সম্পাদকীয় নিবন্ধের ভাষা ও উপস্থাপনা

ওবায়েদ উল হক :
সম্পাদকীয় লেখার ব্যাপারে আমরা প্রথম বুঝি বিষয় নির্বাচন। তারপর সাধারণত সম্পাদক এবং সহকারী সম্পাদকরা নির্বাচিত বিষয়টি কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা উচিত এবং এ ব্যাপারে কী কী লেখা যাবে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। তারপর তারা সম্পাদকীয় লিখতে বসেন। লিডার রাইটার যখন লিখতে বসেন, তখন তাঁর লেখাটি হয় মৌলিক ও ব্যক্তিগত। রচনাশৈলীও থাকে তাঁর নিজস্ব ভঙ্গির। এখানে আলোচ্য বিষয় অর্থাৎ ভাষার প্রশ্ন এসে যাচ্ছে। লেখাটাই বড় কথা। সম্পাদকীয় লিখতে বসলে কোনো এক বিশিষ্ট ব্যক্তির উক্তি মনে পড়ে- ‘ডিফারেন্স বিটুইন লিটারেচার এ্যান্ড জার্নালিজম ইজ দ্যাট ওয়ান ইজ নট রেড দ্য আদার ইজ নট রীডেবল।’ সাংবাদিকদের প্রতি উন্নাসিক কিছু সাহিত্যিকের এ-ধরনের একটা মনোভাব আগে তো ছিলই, এখনও যে একেবারে নেই তাও বলা যায় না। হয়তো তাঁদের ধারণা, সাংবাদিকদের ভাষা ঠিক সাহিত্যের ভাষা হয় না। সেজন্য এটা সাহিত্যের মতো সুপাঠ্য নয়। এই উচিত কথা মনে রেখে আমাদের লেখা উচিত। অন্তত এটাই আমি মনে করতাম। সালাম সাহেবের সম্পাদকীয় পড়ে আমার বদ্ধমূল এ ধারণা পরিবর্তিত হয় আমার মনে হয়, তিনি যেহেতু ইংরেজি সাহিত্যের স্কলার ছিলেন, তাই তাঁর লেখা সম্পাদকীয় নিবন্ধগুলো পড়লেই বোঝা যেত তার লেখা। একথা মনে রেখে লিখতে বসলে ভাল হয়। তখন এ্যান এ্যাটিটিউড অব ডিসডেইন অন দ্য পার্ট অব দ্য ইন্টেলেকচুয়াল বলে যে-কথাটা চালু আছে অন্ততপক্ষে সেটা আর থাকে না সাংবাদিকদের ভাষা সাহিত্যের ভাষার মতো উচ্চমানের হবে না এটা ভাববার কোনো কারণ নেই।

আমার মনে হয়, সম্পাদকীয় নিবন্ধের কয়েকটি গুণ থাকা অত্যাবশ্যক। যেমন, ডাইরেকটনেস, ক্ল্যারিটি, সিমপ্লিসিটি ইত্যাদি। এগুলো না থাকলে ক্লিশে বা উলিনেস জব এক্সপ্রেশন এসে যায়, তার ফলে লেখার গুণ কমে যায় এবং বক্তব্য অস্পষ্ট থেকে যায়। মাঝে মাঝে সম্পাদকীয় হয়ে যায় একটা বিশেষ নিউজ আইটেমের প্যারাফ্রেজের মতো। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। হয়তো লেখকের কনসেপশন ক্লিয়ার নয়, অথবা কমেন্ট ইজ ফ্রী যাকে বলে সেই ফ্রীডম তিনি পুরোপুরি এক্সারসাইজ করতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে উইনস্টন চার্চিলের একটা কথা মনে পড়ছে। আইরিশ হোম রুলের ওপর লন্ডন টাইমস একটি সম্পাদকীয় লিখেছিল। তখন চার্চিল বলেছিলেন, ‘দ্য টাইমস ওয়াজ স্পীচলেস ওভার দ্য আইরিশ হোম রুল অ্যান্ড ইট টুক থ্রি কলামস টু এক্সপ্রেস ইটস স্পীচলেসনেস।’ চার্চিলের মতো কোন বিখ্যাত ব্যক্তি যদি কোন সম্পাদকীয় সম্পর্কে একথা বলে থাকেন তা হলে তার গুরুত্ব দিতেই হয়। অর্থাৎ বক্তব্য কিছুই নেই, তবে অনেক কথা বলা হয়ে যায়। এ ধরনের সম্পাদকীয়তে থাকে ডেলিউজ অব ওয়ার্ডস এ্যান্ড ড্রিজল অব থট। এ রকমের লেখা পাঠক পছন্দ করে না।

