রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়, আমার প্রিয় বিদ্যালয় (সব পর্ব একসাথে)

অধ্যাপক মোজাম্মেল হক চৌধুরী মোহন :

প্রথম পর্ব :

আমি ১৯৬৫-১৯৭০ সাল পর্যন্ত রামপুর উচ্চ বিদ্যালয় এর ছাত্র ছিলাম। আমি পরবর্তীকালে অত্র বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির বিদ্যুতসাহী সদস্য এবং দুবার সভাপতি ও ছিলাম বিদ্যালয় এর সভাপতির চেয়ে ছাত্র জীবনের স্মৃতি টাই অনেক বেশি স্মৃতিবহুল এবং অনেক বেশি গর্বের।

ছাত্র হিসেবে আমি এই বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাটের জন্য আমার সহপাঠিদের নিয়ে মাটি কাটার কাজে অংশগ্রহণ করি। তাদের মাঝে উল্ল্যেখযোগ্য আনোয়ার হোসেন মল্লিক, এডভোকেট কাইয়ুম চৌধুরী, এডভোকেট হোসেন মজুমদার, মোস্তাফিজ মজুমদার, ইকবাল তালুদার, মজিবুর রহমান মজুমদার, হারুন মোক্তার,রশিদ সরদার প্রমুখ।

এই বিদ্যালয়ের ভবন তৈরীতে রামপুর মাদ্রাসার মাঠ থেকে লেইজার পিরিয়ড এ দুটো করে ইট আনা সবার জন্য বাধ্যতামূলক কাজ ছিল।সেখানেও আমার প্রতিনিয়ত অংশগ্রহণ ছিল।

ছাত্র হিসেবে শিক্ষকদের সান্নিধ্যের কথা যদি কিছু না বলি তাহলে রামপুর উচ্চ বিদ্যালয় এ লেখাপড়া করার স্বার্থকতা কোথায়? ছাত্র হিসেবে আমি সান্নিধ্য পেয়েছি এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জুনাব আলী তালুকদার সাহেবের। বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে নিজ বাড়ির ধান মাথায় বহন করে রামপুর বাজারে বিক্রি করে শিক্ষকদের বেতনের কিছু অংশ দেওয়ার দৃশ্য ও আমি প্রত্যক্ষ করেছি। আমি আরো সান্নিধ্য পেয়েছি প্রখ্যাত প্রধান শিক্ষক এবং বিখ্যাত ” চাইল্ডস ইজি গ্রামার ” এর রচয়িতা মরহুম এম. ইদ্রিস বিএ,বিটি সাহেবের এবং তার সহোদর মরহুম বজলু গণি মজুমদার সাহেবের। তবে আমার প্রিয় প্রধান শিক্ষক ছিলেন গোয়ালভর নিবাসী জনাব মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ। যিনি পরবর্তী কালে কাস্টমস এর কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন।প্রিয় প্রধান শিক্ষকদের মাঝে অসুস্থ অবস্থায় আজো বেঁচে আছেন পালিসারা নিবাসী জনাব মোহাম্মদ মহিউদ্দিন।আমি স্যারের সুস্থতা কামনা করি।

শহিদুল্লাহ স্যার এবং মহিউদ্দিন স্যার শুধু বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষক ই ছিলেন না।দুজনই আমার ছাত্রজীবনের মেন্টর ছিলেন। শিক্ষা জীবনে প্রায় দুই বছর এই দুজনের সাথে একই কক্ষে অবস্থান এবং একই হাড়ির ভাত খাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল (সাবেক প্রাইমারির দোতালার কক্ষটিতে)।

শিক্ষকদের মাঝে এখনো যারা হৃদয়ের মণিকোঠায় বেঁচে আছেন, তাদের মাঝে উল্ল্যেখযোগ্য হলেন, বাবু মাধব চন্দ্র ভৌমিক।আমি নবম শ্রেনীর ছাত্র যখন, তিনি শ্রেনী কক্ষে আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন –

“চপরতবর্ষীকলা কুটিকাটি মাটি হেলা, গায়ে হলুদ হদুমালা, দাপুড় দুপুড় যায়।তারে দেখে চন্দ্রকলা ফুকি দিয়ে চায়।”

এটি কি?আমরা কেউ সেদিন পারি নাই।
আপনারা কি কেউ জানেন?

