আপনি মানুষ!

ছোট গল্প

আপনি মানুষ!

লিখেছেন : ক্ষুদীরাম দাস

কমলের ঘুমটা হঠাৎ ভেঙ্গে গেলো। বিকেল বেলা বারান্দায় বসে বসে শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘেরা উড়ে যায় বাতাসের জোরে। সাদা কালো মেঘের উড়ে যাওয়া ভালো লাগে কমলের। কমলের চোখ দু’টো চলে যায় বাগানের দিকে। সেখানে গাছের ডালে বেশ কিছু পাখি কিচিরমিচির করে ডাকাডাকি করে। হয়তো ওদের ভাষায় কথা বলতে ওরা। গাছের একডাল থেকে অন্যডালে উড়ে বেড়ায়। কিছু পাখির মুখে গাছের ডালপালা দেখা যায়। ওরা হয়তো বাসা তৈরির জন্যে মুখে ডালপালা তুলে নিয়েছে। ওদের তো ইচ্ছে করে বাসা তৈরির, আর সেই বাসায় আরামে থাকার। কমল চোখ বন্ধ করে থাকে বেশ কিছুক্ষণ।

কমলের চোখ খোলার সাথে সাথে তার চোখের দৃষ্টি চলে যায় নিচের দিকে। দেখে একটি মেয়ে দড়িতে কাপড় নাড়ছে। এর আগে কখনো কমল মেয়েটিকে দেখেনি। তার চোখে পড়েনি কোনোদিন। কমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ভাবে কেউ যদি তার এই অবস্থা দেখে ফেলে তাহলে তার সম্মান বলে কিছুই থাকবে না। তাই সে কালো চশমাটা পরার জন্যে দৌড়ে রুমে গেলো। তাড়াতাড়ি চশমাটা পরে আবার একইভাবে বসে পড়লো। দেখলো মেয়েটি কাপড় নাড়ছে। অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটি। কিন্তু মেয়েটির মুখে কেনো হাসি দেখা গেলো। মনে হলো মেয়েটির মনে খুবই দুঃখ। মানুষ দুঃখ পেলে যে রকম হয়। সে তো স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না। তার চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যায় তার মনের মধ্যে দুঃখ আছে, আছে কষ্ট। আর সেই কষ্ট চোখে মুখে স্পষ্ট ধরা পরে। মেয়েটির বেলায়ও তাই হয়েছে। তাকে দেখেই মনে হবে তার মনের ব্যাথার পাহাড় রয়েছে। মেয়েটি কোনো দিকেই তাকাচ্ছে না। আপন মনে সে তার কাজ করেই যাচ্ছে। একসময় মেয়েটি ঘরে চলে গেলো। কমল তাকিয়েই রইলো। কিন্তু মেয়েটি আর ঘর থেকে বের হলো না।


একইভাবে কমল পরের দিন আবার একই সময়ে বারান্দায় এসে বসলো। ঠিক সেই সময় মেয়েটি ঘর থেকে বের হয়ে কাপড় নাড়ছে। আজ দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি ¯œান করে ঘর থেকে বের হয়েছে। তার মাথায় নীল একটি গামছা বাঁধা রয়েছে। বিশেষভাবে মেয়েটি তার চুলগুলো জড়িয়েছে। মেয়েটি কাপড় নেড়েই রুমে ঢুকে গেলো। কমল তাকিয়েই রইলো। কিন্তু রুম থেকে আর বের হলো না।