ভাষা সম্পর্কে একটা প্রশ্ন আমার মনে জাগে, সেটা হচ্ছে, আপনারা যাকে বলেন ‘প্রফেশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ’। অত্যন্ত পা-িত্যপূর্ণ। এটাকে বলা হয় ‘ইনট্রা মুরাল টাং’। বিশেষ কোন ইনটেলেকচুয়াল মহলের যে-বিশেষ ভাষা তার সীমাবদ্ধতা আছে, সাধারণ পাঠক তা বুঝবে না। এ-ভাষা এড়িয়ে যাওয়া উচিত। আর গ্রামার বা মেকানিজম অব ল্যাংগুয়েজ অর্থাৎ ব্যাকরণ ও কম্পোজিশনের দিকে নজর না দিকে লেখার মান অনেকখানি নেমে যায়। কার জন্য লিখছি সেকথা মনে রেখে তারা বুঝতে পারে এমন ভাষায় লেখা দরকার। সেজন্য একজন ভাষাতাত্ত্বিক হয়ে তবে লিখতে হবে সেটাও কাম্য নয়। কিছু-কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকা আছে সেগুলো সবসময়ই একটি প্রতিবাদের ভাষা ব্যবহার করে। এর বাইরে যেতেই চায় না। এর বাইরে গেলে হয়তো পত্রিকা চলবে না বা তাদের বিশেষ কোন উদ্দেশ্য সাধিত হবে না বলে তাঁরা মনে করেন। দৈনিক পত্রিকায় এটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।

ভাষার সঙ্গে আবার বিষয়ের ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। কোন কোন বিষয় আছে যার ভাষা পেডান্টিক হওয়া অবাঞ্ছনীয়। এটা আপনাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা, নতুন করে বলার বিশেষ কোন প্রয়োজন নেই। প্রফেশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ বলতে আসলে আমরা কি বুঝি?

গবলডিগুক বলে ইংরেজীতে একটা কথা আছে। অর্থাৎ বিশেষ শ্রেণী কর্তৃক একটা বিশেষ ধরনের ভাষা ব্যবহার করা। যেমন অফিসিয়াল জারগণ। প্রফেশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ বলতে নিহায়ত জার্নালিস্ট ও অফিসিয়ালিজ যেন না বোঝায়। সাহিত্যের ভাষা খুব বেশি পা-িত্যপূর্ণ। ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকায় একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। আমেরিকান ইংরেজী ও ব্রিটিশ ইংরেজী। আমেরিকান ইংরেজীও ইংরেজী, ব্রিটিশ ইংরেজীও ইংরেজী। কিন্তু এর মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়ের ওপর বেশ কিছু বইও বেরিয়েছে। আমাদের দেশে, মাতৃভাষা যাদের ইংরেজী নয়, তাদের পক্ষে এ দুটোর ব্যবহারই এসে যায়। আগেই বলেছি, রচনা বেশি পা-িত্যপূর্ণ করতে গেলে পাঠকদের কথা খেয়াল থাকে না। অথচ সাংবাদিকতা সাহিত্যসৃষ্টির কাজ করে না এবং সংবাদপত্র পাঠকের জন্যেই। সুতরাং লেখা এমন হওয়া উচিত নয় যা পাঠাকের বোধগম্য হবে না। আমরা ছোটবেলায় শুনতাম কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা পড়লে ইংরেজী ভাষা শেখা যায়। কথাটা হয়তো ভুল নয়। আপনারা যাঁরা বাংলা ভাষায় সম্পাদকীয় লেখেন তাঁদের লেখা পড়েও অনেক পাঠক ভাষা শেখেন। কিন্তু এ ভাষা যদি বোধগম্য না হয় তা হলে শেখার প্রশ্ন থাকবে না। তবে তাদের ভাষা শেখবার জন্য আমি আমার মান নিচু করব না, এটাও ঠিক। আবার আমার নিজের সন্তুষ্টির জন্য লেখার স্টাইলকে এমন করব না যার মর্মার্থ সাধারণ পাঠক বুঝবে না। এ-ব্যাপারে আমাদের একটা কনশাস এ্যাফার্ট থাকা দরকার। কারণ আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য আমাদের বক্তব্য মানুষের চেয়ে প্রধান হয়ে উঠলে প্রবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য অনেকখানি ব্যাহত হবে। বিশেষ করে সাংবাদিকদের বেলায় এটাকেই আমি প্রফেশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ বলতে চাই। যাঁরা প্রফেশনাল ল্যাঙ্গুয়েজের কথা বলেন, তাঁরাও বোধহয় এটাই বোঝাতে চান।