মনে পড়ে, প্রফুল্ল কুমার শীল, পুনীল বিহারী সাহা, চাঁদপুর এর ডি এল পাল, তাপস স্যার, মাতৈন এর সিরাজ স্যার,সোলায়মান স্যার,নুরুল ইসলাম স্যার,আব্দুল খালেক স্যার,আব্দুর রশীদ স্যার সহ অনেকের কথা। এদের মাঝের অনেকেই আজ প্র‍য়াত। প্র‍য়াত সকল স্যারদের আত্মার শান্তি কামনা করি এবং জীবিতদের সুস্থতা কামনা করি।

সভাপতি কালীন সময়ের প্রধান শিক্ষক জনাব সৈয়দ আহমেদ আজো বেঁচে আছেন।ঐ সময়ের জনপ্রিয় শিক্ষকদের অন্যতম জনপ্রিয় আলী নওয়াজ স্যার বেঁচে নেই।স্কুলের প্রতি তার মমত্ববোধ ও দায়িত্বশীলতার কথা আজও মনে পড়ে।

সেই প্রাণ প্রিয় প্রতিষ্ঠানের যখন কোন সুসংবাদ পাই আনন্দে বুকটা ভরে উঠে। তেমনি যেকোন অপ্রীতিকর সংবাদে হৃদয় ব্যাথিত হয়ে ওঠে। রামপুর উচ্চ বিদ্যালয় এর দুঃসংবাদ এর চেয়ে সুংসবাদ ই আজীবন প্রত্যাশায় থাকবে। (চলবে)

 

(দ্বিতীয় পর্ব)

প্রথম দিনের লেখাতেই ভেবেছিলাম প্রিয় বিদ্যালয়ের উপর লেখা সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু, না। ঐ লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর, আমি উপলব্ধি করলাম আমার মত এই বিদ্যালয়কে অগণিত মানুষ ভালোবাসে। যাদের অনেকেই এশিয়া,ইউরোপ এবং আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছে। তাদের অনেকের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা এবং অনুরোধের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় পর্ব হিসেবে আজ আবার লিখতে বসলাম।

রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়টি ১৯৬৬ সালে জুনিয়র হাইস্কুল থেকে পূর্নাঙ্গ হাই স্কুলে রূপান্তরিত হয়৷১৯৬৮ সালে এসএসসি পরিক্ষায় সর্বপ্রথম অংশগ্রহণ করে। আজকে রামপুর স্কুল এক বিশাল কাঠামোর উপর অবস্থিত। এ অবস্থান তো একদিনে হয় না। এই বিদ্যালয়টি যাদের সম্পদ এবং দানের উপর আজকে এই পর্যায়ে এসেছে তাদের সংখ্যাও নেহায়েত কম না। উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের কথা যদি স্মরণ না করি তাহলে ইতিহাস হয়ত আমাকেও ক্ষমা করবে না। প্রয়াত জমিদার রামপুর গ্রামের বাবু যজ্ঞেশ্বর রায় চৌধুরী তাদের অন্যতম। তার ও আগে সম্পদ দিয়ে যারা এই বিদ্যালয়টি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছিলেন তারা হলেন বিদ্যালয়ের উত্তর পার্শস্থ মালিবাড়ির হরে কৃষ্ণের পূর্ব পুরুষগণ।