পরের দিন আবার একই সময় কমল বারান্দায় বসে রইলো। আজ সে সুন্দর শাড়ী পড়ে রুম থেকে বের হয়েছে। তার কালো চুলগুলো পীঠের উপর ছড়ানো। হালকা বাতাসে মাঝে মাঝে দোল খাচ্ছে। ডানে বামে তাকাচ্ছে। একসময় মেয়েটি পেছন ফিরে তাকালো। এবার কমল স্পষ্ট মেয়েটির মুখ দেখতে পেলো। আহা! কী অপূর্ব! এমন মেয়ে কমল এর আগে কখনো দেখেনি। কী সুন্দর। তার রুমের বর্ণনা করা কমলের পক্ষে সম্ভব নয়। এর আগে কখনো কোনো মেয়েকে সে এভাবে দেখেনি। এতো ভালো কোনো মেয়েকে লাগেনি। কী আশ্চর্য সুন্দর মেয়েটি। কমল তাকিয়েই রইলো। কিন্তু এতো সৌন্দর্যের মধ্যে মেয়েটির মুখে কোনো হাসির রেখা দেখতে পেলো না কমল। কী অদ্ভুত মেয়েটি! মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো মনে হবে যেন কাঁদো কাঁদো ভাব। মেয়েটি কিছুক্ষণ থাকার পর আবার রুমের ভেতর ঢুকে গেলো। কমল তবুও সেদিকে তাকিয়ে রইলো। অনেক সময় পার হলো। তবুও মেয়েটি বের হলো না। কমল এতো সময় ধরে তাকিয়ে রইলো যে, তার অধৈর্য হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে রকম কিছুই হচ্ছে না। কমলের ধৈর্য্যরে মধ্যে কোনো ক্লান্তি দেখা গেলো না। কমল তাকিয়েই রইলো। এভাবে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো কমল নিজেই বুঝতে পারছে না। আরেকটু অপেক্ষা! আরেকটু অপেক্ষা! এভাবে অনেক সময়।

এক সময় দেখা গেলো মেয়েটি আবার রুম থেকে বের হয়েছে। এবারে সে সেলোয়ার কামিজ পড়েছে। কিন্তু তার মুখটি ঢাকা! গেইট দিয়ে বের হয়ে সোজা রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে উত্তরের দিকে। কোনো দিকেই মেয়েটি তাকাচ্ছে না। হাঁটছে তো হাঁটছেই। কোথাও কোনো থামছে না। কমল তাকিয়েই রইলো। একসময় কমলের দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো মেয়েটি, তবুও তাকিয়েই রইলো। একসময় তার চেতনা ফিরে এলো। কমল রুমে ঢুকে নিজের মনকে নানান প্রশ্ন করছে। কমলের কাছে সবকিছু কেনো জানি আশ্চর্য বলে মনে হচ্ছে।

পরের দিন কমল সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামছে। তখন মেয়েটিকে স্পষ্ট দেখতে পেলো। হয়তো বাইরে থেকে বাড়ির ভেতরে আসছে। কমল মেয়েটির দিকে তাকিয়েই আছে। মেয়েটি মাটির দিকে তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। বাইরে দাড়োয়ানের সাথে কৌশলে আলোচনা করলো। মেয়েটির বিষয়ে অনেক কিছু জানতো পারলো। ওরা এই বাড়িতে এসেছে মাত্র একমাস হয়েছে। কিন্তু কোথা থেকে সে বিষয়ে কোনো কিছু জানতে পারলো না। ব্যাস! যতটুকু জানতে পেরেছে সেটুকুই যথেষ্ট।

একদিন কমল রাস্তায় একা হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে ফিরছিলো। তখন মেয়েটি বাড়ি থেকে বের হয়েছে মাত্র। কমল দূর থেকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালো। হাঁটার গতি কমিয়ে মেয়েটির দিকে লক্ষ্য করতে লাগলো। কমল আজকের দিনটাকে সুবর্ণ সুযোগ বলে মনে হচ্ছিলো। আজ সে মেয়েটির সাথে কথা বলবেই। মেয়েটি কাছাকাছি আসতেই বললো, এক্সকিউজ মি! আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি? মেয়েটি থতমত খেয়ে দাঁড়ালো। তারপর বললো, বলুন। কমল বললো, আমি কমল। আপনি যে বাসায় থাকেন, সেই বাসায় আমিও থাকি। আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আমি কি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে পারি? আমার খুব ইচ্ছা করছে আপনার সাথে কিছু কথা বলি। মানে, আমার মনের কথা আপনাকে বলতে চাই। মনের কথা মানে, আপনি তো নতুন এসেছেন, সে বিষয়ে আপনাকে কিচু আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই। যদি আপনি একটু মনোযোগ দিয়ে শুনতে তাহলে খুবই ভালো হতো। মানে, আমার মনের আশা পূরণ হতো। দয়া করে আপনি আমার কথা শুনুন।