এখানে আর একটা কথা বলা যেতে পারে। স্টাইল জিনিসটা হলো সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু সম্পাদকীয় নিবন্ধও খবরের কাগজের নিজস্ব ব্যাপার। কাজেই এক্ষেত্রেই নিজকে অপ্রকাশ্য রেখে কাগজের পার্সোনালিটির দিকটাকে তুলে ধরতে হবে। কাগজের বক্তব্যই প্রধান হবে। কিন্তু যাঁরা লিখবেন তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিত্বকে একেবারে উহ্য রাখলে কাগজের মানোন্নয়ন হবে কী করে? আমার মনে হয় দুটোর মধ্যে একটা সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করা দরকার। পত্রিকার ব্যক্তিত্বের একটা অংশ যাঁরা লেখেন তাঁদের উপরই নির্ভরশীল। কোন কোন পত্রিকার লেখা অনেক উন্নতমানের হয়। কোন কোন পত্রিকার ততটা হয় না। যাঁরা লেখেন তাঁদের জন্যই এটা হয়। কিন্তু ঐ যে বলা হয়ে থাকে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার চেয়ে বড় স্রষ্টা আর কেউ নেই। কাজের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন। গড লাইকস টু বি এ্যানোনিমাস। আমরা যারা সম্পাদকীয় লিখি, তারা তো সামনে আসি না। আসে আমাদের লেখা। তবু ‘দ্য আর্টিস্ট ইজ দেয়ার’। যে-ব্যক্তি ক্যামেরার পিছনে কাজ করেন, সামনে আসেন না, তাঁর ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পাবে তাঁর তোলা ছবিতে।

আমাদের সম্পাদকীয় লেখার উদ্দেশ্য পাঠকের সামনে বক্তব্য তুলে ধরা। এবং সেজন্যই দেখতে হবে স্টাইল যেন এমন না হয় যাতে বক্তব্য দুর্বোধ্য হয়ে যায়। কিন্তু যদি আমি ধীরে ধীরে আমার লেখার মান উন্নয়নের চেষ্টা করি তা হলে পাঠকও আস্তে আস্তে বুঝে নেবে। বিশেষ বিশেষ পত্রিকার বিশেষ বিশেষ পাঠকশ্রেণী থাকেন। তাঁরা ঐসব পত্রিকার স্টাইলে অভ্যস্ত হয়ে যান, একসময় পছন্দ করে বসেন।

আমার মনে হয় সম্পাদকীয়গুলোর স্ট্রাকচারাল প্যাটার্ন কী হওয়া উচিত সে-সম্পর্কে এবার কিছু আলোচনা হওয়া দরকার। এ সম্পর্কে সম্পাদকীয় লেখকের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। কথাটা খুব বেশি কঠিন নয়। স্ট্রাকচার মানে লেখাটা কীভাবে অগ্রসর হবে, কীভাবে ডেভেলপ করতে হবে, কীভাবে উপসংহারে আসতে হবে সেটা ভালভাবে জানা দরকার। সম্পাদকীয় নিবন্ধের কাঠামোগত দিক দিয়ে তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। লেখা শুরু করার আগে মনে মনে ব্লুপ্রিন্টের মতো ধারণাটা মনে গেঁথে নিতে হবে। তারপর যুক্তিগুলো ডেভেলপ করতে হবে। সেটা ব্যাখ্যা করার সময়ে যদি কিছু বলার থাকে সে-বক্তব্য রাখতে হবে এবং সবশেষে পত্রিকার সম্পাদকীয় মত হিসেবে কী প্রকাশ করব, উপসংহার কীভাবে টানব এটা আসে। তবে পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গি তো নানারকম হতেই পারে। কোন কোন পত্রিকার দেখি শুরুতেই খবর দিয়ে শুরু করা হলো। যেমন ‘খবরে প্রকাশ’ এভাবে সম্পাদকীয় শুরু হয়ে গেল। অন্যরকমও আছে। যুক্তি ও বক্তব্য দিয়ে এবং সমর্থনে খবর উল্লেখ করে শেষ। সম্পাদকীয় নিবন্ধ যেহেতু একটা বিশেষ অর্থ বহন করে, দৃষ্টিভঙ্গি ও মন্তব্য সেভাবেই উপস্থাপন করা উচিত এবং এটা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। লেখক নিজেও করেন, তাঁর সিনিয়র যাঁরা আছেন তাঁরা তাঁকে সাহায্য করেন। তা ছাড়া সম্পাদক তো আছেনই।