তাদেরই উত্তরসুরীর কানু নামের একজন আজও বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কর্মরত। এদের কথা হয়ত অনেক আগেই স্মৃতি থেকে বিলীন হয়ে গিয়েছে। ভূমিদাতাদের মাঝে বিশেষভাবে আরো যারা উল্লেখযোগ্য তারা হলেন মরহুম আব্দুল আজিজ সরদার, তার পত্নী মরহুমা ফরিদেন্নেসা বেগম এবং মরহুম হাফিজ উদ্দিন ব্যাপারী (রা.প্রা.বি)।
প্রথম পর্বের লেখায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে লেখা যথেষ্ট ছিল না। উল্লেখযোগ্যদের অনেকের কথাই সেদিনের লেখায় স্থান পায় নি। যা আজ লিখছি। আমার সভাপতি কালীন সময়ের উল্লেখযোগ্য শিক্ষকদের মাঝে প্র‍য়াত জগদীশ সাহা, অমলেন্দু বাবু, ধীরেন্দ্র সাহা, হাবিবুর রহমান হাবিব, আব্দুল হক সহ অনেকের কথাই আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে। মনে পড়ছে বিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া সহপাঠী আব্দুল আউয়াল পাটোয়ারী এবং ছোটভাই তুল্য মৈশাইদের শাহ আলম মজুমদারের কথা। ভাই বলে সম্বোধন করতাম এবং একই টেবিলে বসে রাজনীতি সমাজ নীতির চর্চা করতাম প্রয়াত ওসমান গনি মজুমদারের কথা। আমার সময়কার শিক্ষকদের মাঝে আজও বেঁচে আছেন ধর্মীয় শিক্ষক নওহাটার মাওলানা আব্দুস সাত্তার এবং আমার বিদায়ের বছর যোগাদানকারী শিক্ষক সাঈদ স্যার ও সিদলার তাফাজ্জল হোসেন স্যার। সাঈদ স্যারের মত এত ঠান্ডা মেজাজের শিক্ষক আমি আমার ছাত্র এবং শিক্ষক জীবনে কমই দেখেছি।তিনি এবং সহপাঠী আউয়াল স্যার সহ আমি ২০১৫ সালে পবিত্র হজ্জব্রত পালন করি। আল্লাহ পাক আমাদের হজ্জ কবুল করুক।আরো বিশেষ ভাবে মনে পড়ে মাওলানা আব্দুস সাত্তার স্যারের কথা। কথিত ছিল যে, তিনি এতই বেশি উদার ছিলেন যে প্রশ্নের অতিরিক্ত প্রশ্নের উত্তর লিখলেও নম্বর দিতে কার্পন্য করতেন না। যার ফলশ্রুতিতে মাঝে মাঝে কেউ কেউ ১০০ তে ১১০ নাম্বার ও পেয়ে যেত। এই ধারা আমাদের পরবর্তী সময়েও অক্ষুন্ন ছিল কিনা তা আমার জানা নেই। শ্যামাবাবু নামের একজন শিক্ষক কতই না যত্নের সহিত ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন সে কথা আজ ও মনে পড়ে। মনে পড়ে, সৈয়দপুরের খণ্ডকালীন শিক্ষক প্রয়াত আবুল বাশার মজুমদার বিএসসি, ওরপুরের আব্দুর রশিদ বিএসসি, সৈয়দপুরের হাবিব পাটোয়ারী এবং রুহুল আমিন মাস্টার সাহেবের কথা। স্কুলের প্রয়োজনে জুনাব আলী মাস্টার সাহেবের বিশেষ অনুরোধে এরা পর্যায়ক্রমে স্কুলকে শিক্ষক হিসেবে সেবা দিয়েছেন।

