আলোচনা যেন শেষ হতেই চায় না। অবশ্যই দীর্ঘদিন পরে রবিন দাদাকে কাছে পেয়ে মনের যত কথা ছিলো সবই বলে চললো। রবিন তাপসের কথাগুলো শুনেই যাচ্ছিলো। তবে অফিসে এসে যতটা আনন্দ পেয়েছে তার চেয়ে বেশি ব্যথা পেয়েছে কিছু দুঃখজনক স্মৃতি রবিনের মনে পড়ায়। তিনজন ম্যাডাম যেভাবে রবিনের সুনাম করছিলো, ম্যাডামরা বেশ আনন্দের সাথে ও গর্বের সাথেই করছিলো। কিন্তু ম্যাডামরা তো জানতো না রবিনের মনের দুঃসহ জীবনের গল্প। মুহূর্তের মধ্যে রবিনের মুখটা ফ্যাঁকাসে হয়ে গেলো। তাপস দেখলো, রবিনের মুখটাতে আগের মতো আনন্দ নেই। সে ভেবেছিলো, হয়তো ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক কোনো কারণ হয়ে থাকবে। তাই সাহস করে রবিন দাদাকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি।

তাপস চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে বললো ঃ দাদা, চলেন, বাসায় চলেন। আজ দুপুরে আমার বাসায় খাবেন। হঠাৎই এসেছেন, হঠাৎই যা রয়েছে তাই দিয়ে খাবেন। রবিন তাপসের আবদার ফেলতে পারলো না।

খাওয়া দাওয়া সেরে অলস দুপুরে দু’জনে বারান্দায় চেয়ারে বসে আবারো সেই খোশগল্পে মেতে উঠলো। একসময় তাপস জিজ্ঞাসা করলো ঃ রবিন দাদা, আপনার মনটা কি খারাপ লাগছে?
রবিন ঃ হুম, একটু খারাপ লাগছে।

তাপস ঃ কী কারণে? আমাকে বলা যাবে তো!
রবিন ঃ বলা যায়।
তাপস ঃ অবশ্য বলতে না চাইলে বলবার দরকার নেই। কেননা ঐ সময় ম্যাডামরা আপনার প্রশংসা করার পর পরই আপনার মনটা খুবই খারাপ দেখছিলাম। এ কারণে–
রবিন ঃ তুমি ঠিকই দেখেছিলে। ম্যাডামদের কথা শুনতে শুনতে আমার হোস্টেল জীবনের বেশ কিছু কষ্টের স্মৃতি মনে পড়ে গেলো।

তাপস দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বললো ঃ সেটা অবশ্য জানি দাদা। কিন্তু আমরা তো তখন ছোট ছিলাম, আমাদের কিছুই করার ছিলো না। তবে আমরা বুঝতে পারতাম, আর মনে মনে কষ্টও পেতাম। আপনার জন্যে আমারও খুবই খারাপ লাগতো।

রবিন ঃ তোমরা হয়তো মনে করতে পারো যে, আমার টেলেন্টফুলে বৃত্তি পাওয়াটা কতটা সুনামের ও গৌরবের ছিলো। কিন্তু এই সফলতা আমার জীবনের জন্যে অভিশাপ নিয়ে এসেছিলো। সেই অভিশাপ আমার জীবনকে তছনছ করবার জন্যে যথেষ্ট ছিলো। যাদের উপর আমি বিশ^াস করে থাকতাম তারাই আমার উপর হিংসা করেছিলো। বন্ধু বলে কেউ ছিলো না। যাদের সাথে বন্ধুত্ব ছিলো, আস্তে আস্তে তারাও হিংসায় জ¦লে উঠলো। এটা কী এমন সফলতা ছিলো যে, তাদের উপরে উঠে গেলাম। আর তারা আমাকে নিচে নামানোর জন্যে হিংসার দাবানলে জ¦লতে জ¦লতে উঠতে বসতে আমাকে আঘাত করেছিলো।

তাপস ঃ দাদা বুঝতে পারছি আপনার মনে অনেক কষ্ট আছে।
রবিন ঃ একটা চারা গাছের উপর যদি এভাবে নির্যাতন করা হয় তাহলে সেই গাছ থেকে কেমন ফল আশা করা যায়? একদিন গাছের পাতা ছিঁড়লো, একদিন ডাল মচকে দিলো, আরেকদিন লাঠি দিয়ে আঘাত করলো; তাহলে সেই আঘাত তো সেই গাছের চিহ্ন হিসেবে দীর্ঘদিন থাকবেই। সেই গাছ থেকে কীভাবে ভালো ফল আশা করা যায়?

তাপস ঃ দাদা, ওরা আপনার পড়াশোনার জন্যে হিংসা করতো। আপনি টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন তাই তারা আপনার উপর হিংসায় জ¦লেপুড়ে জ¦লতো। আর আপনার উপর নির্যাতন করেছিলো।

রবিন ঃ হুম। আমার এখনো মনে পড়ে। যেদিন রেজাল্টটা আমার কানে এসেছিলো সেদিনই হোস্টেলের অনেক ছেলেদের মনের মধ্যে হিংসা জেগে উঠেছিলো।
তাপস ঃ আপনার বন্ধু; আর আপনার সহপাঠীরাই বেশি হিংসা করেছিলো।

রবিন ঃ আর তারাই তো অন্যদের লেলিয়ে দিয়েছিলো। যেন আমার পড়াশোনায় ক্ষতি হয় সেজন্যে আমার বই খাতা লুকিয়ে রেখেছিলো। আমার পড়ার সময় বিরক্ত করেছিলো। কথায় কথায় খারাপ আচরণ করতো। ঘটনা তৈরি করে দোষারোপ করার ফন্দি করতো। মুখের ভাষায় অনেক খারাপ আচরণ করেছিলো, যার বর্ণনা করা অসম্ভব।

তাপস ঃ এটা পাপ কাজ। এজন্যেই আমরা জগতে সুখী হতে পারি না। আপনি নীরবে সবই সহ্য করলেন। কারণ, এছাড়া আর উপায় ছিলো না। কোনো এক অজানা কারণই আপনাকে কোণঠাসা করে রেখেছিলো।
রবিন ঃ হুম! তাই আমি বলতে চাই, এমন সফলতার দরকার নেই। যে সফলতায় মানুষের জীবনের সুখ কেড়ে নেয়, নিরাপত্তা কেড়ে নেয় সে রকম সফলতা না হলেই তো ভালো।

তাপস ঃ দাদা, দেখবেন ওরা কোনোদিনই সুখী হতে পারবে না। ওরা যখন আপনার উপর হিংসা করতো তখন তাদের হৃদয়টাও খান খান হয়ে যেতো। কারণ, তারাও তো মানুষ ছিলো। যদিও তারা তখন অমানুষের মতো আচরণ করেছে; কিন্তু তাদেরও বিবেক জ¦লেপুড়ে ছাই হতো। যারা হিংসা করে, তাদেরও সুখ নষ্ট হয়, তারাও কষ্টে মরে, জ¦লন্ত অগ্নিশিখা তাদেরও জ¦ালিয়ে জ¦ালিয়ে এগিয়ে যায়। তারা প্রতিনিয়ত পুড়তে থাকে। যারা হিংসা করে তারা সুখী হয় না কোনোদিনই। একদিন হলেও তাদের সেই স্মৃতিগুলো তাদের কষ্টের জায়গায় নিয়ে যায়।