উপস্থাপনা সম্পর্কে বলতে গেলে অবশ্য কাঠামোর কথা এসে যায়। এ বিষয়ে এক-এক পত্রিকার এক-এক রীতি। এখানে আবার আরও একটি কথা এসে যায়, বিষয়ের ওপর ভাষা নির্ভর করবে, উপস্থাপনা নির্ভর করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে সম্পাদকীয় নিবন্ধের বিষয়বস্তুতে যিনি লিখবেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব একেবারে থাকবে না এটা নিশ্চিত করে বলা চলে না। লেখার একটা সাধারণ ফর্ম বা আঙ্গিক আছে, সেটা হলো ইউনিভার্সেল ফর্ম। সংবাদপত্র তো আসলে অনুরূপতার (কনফরমিটি) বিরুদ্ধে। সম্পাদকরা সেভাবে চলেন, অন্তর তা-ই চলা উচিত। একটা বিশেষ ফর্ম যদি আপনি ঠিক করে দিয়ে থাকেন তা হলে মনে হবে যে ঐ ফর্মের বাইরে আপনি যেতে পারছেন না। নতুনত্বহীন গৎ-বাঁধা একটা ফর্মূলা গড়ে উঠছে, যেটা হওয়া উচিত না। তাই আগে থেকে ছক বেঁধে দেয়া সম্ভবও নয়, উচিতও না। যে-বিষয়ে আপনি মন্তব্য করবেন, সেটা যেমন আপনি নির্ধারণ করবেন, লেখার স্টাইল, মুনশিয়ানা এসব স্বতঃস্ফূর্তভাবে বক্তৃতার মতো আসবে। যাঁরা বক্তা তাঁদের এক-একজনের এক-এক রকম স্টাইল আছে। কীভাবে বললে জনসাধারণকে প্রভাবিত করা যাবে সে-সম্পর্কে তাঁদের ভাল অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে। সম্পাদকীয় ব্যাপারটাও ঠিক তা-ই।

আগেই বলেছি ভাষা সরল হওয়া প্রয়োজন। ইউনিভার্সাল এক্সপ্রেশন না থাক, রেকনেস যেন না থাকে। অর্থাৎ ইমপ্র্যাাশনিস্টিক ল্যাঙ্গুয়েজ সম্পাদকীয় রচনায় খাটে না। ওটা ব্যক্তিগত কলামে চলে। ক্লাসিফিকেশন অব রিডারশিপের কথা যে বলা হয়ে থাকে তাতে দেখা গেছে, এক ধরনের পাঠক আছে যারা খুব মন দিয়ে পড়ে। আর কিছু-কিছু পাঠক আছে যারা নিছক সময় কাটানোর জন্য পড়ে। সম্পাদকীয় সংক্ষিপ্ত করতে গেলে, কনসাইজ বা প্রিসাইজ করতে গেলে কলম হাতে নিয়ে একটু ভাবতে হবে, ধীরে ধীরে লিখতে হবে। যেখানে সময় বেশি নেই, সেখানে আমরা অফুরন্ত লিখে যেতে পারি। ঐ যে চাার্চিল বলেছেন, দ্য টাইম টুক থ্রি কলামস টু এক্সপ্রেস ইটস স্পীচলেসনেস-এটা পরিহার করা প্রয়োজন। তবে লেখা যা-ই হোক তার রিডেবিলিটি থাকতে হবে। মনে করুন, যাঁরা আগে সম্পাদকীয় সিরিয়াসলি পড়তেন না, হয়তো ক্যাজুয়ালি পড়তেন-পড়ে ভাল লাগলে আস্তে আস্তে সিরিয়াস হবে। যে কোন লেখার দুটি পক্ষ এবং সংবাদপত্রের জন্য তিনটি পক্ষ থাকে। একটি পেপার-তার মতামত, তার বক্তব্য (যেটা যিনি লিখছেন তাঁর মতামত নাও হতে পারে)। আর একটি যিনি লিখছেন এবং সর্বশেষ যাদের জন্য লেখা হচ্ছে। একটা কথা আছে কনসাইজনেস। বিভাগপূর্ব কলকাতার ‘কমরেড’ পত্রিকায় ৫/৬ কলাম এডিটোরিয়াল লেখা হতো। অন্যতম সম্পাদককে একদিন জিজ্ঞেস করা হলো- এত বিরাট এডিটোরিয়াল কেন লেখা হয়? এতে পাঠকের তো ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। তিনি জবাব দিলেন, যারা সিরিয়াস পাঠক শুধু তারাই সম্পাদকীয় পড়ে।