এতক্ষন তো শুধু শিক্ষকদের কথা ই লিখলাম, ছাত্র জীবনে আমিও শুধু শিক্ষক ই পেয়েছিলাম, কোন শিক্ষিকা পাই নি। কিন্তু, সভাপতি পদে থাকা অবস্থায় দুজন শিক্ষিকা পেয়েছিলাম। একজন হাসিনা আক্তার এবং অন্যজন আফরোজা বেগম। প্রথমজনের সাথে আমার তেমন কোন কথা না হলেও দ্বিতীয় জনের সাথে মাঝেমাঝে কিছু কথা হত।দুজনকেই আমি ভালো শিক্ষিকা হিসেবে জানতাম। ইতিমধ্যে হয়ত শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষিকার সংখ্যাও বেড়েছে, সবাই স্ব স্ব কাজে অনেক বেশি যত্নবান এবং স্কুলকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করবেন এই প্রত্যাশাই থাকবে আমার।
যেহেতু আমি বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলাম তাই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আমার পূর্ববর্তী দীর্ঘ সময়ে যারা বিদ্যালয়কে সেবা দিয়েছেন তাদের কথা একটু স্মরণ করতে হয়। আমি যতটুকু দেখেছি এই বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের মাঝে প্রাচীন এবং প্রবীনদের মাঝে উল্ল্যেখযোগ্য হলেন সিদলা নিবাসী মরহুম কফিলউদ্দিন মজুমদার, মারামুরা নিবাসী ডাক্তার ইউসুফ আলী মজুমদার মৈশাইদ নিবাসী সামসুল হক মজুমদার (ম্যানেজার), নওহাটার আবদুল হাই সরদার (জীবন বীমা) এবং মারামুরার আলহাজ্ব জয়নাল আবেদীন মজুমদার অন্যতম। পরবর্তী কালে স্কুল পরিচালনায় বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন আবুল হোসেন সরদার (ওরপুর), আবুল বাশার মেম্বার, কামাল হোসেন মজুমদার (সিদলা) আমিনুল হক মজুমদার (মৈশাইদ) এবং রফিকুল ইসলাম ভুইয়া (গোয়ালঘর) সহ আরো অনেকে। এরপর দায়িত্বে আসেন আশরাফ উদ্দিন দুলাল পাটোয়ারী, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, খোরশেদ মাস্টার, সিরাজ মজুমদার, মানিক তালুকদার পর্যায়ক্রমে আনোয়ার মল্লিক, আনোয়ার উল্লাহ পাটোয়ারী, আলহাজ্জ হেলাল উদ্দিন মিজি, হাবিবুর রহমান লন্ডনী, মো. সেলিম লন্ডনী এবং ডাক্তার শাহনেওয়াজ সহ আরো অনেকে।

আমি যখন বিদ্যালয়ের বিদ্যোৎসাহী সদস্য ছিলাম তখন সভাপতি ছিলেন মরহুম জয়নাল আবেদীন মজুমদার। পরবর্তীতে আমি যখন সভাপতি হই তখন সহ সভাপতি ছিলেন জনাব আলহাজ্জ হেলাল উদ্দিন মিয়াজি এবং পরবর্তী সভাপতির কালে সহ সভাপতি ছিলেন সদ্য প্র‍য়াত আলহাজ্জ আনোয়ার হোসেন মল্লিক। প্রথম পর্ব যখন লিখি তখন তিনি জীবিত ছিলেন কিন্তু আজ তিনি নেই। রামপুর বিদ্যালয়ের যে প্রবেশদ্বার টি বিদ্যমান, এর নির্মাণে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই ফটকটির নির্মাণের অনুপ্রেরণার কারিগর ছিলেন প্র‍য়াত প্রিয় শিক্ষত আলী নওয়াজ স্যার আর অর্থায়নে ছিলেন বাবু বিনয় কৃষ্ণ সাহা। আমার সভাপতি কালীন সময়কার সহকর্মীদের আন্তরিক সহযোগিতার কথা মনে পড়ায় তাদের প্রতি আজ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। যা কিছুই করেছি আমরা, ঐক্যমতের সাথেই করেছি।পরবর্তীকালে হেলাল উদ্দিন মিজি স্কুলের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে খোরশেদ মাস্টার এবং অন্যান্যদের সহযোগিতায় বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন করেন। কালের সাক্ষী হিসেবে যা অনেক দিন অক্ষুণ্ণ থাকবে। একসময়ে স্কুলের সভাপতির দায়িত্বে আসেন আমার আত্মার পরম আত্মীয় মরহুম আমিনুল হক মজুমদার সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্র মামুন মজুমদার এবং তার সাথে সদস্য হিসেবে উল্ল্যেখযোগ্য রামপুরের জাকির (মেঘনা) এবং মমিন ভুইয়া। তারাও তাদের সাধ্যানুযায়ী স্কুলের সুনাম বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন।

