ইকোনমিক হিটম্যান : পর্ব-১

মূল : জন পার্কিন্স
অনুবাদ ও সম্পাদনা : জালাল কবির, টরন্টো, কানাডা

ইকুয়েডরের রাজধানী ‘কুইটো’ আন্দিজ পর্বতমালার নয় হাজার ফিট উচুতে আগ্নেয়গিরির উপত্যকার পাশে লস্বালম্বি ভাবে প্রসারিত। শহরটি কলম্বাসের আমেরিকা আগমনের অনেক আগে প্রতিষ্ঠিত এবং এর বাসিন্দারা আশেপাশের পর্বত চুড়ায় বরফ দেখতে অভ্যস্ত। যদিও বিষুব রেখার দক্ষিনে মাত্র কয়েক মাইল দুরে তাদের বসবাস।

‘শেল-শহর’ সীমান্ত-সংলগ্ন একটি পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়ি এবং সামরিক ছাউনী যা ইকুয়েডরের আমাজনের জঙ্গল কেটে নির্মিত। এসবই তেল কোম্পানীর সেবায় নিয়োজিত, এলাকাটি যার নাম বহন করছে। এর অবস্থান কুইটো শহর থেকে প্রায় আট হাজার ফুট নিচে। একটি বাষ্প-সমৃদ্ধ শহর। যার অধিকাংশ অধিবাসীই সৈন্য, তেল-শ্রমিক আর সুয়ার্স এবং কিচওয়া গোত্রের (দেশজ) আদিবাসী, যারা বেশ্যাবৃত্তি আর শ্রম দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে।
এক শহর থেকে আরেক শহরে ভ্রমন করতে হলে আপনাকে এমন একটি রাস্তা দিয়ে যেতে হবে যা জটিলভাবে প্যাঁচানো এবং শ্বাসরুদ্ধকর! স্থানীয় লোকেরা আপনাকে বলবে, যাত্রাপথে একই দিনে আপনি চারটি ঋতুরই স্বাদ পাবেন।

যদিও আমি এই পথে বহুবার যাওয়া আসা করেছি, আমি এর আকর্ষনীয় সব নৈসর্গিক শোভায় কখনও ক্লান্তিবোধ করিনি। সমুদ্রের কিনারায় একদিকে উঁচু পাহাড়ের সারি। আরেকদিকে খাঁড়ি নিচে সোজা নেমে গেছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় পাহাড়ী ঝরনা জলপ্রপাতের মত বয়ে চলে। একদিকে উজ্জল ব্রোমেলিয়ালেস পুষ্পলতার সারি মাথা উঁচু করে আছে। অন্যদিকে মনে হয় ভুপৃষ্ঠ আকষ্মিকভাবে অতল গহŸরে পতিত হয়েছে। যেখানে আমাজনের উৎসের দিকের পাস্টাসা নদী আন্দিজ পর্বতমালা থেকে নিচে পা টিপে টিপে আসে। কটোপাক্সি হিমবাহ থেকে পাস্টাসা পানি বয়ে নিয়ে আসে। এটি পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ সক্রিয় আগ্নেয়গিরি এবং আদিবাসি ‘ইনকাদের’ সময়ে সে ছিল একজন দেবতা। দীর্ঘ তিনহাজার মাইল পথ অতিক্রম করে সে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে মিলিত হয়।

২০০৩ সালে আমি কুইটো থেকে সুবারো মটর গাড়িতে চেপে ‘শেল শহরে’ এমন একটি মিশন নিয়ে এসেছিলাম, যার মত অপ্রিয় দায়িত্ব আমি এর আগে আর কখনও গ্রহন করিনি। আমার আশা এমন একটি যুদ্ধের অবসান, যার সুচনায় আমি নিজেই সহযোগিতা করেছিলাম। অন্য অনেক কিছুর সাথে এটাও এমনি একটা দায়িত্ব যা ‘ইকোনোমিক হিট ম্যান‘ (অর্থনীতির ঘাতক) হিসেবে আমাদের অবশ্যই পালন করতে হয়।

এটি এমন একটি যুদ্ধ, যেখানে সংঘটিত হয় তা দেশের বাইরে এবং যেকোন জায়গায়, প্রকৃতপক্ষে অদৃশ্য। আমি সুয়ার্স, কিচওয়া এবং তাদের প্রতিবেশী, আছুয়ার্স, জাপোরাস, ও সিউইয়ার্সসহ অন্যান্য দেশজ গোত্রভুক্ত আদিবাসীদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলাম। যারা তাদের বাড়ি, পরিবার, এবং ভুমি-সম্পদ তেল কোম্পানির ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে দৃঢ় সংকল্প। এমনকি এতে যদি তাদের প্রাণত্যাগও করতে হয়, তারা পিছপা হবে না। তাদের জন্য এ সংগ্রাম, তাদের সন্তান ও সংস্কৃতির বাঁচানোর সংগ্রাম। আর আমাদের জন্য এ সংঘর্ষ হল ক্ষমতা, অর্থ, এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কিত। পৃথিবীকে পদানত করে রাখার সংগ্রামের একটি অংশ। যা সামান্য কয়েকজন লোভী ব্যক্তির স্বপ্ন, বিশ্বব্যাপি সাম্রাজ্য!

