ধর্ষণ বেড়েছে যে কারণে

এমন কিছু খবর আছে যা প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে থাকে সেগুলো একসাথে জড়ো করে একত্র ছাপা হয় সংবাদপত্রে। এ ধরনের খবরগুচ্ছকে বলা হয় কম্পাইল্ড নিউজ। নিউজ ডেস্কের সংবাদকর্মীরা কম্পাইল করার কাজটি করেন। প্রথাগতভাবে কম্পাইল্ড নিউজের শীর্ষে সড়ক দুর্ঘটনা। এছাড়াও আছে হত্যা, খুন, চুরি, ছিনতাই। বিভিন্ন সিজনে বিভিন্ন ঘটনা ও ইস্যুও অন্তর্ভুক্ত হয় এতে।

সম্প্রতি কম্পাইল্ড নিউজের শীর্ষস্থান দখল করেছে ধর্ষণ ও নারীনিগ্রহ। সামাজিক আন্দোলন, প্রতিবাদ এবং মৃত্যুদণ্ডের আইন করার পরেও নারী এবং শিশু নিগ্রহ কমছে না। শুধু আইন প্রয়োগ করে বা শাস্তি কঠোর করে ধর্ষণ যে থামানো যাবে না তা সকলেই স্বীকার করছেন।

পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হতে পারে বাংলাদেশের পুরুষকুল হঠাৎ হাইপার সেক্সুয়ালিটিতে আক্রান্ত হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। মদনবায়ুর প্রবাহে তাদের শরীরী সক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। ফলে তারা নারীবুভূক্ষু হয়ে পড়েছে। বাস্তবতা তার বিপরীত। চিকিৎসক সমাজের ভাষ্য মতে দেশে পুরুষবন্ধ্যাত্ম ও নপুংসতা আশংকাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে তরুণদের যৌনসক্ষমতা অত্যন্ত ভঙ্গুর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দাম্পত্যসম্পর্কে ফাঁটল ধরছে সুষম যৌনসম্পর্কের ঘাটতির কারণে। অর্থাৎ যে পুরুষ তাঁর স্ত্রীর চাহিদা পূরণে ব্যর্থ, বলা যায় স্বামী হিসেবে মৌলিক কর্তব্য পালনে ব্যর্থ, তিনিই পরস্ত্রী, নিষ্পাপ শিশু কিংবা অসহায়া নারীর ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে। যার ঘরে অতৃপ্ত স্ত্রী তিনিই তৃপ্তি খুঁজতে যান পর নারীকে নিপীড়ন করে।

যৌনজীবনের বৈপরীত্য এই যে স্ববিরোধ তার কারণ খোঁজার জন্যে সঠিক গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে সুষ্ঠু গবেষণা হয় না। ফলে সমস্যা নিয়ে হায় হায় মাতম চলে, সমস্যার পেছনের কারণ থেকে যায় অ-চিহ্নিত।

আমার কাছে মনে হয় ধর্ষণ ও নারীনিপীড়নের পেছনে মুল কারণ মানুষের যৌনবিকার ও বিকৃতি। প্রতিটি মানুষের ভেতরে জন্ম দিয়েছে আরেকটি পারভারটেড মানুষ। এই বিকৃত মানুষটি গ্রাস করেছে প্রকৃত সামাজিক মানুষটিকে। এই বিকৃতির প্রধান দুটি কারণ পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা ও মাদক বিশেষ করে ইয়াবার সয়লাব।


পর্নো সাইটগুলোর ওপর নজরদারি করে এমন সংস্থাগুলোর ভাষ্য মতে, পর্নো আসক্ত মানুষেরা স্বাভাবিক যৌনতা নয় খুঁজে অসঙ্গত ও বিকৃত বিষয় আশয়। বাবা-মেয়ে (নাউজুবিল্লাহ), মা-ছেলে (নাউজুবিল্লাহ), শিশু-বৃদ্ধ এ ধরনের অসঙ্গত বিষয়ে দর্শদের আসক্তি বেশি। ফোর্সড সেক্স বা বলপূর্বক যৌনতার প্রতিও মানুষের আগ্রহ লক্ষণীয়। লেবাননের পর্নোস্টার মিয়া খলিফা রাতারাতি তারকাখ্যাতি লাভের মূল কারণ হিজাব পরে পর্নোছবি করা। গ্রুপ সেক্স বা দলবদ্ধ যৌনতাও এ জগতে বিশেষ জনপ্রিয়। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক যৌন অপরাধের ধরন বিশ্লেষণ করলে পর্নোজগতের বিকৃত যৌনাচারের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যাবে। স্বাভাবিক যৌনতায় অক্ষম মানুষটিও অস্বাভাবিক যৌনক্রিয়ায় পাশবিক শক্তিতে মত্ত হয়ে উঠে। কারণ তার ভেতরে পাশবিক সত্তার বিকাশে মানবিক সত্তা ধরাশায়ী হয়ে গেছে। মানুষকে রিপুতাড়িত ও মনুষ্যত্বহীন করার আরেক উপাদান মাদক। বিশেষ করে ইয়াবা। এই মাদকটির ব্যবহারে মানুষ সাময়িকভাবে বস্তুজগতের বাইরে এক রোমান্সের কল্পজগতে চলে যায়। তার দেহমনে প্রবল সক্রিয়তা তৈরি হয়। ইয়াবার ঘোরলাগা মানুষ মানবীয় চেতনা তেকে অনেক দূরে থাকে। ফলে তার দ্বারা পাশবিক কাজ সহজতর হয়।