বর্তমানে কমিটিতে আছেন সভাপতি হিসেবে স্নেহধন্য আনিসুল ইসলাম মজুমদার সহ উদ্যমী ও প্রতিশ্রুতিশীল বেশ কয়েকজন। তাদের সময়কাল শেষ হওয়ার পরেই তাদের সম্পর্কে প্রকৃত মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে।

 

(শেষ পর্ব)

প্রিয় বিদ্যালয়কে নিয়ে লিখা তিন পর্বের আজ শেষ পর্ব। শেষ পর্ব লিখার শুরুতেই মনে হচ্ছে দ্বিতীয় পর্বে যেন অনেক কিছুই অসমাপ্ত রয়ে গেছে। তা তো থাকবেই। কারণ, ১৯৬৬-২০২০ পর্যন্ত এই দীর্ঘ ৫৪ বছরের ঘটনাপঞ্জি এই ক্ষুদ্র প্রয়াসের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা দেওয়া সম্ভব না। তাই, অনিচ্ছাকৃত অনেক ভুল ত্রুটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।

ম্যানেজিং কমিটি সম্পর্কে দ্বিতীয় পর্বে অনেক কিছু লিখার পরেও অনেক কিছুই বাকী রয়ে গেছে। তাদের মাঝে সৈয়দপুরের আলী আকবর মাস্টার এবং বারে বারে বিপুল ভোটে নির্বাচিত অভিভাবক প্রতিনিধি, রামপুর বিদ্যালয়ের ছাত্র ও আমার প্রিয় ছাত্র টুকু মজুমদার, আরেক প্রিয় ছাত্র আব্দুর রহমান মোল্লা, নওহাটার শাহজাহান গাজী, মরহুম রুহুল আমিন মাস্টার সাহেব উল্লেখযোগ্য।

চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মাঝে মরহুম সেকান্দর মিয়া আজ নেই। তার কর্মকান্ডের কথা স্কুল সংশ্লিষ্টদের মাঝে কার না জানা। একাধারে সে ছিল পিয়ন, নৈশপ্রহরী ও মেরামতকারী। যেজন্য তাকে অনেকেই নাম ধরে না ডেকে ‘মিস্ত্রি’ বলেই ডাকত। সে আমাক মামা বলে সম্বোধন করত। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে একজনের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সে হলো নওহাটার আক্কাস মেম্বার। কর্মচারী হয়েও একাধিক বার ইউপি মেম্বার হওয়ার সুযোগ তার হয়েছে। আরও মনে পড়ে, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রামপুর গ্রামের মোস্তফা ব্যাপারীর কথা। কমিটিতে থাকাকালীন অবস্থায় তার কাজের সততায় আমি তার প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলাম। একটি বিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি রক্ষায় এই কর্মচারীদের ভূমিকাও কম নয়।

১৯৬৬ থেকে ২০০০ সাল, অনেক স্মৃতি, অনেক আন্দোলন, অনেক সংগ্রাম ও একটি ইতিহাস। স্মরণীয় ইতিহাস, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। যেই যুদ্ধে রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অকল্পনীয়। যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের মাঝে উল্ল্যেখযোগ্য আনোয়ার হোসেন মল্লিক, নওহাটার জয়নাল আবেদীন, আব্দুল আউয়াল মাস্টার মার্কির আব্দুল খালেক, মোহাব্বতপুরের মোবারক, নওহাটার গাজী শাহজাহান, মাড়ামুড়ার আব্দুর রব পাটোয়ারী, ওরপুরের বাশার, এবি সিদ্দিক (খোকা), আমার গ্রামের শহিদুল্লাহ ও মফিজ সরদার, লোদপারার আবু বকর, আব্দুর রশিদ, সিরাজুল ইসলাম এবং তার সহোদর শহীদ জয়নাল অন্যতম। ডেপুটি কমান্ডার হাজীগঞ্জের বিএম মহসিন (নয়ন ভাই) ও রামপুর বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন।