আমরা যারা ইকোনোমিক হিটম্যান, এ কাজটাই সবচাইতে ভালো পারি; আমরা একটি বিশ্বব্যাপি সা¤্রাজ্য গড়ে তুলি। আমরা মহিলা-পুরুষের সম্মিলিত একটি এলিট-শ্রেণী। আমরা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংগঠনগুলিকে ব্যবহার করে পরিবেশ ও শর্ত নিবন্ধে ইন্ধন যোগাই। যাতে অন্যান্য জাতিরা যৌথ সংস্থাতন্ত্র (ঈড়ৎঢ়ড়ৎধঃড়পৎধপু) আমাদের বৃহত্তর কোম্পানি, আমাদের সরকার, এবং আমাদের ব্যাংক সমুহের পরিচালক, তার অধীনে চলে আসে। মাফিয়ার মতই আমরা হিটম্যানরা (লুটেরা গোষ্ঠির দল) বিভিন্ন অনুগ্রহ ও সুবিধা বিতরন করি, যেমন অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুত উৎপাদন-প্রতিষ্ঠান, মহাসড়ক-নির্মান, নৌবন্দর, বিমানবন্দর, বা শিল্পাঞ্চল গঠনের জন্য ঋণ। এই সব ঋণ গ্রহনের শর্তাবলী হল: ইঞ্জিনিয়ারিং এবং নির্মাতা কোম্পানী সবই আমাদের দেশ থেকে নিতে হবে এবং তারাই এসব প্রকল্প নির্মান করবে। সংক্ষেপে, ঋণের অধিকাংশ টাকা কখনও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যায় না। সহজ-সরল পথে এই অর্থ ওয়াশিংটনের বিভিন্ন ব্যাংকের অফিস থেকে নিউ ইয়র্ক, হিউস্টন, বা সান ফ্রান্সিসকোর ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসগুলিতে স্থান বদল করে।

ঋণ-মঞ্জুরির প্রায় সাথে সাথেই টাকা কার্পোরেশনগুলিতে ফিরে আসে, যারা সবাই কর্পোটোক্রেসির সদস্য। এ বাস্তব-সত্যটি সত্তে¡ও ঋণগ্রহিতা দেশকে সমস্ত ঋণই শোধ করতে হয়, আসল এবং সুদ। একজন হিটম্যান যদি পুরোপুরি সফল হয়, ঋণের পরিমান এতই বেশি হয়ে থাকে যে ঋণগ্রহিতা কয়েক বছর পরই ঋণখেলাপি হতে বাধ্য হয়। এটা ঘটার পর, মাফিয়ার মতই আমরা আমাদের পাওনা ‘মাংশখন্ড‘ দাবী করি। প্রায়শই এর মধ্যে নি¤œবর্ণিত এক বা একাধিক দাবী অন্তর্ভুক্ত থাকে। জাতিসংঘে ভোটাভুটির সময় আমাদের নিয়ন্ত্রন, সামরিক-ঘাটি গঠনের নিশ্চয়তা, বা জ্বালানি তেলের মত মুল্যবান সম্পদ উত্তোলনে আমাদের অগ্রাধিকার, বা পানামা খালের উপর আমাদের কর্তৃত্ব। অবশ্য, দেনাদার তারপরও আমাদের কাছে ঋণী থাকে- এভাবেই আরেকটি দেশ আমাদের বিশ্বব্যাপি-সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