কমল এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলে হঠাৎ থেমে গেলো। মেয়েটি বললো, আমার কোনো কথা নেই। আমি আপনাকে চিনি না। সুতরাং আপনার সাথে আমার কোনো কথা থাকতে পারে না।

বলেই মেয়েটি দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেলো। কমল হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে। আর ভাবলো, মেয়েটি কেমন অদ্ভুত! কমলের মনের মধ্যে অন্য রকম লাগ হচ্ছিলো। তার কাছে কোনো কিছুই ভালো লাগছিলো না। তার কাছে সবই অসহ্য লাগছিলো।

কমল বাড়িতে হাঁটতে হাঁটতে বাড়িতে চলে গেলো। সারাদিন তার কাছে কোনো কিছুই ভালো লাগছিলো না। রাতে বিছানায় ঘুমাতে গিয়েও তার কাছে ঘুম আসছিলো না। সারা রাত সে বিছানায় ছটফট করেছিলো।

একদিন পর কমল আবার বারান্দায় গিয়ে বসলো। কিন্তু সে মেয়েটিকে দেখতে পেলো না। তার কাছে আরো বেশি খারাপ লাগছিলো। তারপর কমল প্রস্তুত হয়ে বেড়িয়ে গেলো বাইরে। রাস্তায় ছোট চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে মেয়েটির কথাই বার বার চিন্তা করছে। এমন সময় সে দেখতে পেলো মেয়েটি বাড়ির দিকে ফিরছে। কমল মনে মনে ঠিক করলো, আজ তাকে যেভাবেই হোক একনজর দেখবেই। আর তার সাথে কথা বলবে। মেয়েটি কাছে আসলে কমল তার পথ আগলে ধরলো। মেয়েটিও কোনো কথা না বলে ভদ্রভাবে দাঁড়ালো। কমল বললো ঃ আজ আমি আপনাকে কিছু বলবোই। আমার নাম কমল। আপনার নামটি অন্তত বলুন।

‘লতা’ বলেই মেয়েটি চলে যেতে চাইলো। কিন্তু কমল তার পথ আগলে বললোঃ প্লিজ, আমার সাথে একটু কথা বলুন। আমি আপনার সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
লতা ঃ আমার সম্পর্কে জেনে আপনার কোনো লাভ হবে না।
কমল ঃ আমার কেনো লাভ হবে না?
লতা ঃ শুধু আপনার নয়, কারোরই লাভ হবে না।
কমল ঃ আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
লতা ঃ আপনি আসলে কী বলতে চান, সরাসরি বলতে পারেন।
কমল ঃ আমি আপনাকে অনেকদিন থেকে লক্ষ্য করছি। সেটা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন?
লতা ঃ কিছুটা অনুমান করতে পেরেছি।
কমল ঃ আশ্চর্য! তাহলে কি আপনি আমাকে খারাপ মনে করেছেন?
লতা ঃ আপনাকে খারাপ বলে মনে হয়নি।
কমল ঃ আপনি আমার সাহস বাড়িয়ে দিলেন।
লতা ঃ বলুন, আর কী বলতে চান।
কমল ঃ আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি। আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?
লতা ঃ না।
কমল ঃ কেনো?
লতা ঃ তা হতে পারে না।
কমল ঃ কেনো হতে পারে না?
লতা ঃ আমার মতো মেয়েকে কেউ ভালোবাসতে পারে না। আপনিও না।
কমল ঃ আমি তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না। আমি কি দেখতে খারাপ? আমি অসুন্দর? পুরুষ হিসেবে আমি কি অযোগ্য? আমার চেহারা কি মোটেও ভালো নয়?
লতা ঃ সে রকম কিছুই নয়।
কমল ঃ তাহলে আপনার সমস্যা কী? কেনো আমাকে আপনার পছন্দ হয় না?
লতা ঃ পছন্দ অপছন্দের কোনো প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো, আপনি আমাকে ভালোবাসাতে পারেন না।
কমল ঃ কেনো?
লতা ঃ সেটা বললে আপনি সহ্য করতে পারবেন না।