১৬ ডিসেম্বরের ৮ দিন আগে, যেদিন হাজীগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয় ওই দিনই শত্রু পলায়নকালে বুলেটের আঘাতে জয়নাল শহীদ হন। জয়নালের এই আত্মত্যাগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসে স্মরণীয় এবং যা রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাস কেও গৌরবান্বিত করেছে। মার্কির খালেক শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, স্থানীয় ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রশিক্ষকের ভূমিকাও পালন করেন তিনি। মরহুম নুরুল ইসলাম মিলিটারির সাথে লোদপারা ও শাকছিপারার গভীর অরণ্যে আমার প্রশিক্ষক ও ছিলেন খালেক।

শুধু মুক্তিযুদ্ধ কেন, সামাজিক-রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে রামপুর বিদ্যালয়ের ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল স্মরণ করার মত। স্বাধীনতাত্তোর কালে পরপর দুইবার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আমাদের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক আলহাজ্জ জুনাব আলী তালুকদার। চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি কতটুকু করতে পেরেছেন বা পারেননি সে আলোচনার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তবে, রামপুর স্কুলের প্রতিষ্ঠায় তার অবদান এবং ছাত্র ছাত্রীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা তার চেয়ারম্যান হওয়ার পিছনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে দুই মেয়াদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আবু নসর পাটোয়ারী এবং একবার মোহাম্মদ হোসেন মোল্লা। উল্লিখিত দুইজনের সাথে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাদের মাঝে উল্ল্যেখযোগ্য আনোয়ার হোসেন মল্লিক, আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া এবং ওড়পুরের জিয়াউর রহমান জিয়া। এরা তিনজনই রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রাক্তন ছাত্রদের মাঝে চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন হাজীগঞ্জ সদরে মামুন মজুমদার এবং ৭নং বড়কুল পশ্চিমের মোহাম্মদ জামাল ভুইয়া।

লেখা প্রায় শেষ পর্যায়ে, লেখার শুরুতে লিখেছিলাম সভাপতির চেয়ে ছাত্রজীবনই ছিল সবথেকে গৌরবের। সেই গৌরবমাখা অধ্যায়ের কিছু কথা এবং বিদ্যালয়কে যারা গৌরবান্বিত করেছে সেসকল মেধাবী, কীর্তিমান ও খ্যাতিমান ছাত্রদের কথা এ পর্যায়ে তুলে ধরছি। ১৯৬৮ সালে রামপুর উচ্চ বিদ্যালয় এসএসসি পরিক্ষায় প্রথম অংশগ্রহণ করে। বরাবরই ষষ্ঠ থেকে দশম পর্যন্ত প্রথম স্থান অর্জনকারী কালঁচো গ্রামের মনিরুজ্জামান এসএসসি পরিক্ষায় ও সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়।

উল্লেখযোগ্য উত্তীর্ণদের মাঝে আবিদ আলী ভুইয়া, প্রয়াত খোরশেদ মাস্টার, কালঁচোর খলিল ভাই, মুক্তিযোদ্ধা রব ভাই, সৈয়দপুরের প্র‍য়াত আবুল বাশার, গোসাইপুরের শাহজাহান, আমার বড় ভাই আনোয়ার হোসেন চৌধুরী উল্লেখযোগ্য। পরের বছর দুইজন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। একজন কুমিল্লা বাগমারার মাহাবুব আলম এবং অন্যজন মিজানুর রহমান তালুকদার। মিজান ভাই পরবর্তীকালে কাস্টম কর্মকর্তা হয়ে বর্তমানে অবসরে আছেন। তৃতীয় ব্যাচটি হল আমাদের ব্যাচ (১৯৭০)। অনেক মেধাবী থাকা স্বত্তেও প্রথম বিভাগে একজনই উত্তীর্ণ হয়। তিনি ভাজনাখাল মিয়া বাড়ির শামসুল আলম মিয়া। সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হয়ে তিনিও বর্তমানে অবসরে আছেন। এই ব্যাচে মেধাবীদের মাঝে অন্যতম তুষার কান্তি সাহা, আব্দুল ওয়াহাব এবং আউয়াল পাটোয়ারী।