আজ ২০০৩ সালের একটি সুর্যালোকিত দিনে কুইটো থেকে শেলের দিকে গাড়ি চালাচ্ছি এবং পেছনে ফিরে দেখছি- পৃথিবীর এই অংশে আমি ৩৫ বছর আগে প্রথমবার এসেছিলাম। আমি জানতাম যদিও ইকুয়েডর আকারে মাত্র আমাদের নেভাদা রাজ্যের মত, এখানে রয়েছে ত্রিশটিরও বেশি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। পৃথিবীর সমগ্র পক্ষী-প্রজাতির ১৫% এর বসবাস এখানে। হাজার হাজার বৃক্ষ-লতাপাতা আছে যাদের এখনও সনাক্ত করা হয়নি। এ দেশটি বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি-সমৃদ্ধ। যেখানে স্পেনীশভাষীদের সংখ্যা, প্রাচীন দেশজ ভাষায় যারা কথা বলে, তাদের সমান। দেশটির পরিবেশ আমার কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয় এবং অবশ্যই চমকপ্রদ ছিল। ঐ সময়ের যেসব শব্দ আমার মনে ভেসে আসছিল, এগুলো হল- খাঁটি, অস্পর্স এবং নিষ্পাপ।

গত ৩৫ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে।

১৯৬৮ সালে আমার প্রথম সফরের সময়, ‘টেক্সাকো’ সবেমাত্র ইকুয়েডরের আমাজন অঞ্চলে পেট্রল আবিস্কার করেছিল। বর্তমানে দেশটির প্রায় অর্ধেক বিদেশী মুদ্রা, জ্বালানি তেল রপ্তানি থেকে আসে। আমার প্রথম সফরের কিছুদিন পরেই একটি আন্ত-আন্দিজ পাইপলাইন নির্মান করা হয়। তারপর থেকে পাঁচ লক্ষ ব্যারেল তেল নাজুক বৃষ্টিপ্রধান ক্রান্তীয় জঙ্গলে (জধরহ ভড়ৎবংঃ) এ লাইনের ফুটা থেকে নির্গত হয়েছে। যা ‘এক্সন ভাল্ডেজের’ চুয়ে যাওয়া তেলের দ্বিগুনেরও বেশি। এখন ‘ইকোনোমিক হিটম্যান’ সংগঠিত একটি কনেসোর্টিয়াম (সমমনা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী সংস্থা) ১.৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তিনশ-মাইল দীর্ঘ নতুন একটি পাইপলাইন নির্মান করেছে। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর প্রধান দশটি তেল সরবরাহকারী দেশের মধ্যে ইকুয়েডরকে অন্তর্ভুক্ত করার অঙ্গীকার করেছে। এই তেল উত্তোলনের কারণে ‘ক্রান্তীয়-জঙ্গলে‘র একটি বৃহৎ অংশ অদৃশ্য হয়ে গেছে। সমস্ত মাকওয়া এবং জাগুয়ার বিলীন। তিনটি দেশজ ইকুয়েডরের আদিবাসী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে। প্রিস্টিন নদীকে জ্বলন্ত নোংরা ভাগাড়ে বদলে দেয়া হয়েছে।

একই সময়ে, দেশজ আদিবাসিরা তাদের অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য পাল্টা সংগ্রাম শুরু করে। যেমন ২০০৩ সালের ৭ই মে, আমেরিকার আইনজীবিদের একটি দল, ত্রিশ হাজারেরও বেশি ইকুয়েডর-আদিবাসিদের প্রতিনিধি হিসেবে শেভ্রন-টেক্সাকো গ্রæপের বিরুদ্ধে এক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপুরন মামলা রুজু করে। এ মামলায় বলা হয়, ১৯৭১ এবং ১৯৯২ সালের মধ্যে এই বৃহৎ তেল-কোম্পানি খোলা গর্তে এবং নদীতে প্রতিদিন চার মিলিয়ন গ্যালনেরও বেশি পরিমান বিষাক্ত বর্জ্য নিক্ষেপ করেছে। এসব আবর্জনায় রয়েছে দুষিত তেল, ভারী ধাতু, ক্যান্সার-উৎপাদক, তদুপরি কোম্পানি প্রায় ৩৫০টি বর্জ্য-গহŸর আবরনমুক্ত করে ফেলে চলে গেছে। যার ফলে মানুষ এবং প্রাণী উভয়েই মৃত্যুবরন করছে।