এ জন্য আমি প্রথমে বলেছি, এডিটোরিয়াল রাইটারদের কয়েকটি বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। তা হচ্ছে ডাইরেক্টনেস, ক্লারিটি সিম্পলিসিটি। এগুলো তো থাকতেই হবে। আর একটি কথা মনে রাখতে হবে, লেখক নিজেকে সম্পূর্ণ তুলে লিখতে পারেন না। যেহেতু অল্পসংখ্যক পাঠক এটা পড়েন, তার অর্থ এ নয় যে, আমরা এ-সংখ্যা বাড়াব না। কিংবা আজ যাঁরা পড়ছেন, কাল হয়তো পড়বেন না। এর উল্টোও হতে পারে। তাই লেখার স্টাইলের ওপর পাঠকের পড়া বা না পড়া কিছুটা নির্ভর করে বৈকি। লেখাটা অবশ্যই রিডেবল হতে হবে। লিটারেচার ও জার্নালিজমের পার্থক্য সম্পর্কে যা বলা হয়ে থাকে তা মনে রাখতে হবে।

এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, সংবাদপত্রের লেখার সঙ্গে জড়িত বচনটি পক্ষের অন্যতম সংবাদপত্রের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের ওপর মালিক তাঁর মতামত চাপিয়ে দিতে চাইলে তখন পত্রিকার ব্যক্তিত্ব বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে কিনা। সালাম সাহেব বলতেন, যতদিন সংবাদপত্র ব্যক্তিগত মালিকানাধীনে, ততদিন এ আলোচনার শেষ হবে না। সাালামের মতের সঙ্গে আমিও একমত যে, প্রাইভেট হোক, পাবলিক হোক বা গবর্নমেন্ট ওনারশিপেই হোক, সংবাদপত্রকে কারও-না-কারও ইনফ্লুয়েন্সে থাকতেই হবে। তা সত্ত্বেও পত্রিকার নিজস্ব চরিত্র ও ইমেজ গড়ে উঠতে পারে।

আরগুমেন্ট ও সাবজেক্টকে জোরালো করার জন্য তথ্য-সরবরাহ সম্পর্কে যে-প্রশ্ন তোলা হয় সে-সম্পর্কে এবার বলছি। ল্যাঙ্গুয়েজ এবং সাইজ দুটোই নির্ধারিত হবে বিষয়ের প্রেক্ষিতে। প্রয়োজনবোধে লেখা লম্বা-চওড়াও হতে পারে। শুধু জার্নালিজমের ক্ষেত্রে নয়, যে-কোনো লেখার ব্যাপারেই এটা খাটে। তবে এখন তো আমরা ক্রিটিক্যাল টাইমের মধ্যে এসে পড়েছি। কারণ বোধগম্য কারণেই রেসট্রিকটেড সাপ্লাই অব নিউজপ্রিন্ট, রেসট্রিকটেড নাম্বার অব পেজ, বিজ্ঞাপনের পরিমাণ বৃদ্ধি এসবের জন্য এডিটোরিয়ালের কলেবর বৃদ্ধির সুযোগ কমে গেছে। এর মধ্যে যতখানি দরকার ঠিক ততখানি আপনাদের দিতে হবে। কাজেই এভরি জার্নালিস্ট হ্যাজ টু লার্ন হাউ টু ইকোনমাউজ অন স্পেস বাট নট অন ফ্যাক্টস অব আইডিয়াল।

কথা হচ্ছে আপনাকে কোন গ-ি টেনে দেওয়া যাবে না। আপনার বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য যে-স্পেস প্রয়োজন তা তো নেবেনই। একটা সর্বজনীন সত্য আছে যে, সম্পাদকীয় দরবারি স্ট্যাইলে লেখা যায় না। এখানে ডাইরেক্টনেস, সিম্পলিসিটি অপরিহার্য। ভাষাসংক্রান্ত আর একটা কথা হঠাৎ আমার মনে পড়ল। উইনস্টন চার্চিলের একটা কথা, কথাটা বেশ এ্যাপ্লিকেবল এবং রেলিভেল্ট। কথাটা হচ্ছে, ‘ম্যান উইল ফরগিভ ম্যান অলমোস্ট এভরিথিং একসেপ্ট ব্যাডপ্লোজ’ কথাটা আমাদের মনে রাখা দরকার। প্রফেশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ বলতে আমরা যেন মনে না করি যে, এনি ল্যাঙ্গুয়েজ। কিন্তু সেই অজুহাতে ভাষাকে একেবারে অবহেলা করা যায় না। স্ট্যান্ডার্ডটা নিজের ব্যাপার। আপনি ডিফিকাল্ট সাবজেক্টকে সহজ করে বোঝাতে পারেন। সহজবোধ্য লেখা পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। দুর্বোধ্য লেখা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।