লতা এবার তার মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে নেয়। কমল অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। এতো রূপ এর আগে কখনো সে দেখেনি। অথচ মেয়েটির মুখে মোটেও হাসি নেই। মুখে তার নিরানন্দে ভরপুর। হয়তো মুখ ভার করে থাকার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অথবা, প্রতিজ্ঞা করেছে না হাসার।
কমল ঃ আমি আপনার কোনো কথাই বুঝতে পারছি না।
লতা ঃ আশা করি, আমাকে আপনার আর কিছু বলার নেই।
কমল ঃ আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। আপনিই আমার জীবনসঙ্গী।
লতা ঃ অসম্ভব!
কমল ঃ কেন? আমি কি তোমার অযোগ্য!
লতা ঃ সে রকম কিছুই নয়। আমি বললে আপনি সহ্য করতে পারবেন না।
কমল ঃ সমস্যা কি আপনার?
লতা ঃ আপনার সমস্যা নেই। সমস্যা আমার।
কমল ঃ সেটা কী রকম সমস্যা?
লতা ঃ আপনি মোটেও সহ্য করতে পারবেন না।
কমল ঃ আপনি বলুন। বলেই দেখুন।
লতা ঃ আমাকে দেখে সবাই বলে। কিন্তু শোনার পরে ওরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। আমার সম্পর্কে জেনে আর এগিয়ে আসেনি আমাকে বিয়ে করতে।
কমল চিৎকার করে বললো ঃ প্লিজ আমাকে বলুন, সমস্যা কী?
লতা ঃ আমি ধর্ষিতা!
কমল ঃ ধ-র্ষি-তা!

কমল স্তব্ধ হয়ে গেলো। মনে হলো আকাশ ভেঙ্গে পেড়েছে তার মাথার উপর। একটা কঠিন পাথর সম্মুখে রয়েছে। যেটিকে ডিঙানো তার পক্ষে অসম্ভব। কমলের মুখে আর কোনো কথা বের হচ্ছে না। এদিকে লতা কমলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

তারপর বললো ঃ পেরেছেন? আমার কঠিন সত্যটা সহ্য করতে পেরেছেন? আপনি তো অনেক কথাই বললেন। জীবন এতো সহজ নয়।

বলেই মেয়েটি আমার মুখটি ঢেকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। এখানে আর অপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

পরের দিন কমল মেয়েটির ঘরের কাছে গিয়ে হাজির হলো। টোকা দিতেই ঘরের দরজাটি লতা খুলে দিলো। তারপর কমল বললো ঃ আমি মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি। আর যুদ্ধে আমি বিজয়ী হয়েছি। আমি তোমাকে বুঝতে শিখেছি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমি তোমাকে নিয়েই আমার সংসার করবো।
পেছনে দাঁড়িয়ে লতার মা বাবা সবই শুনছিলো।
লতা এক পা এগিয়ে এসে বললো ঃ আপনি মানুষ!
বলেই লতা হাসলো। দীর্ঘ চার বছর পর লতার মা বাবা মেয়ের মুখে হাস দেখতে পেলো।
লতা কমলের চোখে চোখ রেখে ফিস ফিস করে বললো ঃ আপনি মানুষ! আপনি মানুষ! আপনি মানুষ!
—————— সমাপ্ত ————