স্বাধীনতাত্তোর প্রথম ব্যাচ থেকে আজ পর্যন্ত উল্ল্যেখযোগ্য যারা তাদের মধ্যে লোদপারার মোশাররফ হোসেন মশু (ইঞ্জিনিয়ার), কাইয়ুম চৌধুরী (আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট), শাহজাহান মজুমদার (অতিরিক্ত পিপি, জজকোর্ট, ঢাকা), প্রবাস চন্দ্র সাহা ( ডিজি, ডাকবিভাগ), সৈয়দপুরের শাহজাহান মজুমদার, মারামুরার হোসেইন মজুমদার ( বিশিষ্ট আইনজীবি হিসেবে কর্মরত, ঢাকায়), ভাটোরার আবুল বাশার বাচ্চু ভাই (ব্যাবস্থাপক, সোনালী ব্যাংক) ও ভাজনাখালের মালেক মিয়া (ব্যবস্থাপক, সোনালী ব্যাংক) অন্যতম।

পরবর্তীতে ছাত্রদের মাঝে কর্মজীবনে যারা উল্লেখযোগ্য অবস্থানে পৌছেছে তাদের মাঝে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য মারামুরার প্রয়াত আবু বকর সিদ্দিক (পুলিশ সুপার), প্রয়াত হাবিবুর রহমান (ডাক্তার), শিহিরচোরের নুরুল ইসলাম (ব্যাংকার, ডিএমডি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক), মিজানুর রহমান তালুকদার (ভাইস প্রেসিডেন্ট, এসআইবিএল), ব্যাচ ৯১’র মোহাম্মদ দিদার হোসেন (বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবস্থাপক সাবেক পেট্রো বাংলা), লোদপারার শাখাওয়াত হোসেন রাজন (বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার), লোদপারার আলামিন ও আব্দুস সাত্তার। এরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।

খ্যাতিমানদের মাঝে মতলবের ডাক্তার প্রফেসর শাহ জামাল খান (এনাম মেডিকেল), কালঁচোর আবুল বাশার মজুমদার (বিআরডিবি, কুমিল্লা, ব্যাবস্থাপক), মতলবের হাসান মাহমুদ খান (শাবিপ্রবি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা), মারামুরার আজাদ মজুমদার (বাংলাদেশ বিমান), ভাটোরার আলমগীর পাটোয়ারী (অধ্যক্ষ, আইডিয়াল ল কলেজ), শাহাদাত হোসেন (বাংলাদেশ বিমান), ধড্ডার মোশাররফ হোসেন খোকন (টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার), কালঁচোর মিজানুর রহমান (সহকারী অধ্যাপক, ফেনী সরকারি কলেজ), মঞ্জুর হোসেন (কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার), মাতুইলের মানিক ( ব্যাংকার) ও মিল্টন ( অধ্যাপক, হাজিগঞ্জ মডেল কলেজ)।
এরপর রামপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাশ করে যারা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে তাদের মাঝে ওরপুরের শফিকুল ইসলাম ২৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে সমবায় একাডেমি কুমিল্লাতে কর্মরত, জাবের মোহাম্মদ শোয়াইব ৩৪ তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমান এসি ল্যান্ড, দিনাজপুরে আছে এবং তার সহোদর ডাক্তার আবুল কাশেম ৩৯তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে মাধবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত। শেষোর্ধ দুজনই ওরপুরের সাইফুল ইসলাম সিরাজ মোক্তারের গর্বিত সন্তান। ওরপুরের আরেক কৃতি সন্তান ডাক্তার নাজমুল হক, চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত। তার বাবা প্রয়াত আব্দুল মান্নান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হয়েও শিক্ষার প্রতি যে অনুরাগ দেখিয়েছে তা সকলের কাছেই অনুকরণীয়।