যৌনতা মানুষের জীবনসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের দেশের মানুষের যৌনসংস্কৃতিতে বিকৃতি ছিল না। বিদেশাগত পর্নোগ্রাফি যৌনতার চিরকালীন স্বরূপটি বদলে দিয়েছে। এই বদল যে কেবল পুরুষের ক্ষেত্রে তা নয়, নারীদের ক্ষেত্রেও। ‘বুক ফাঁটলেও মুখ ফুটে না’ বলে বাঙালি নারীর যে পরিচয়টি আমাদের কাছে বাঁধানো ছবির মতো ছিল তা সবার অলক্ষ্যে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে আরজে কিবরিয়ার একটি শো-তে এ লোকের জীবনের গল্প শুনে হতভম্ভ হয়ে গেলাম। উচ্চবিত্তের এক নারী টাকা দিয়ে তাকে ভাড়া করে নিয়ে যেত ফ্লাটে। তারপর তাকে উচ্চ মাত্রায় স্টেরয়েড খাইয়ে পাশবিক লালসা চরিতার্থ করত অস্বাবাবিক লম্ব সময় ধরে। পরে তার আরেক বান্ধবীকেও জুটায়। ত্রি-মাত্রিক এ পাপে বহুদিন স্টেরয়েড সেবনের ফলে সেই পুরুষবেশ্যাটি এখন পঙ্গু। বাঙালি মেয়েদের অনেকে আজ স্বেচ্ছায় সেক্স পার্টি বা হোটেলবাস করতে দ্বিধা করে না। কেউ কেউ পর্নোস্টার সাজতে চায় স্বেচ্ছায়।


অনেকে ধর্মীয় মূল্যবোধের অবনমনকে দায়ী করবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের ধর্মচর্চা লেবাসি বিষয় হয়ে গেছে। ধর্মাচার পালন কিংবা সুরতসর্বস্বতা ধর্ম নয়। সুরত আর সিরাত এক কথা নয়। আমাদের সুরত আছে সিরাত নেই। একজন প্রকৃত ধার্মিক মানুষ সবার অলক্ষ্যেও কোনো অপরাধ করতে পারে না। কারণ সে বিশ্বাস করে তার সকল ক্রিয়াকলাপ আল্লাহ অদৃশ্য চোখে দেখছেন। আসলে আমাদের সকল ধর্মাচার লোকদেখানো। আমাদের লেবাস ভণ্ডামিমাত্র। সিলেটের ঘটনাসহ প্রায় সব ঘটনায় দেখা যায়, অপরাধীদের মুখে সুন্নতি দাড়ি। নিয়মিত নামাজ পড়ার রেকর্ডও আছে অনেকের। সমাজে এত নামাজি, এত শ্মশ্রুধারী, আলখাল্লা ও টুপিশোভিত মানুষ থাকার পরেও এত এত অপরাধ কেনো? মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, মাদ্রাসার শিক্ষক, কপালে দাগপড়া মানুষেরা বলাৎকার ও ধর্ষণ করে কেনো? কওমি মাদ্রাসার খবর নিয়ে দেখুন শতকরা কয়টি এতিম-অনাথ-অসহায় ছেলে শিশু যৌননির্যাতন থেকে রক্ষা পায়। কোনো মানুষ প্রকৃত নামাজি হলে তার দ্বারা কোনো অন্যায় অপকর্ম করা সম্ভব নয়। আল্লাহ বলেছেন, ‘ইন্নাস সালাতা তানহা-আনিল ফাহ শাই ওয়াল মুনকার।’(সুরা আনকাবুত আয়াত ৪৫নং) অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও মন্দকাজ হতে বিরত রাখে।’ যে মানুষটি নামাজ পড়ে এবং একই সাথে অন্যায় অপকর্ম করে বুঝতে হবে তার নামাজ পুরাই ফক্কিকার। আমাদের সমাজ চলছে ফক্কিকারের ওপর।

তিনিই প্রকৃত ধার্মিক যিনি আল্লাহকে ভয় করেন। তিনি আল্লাহর সর্বত্রগামী দৃষ্টির কথা স্মরণ করে নিজেকে অন্যায় থেকে দূরে রাখে। আমাদের সমাজে ধার্মিকের ভিড়ে খোদাভীরু মানুষের দেখা পাওয়া যায় না। ফলে ধর্ম ও অধর্ম চলে এক সাথে।
মাদক ও পর্নো বন্ধ করা না গেলে এবং মানুষের মনে খোদাভীরুতার চেতনা না জাগাতে পারলে দেশে ধর্ষণ ও নারীনিপীড়ন বন্ধ হবে আমি অন্তত বিশ্বাস করতে পারি না। মৃত্যুদণ্ডাদেশও বিকৃত মানুষের শিশ্নদণ্ড নিয়নিয়ন্ত্রণে কতখানি ভূমিকা রাখবে তা বলা যাচ্ছে না।

জেন্ডার বিদ্যায় Toxic masculinity বলে একটি কথা আছে। এর শাব্দিক অর্থ বিষাক্ত পৌরুষ। পুরুষের এই বিষে আমাদের নারীরা আর কতকাল যে দংশিত হবে তা কেবল ওপরওয়ালাই জানেন।

আমরা সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতায় বিশ্বাসী, পাঠকের আস্থাই আমাদের মূলধন

১৮ অক্টোবর ২০২০ খ্রি. ০২ কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, ৩০ সফর ১৪৪২ হিজরি, রোববার