এতক্ষণ কেবল কীর্তিমানদের মাঝে যারা সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে অবস্থান করছেন তাদের কথা লিখেছি। এই পর্যায়ে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মাঝে যারা দেশে এবং দেশের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছেন তাদের কথা তুলে ধরছি।

বুয়েট থেকে ডিগ্রি নিয়ে আলমগীর বর্তমানে আমেরিকায় প্রবাসী। আমেরিকায় আরো আছে মাড়ামুড়ারশাহাদাত হোসেন মজুমদার , মৈসাইদের মামুন মজুমদার, তার বোন লিলি ও রিনা, মৈসাইদের বাদল মজুমদার, হাবিব লন্ডনীর ছেলে মামুন চৌধুরীসহ আরো অনেকে। লন্ডন প্রবাসী হিসেবে আছে জুনাব আলী তালুকদার সাহেবের বড় ছেলে মাহমুদ তালুকদার, হাবিব লন্ডনীর ছেলে মাসুদ চৌধুরী ও তার বোন জান্নাত, ওরপুরের খোরশেদ মাস্টারের ছেলে হান্নান (লন্ডন পুলিশ বাহিনীর গর্বিত সদস্য), ভাটোরার আব্দুল মালেক এবং ভাজনাখালের সহপাঠী জলিল সহ আরো অনেকে।

কানাডায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে আছে সৈয়দপুরের মরহুম আব্দুল হালিম তালুকদারের দুই সন্তান জসিম ও আমার প্রিয় ছাত্র জাফর। ব্যবসায়ী হিসেবে তো অনেকেই সফলতা লাভ করেছে তাদের মাঝে আলহাজ্ব হেলাল উদ্দিন মিজি, মণিপুর প্রোডাক্টস-এর স্বত্ত্বাধিকারী মোস্তফা কামাল পাটোয়ারী, ঢাকা উড হাউজের মালিক মোস্তাফিজ মজুমদার, আনিস মজুমদার, কামরুল ইসলাম চৌধুরী, ওরপুরের ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী, রামপুরের বিদেশ সাহা, রাকেশ সাহা, তেজু বাবু, নিতাই সাহা, নুরু মল্লিক এবং কাজী খালেক উল্লেখযোগ্য। দুইটি পত্রিকার সম্পাদক রামপুর গ্রামের মিজানুর রহমান রানা ও রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

বিদ্যালয়ের ৫২ বছরের কৃতী ছাত্রদের কীর্তিময় ইতিহাস ছোট পরিসরে বর্ননা করা এক দুঃসাধ্য প্রচেষ্টা। আর তাদের ক্রমবিন্যাস সঠিকভাবে তুলে ধরা তো আরো কঠিন। এখানে অবশ্যই ভুল ত্রুটি থাকবে। পাঠকদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করা ছাড়া আর কি বা করার আছে।

পরিশেষে, দুটো দাবির কথা লিখেই এই লিখা শেষ করব। প্রথম দাবিটি আসে এই লেখা চলাকালীন সময়ে প্রিয় বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রদের পক্ষ থেকে। তা হল প্রিয় বিদ্যালয়ের প্রিয় শিক্ষক মরহুম আলী নওয়াজ তালুকদারের স্মৃতি রক্ষার্থে বিদ্যালয়ে একটি পাঠাগার/ল্যাব/ভবন/ছাত্রাবাসের নাম করণ তার নামে করা। দ্বিতীয় দাবী হলো জনতার দাবী, তা হল যথাশীঘ্র প্রিয় উচ্চ বিদ্যালয়কে মহাবিদ্যালয়ে উন্নিত করা। এই দাবি প্রাণের দাবি, এই দাবি জনতার দাবি। যা আমি পারি নি, যা আমরা পারি নি, আগামী প্রজন্ম অবশ্যই তা পারবে এই প্রত্যাশা রেখেই শেষ করলাম।