আমার গাড়ির জানালার বাইরে বিশাল কুয়াশার মেঘ, বন থেকে বেরিয়ে এসে পাস্টাসা নদীর গভীর গিরিখাতের উপরে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার শার্ট ঘামে ভিজে গেছে এবং পাকস্থলী ক্ষুধায় চিন চিন করছে। তবে শুধুমাত্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় তীব্র গরম বা সরীসৃপের মত আঁকাবাঁকা রাস্তার জন্য নয়, এই সুন্দর দেশটি ধ্বংস করার পেছনে আমার ভুমিকা স্মরন করে আবার ব্যাথায় দগ্ধ হচ্ছি। এ দেশটিকে যখন আমরা আধুনিক অর্থনীতির ইন্দ্রজাল, ব্যাংকিং, এবং কারিগরী মায়াজালের স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম, সেই সময়ের ইকুয়েডর আজ ইকোনোমিক হিটম্যানের (অর্থ লুটেরাদের) সহকর্মী এবং আমার বদৌলতে এই ভয়ানক দুর্দশার সম্মুখীন। ১৯৭০ সাল থেকে যে সময়টিকে বাখ্যান করে ‘তেলের বাজারের তেজী ভাব‘ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, সরকারি হিসেবেই তখন দারিদ্র্য ৫০ ভাগ থেকে ৭০ ভাগে বর্দ্ধিত হয়েছিল। যোগ্যতার হিসেবে নি¤œ-নিযুক্তি, বা বেকারত্বের হার ১৫% থেকে ৭০%, এবং জাতীয় ঋণ ২৪০ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছিল। ইতিমধ্যে, জনসংখ্যার দরিদ্রতম অংশের জন্য জাতীয় সম্পদের বন্টন ২০% থেকে ৬% এ নেমে গেছে।

দুর্ভাগ্যক্রমে, ই্কুয়েডর কোনো ব্যতিক্রম নয়। প্রায় সমস্ত দেশই যাদের আমরা হিটম্যানরা বৈশ্বিক-সা¤্রাজ্যের ছত্রছায়ায় নিয়ে এসেছি, একই ধরনের ভাগ্যের শিকার। তৃতীয় বিশ্বের ঋণের পরিমান ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এসব শোধ করার খরচ, সুদ এবং প্রশাসনিক- ২০০৪ সালের হিসেবে প্রতি বছর ৩৭৫ বিলিয়ন ডলারেরও উপরে। এই পরিমানটি তৃতীয় বিশ্বের সমস্ত দেশের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতে খরচের চাইতে বেশি। উন্নয়নশীল দেশগুলি প্রতি বছর বাৎসরিক ‘বিদেশী-অনুদান‘ হিসেবে যে অর্থ পেয়ে থাকে তার বিশ গুণ। পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেকের চাইতে বেশি মানুষ দৈনিক মাত্র দুই ডলারে জীবিকা নির্বাহ করে। মোটামুটিভাবে ১৯৭০ দশকে যে পরিমান তারা মাথাপিছু পেত। ইতিমধ্যে, তৃতীয় বিশ্বের ১% সর্বোচ্চ শ্রেণীভুক্ত পরিবার ৭০% থেকে ৯০% স্ব স্ব দেশের ব্যক্তিগত অর্থসম্পদ এবং স্থাবর সম্পত্তির মালিক। সঠিক শতকরা হিসাব নির্দিষ্ট দেশটির উপরে নির্ভরশীল।

ছুটি কাটানোর সুন্দর শহর ‘বানোসের’ রাস্তায় রাস্তায় এদিক ওদিক ঘোরার সময় গাড়ির গতি হ্রাস পেল। এখানকার উষ্ণ ¯œানাগার খুবই বিখ্যাত, যা ভুগর্ভস্থ আগ্নেয়গিরি-নদী থেকে উৎসারিত। অত্যন্ত সক্রিয় পাহাড় টুঙ্গুরাহগুয়া থেকে সে বয়ে আসে। দু‘পাশে শিশুরা দৌড়াদৌড়ি করছে। হাত নেড়ে তারা আমাদের কাছে লজেন্স, বিস্কুট বিক্রি করতে চায়। আমরা বানোস পেছনে ফেলে এলাম। স্বর্গ থেকে দ্রæত গতিতে চলে আসার পর চিত্তাকর্ষক দৃশ্যাবলী হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল। আমরা প্রবেশ করলাম দান্তের আধুনিক অন্তর্দৃষ্টি ইন্ফার্নোতে (জলন্ত অগ্নিকুন্ড)।

নদী থেকে একটি সুবিশাল দৈত্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, একটি প্রকান্ড ধুসর দেয়াল। এর গা থেকে যে কংক্রিটের চর্বি নির্গত হচ্ছে, তা এখানে সম্পূর্ণ বেমানান। পুরোপুরি অস্বাভাবিক এবং নৈসর্গিক প্রেক্ষাপটে মোটেই খাপ খায় না। অবশ্য, এখানে এই বস্তুটি দেখে আমি মোটেও বিষ্মিত হইনি। আমি সারা যাত্রাপথে অবগত ছিলাম, এই দৈত্য ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করে আছে। এই ধরনের দৃশ্যের মুখোমুখি আমি আগে বহুবার হয়েছি এবং অতীতে ইকোনোমিক হিটম্যানের সাফল্যের প্রতীক হিসেবে আমি এর প্রশংসাও করেছি। যাইহোক, এখন আমার গায়ের চামড়া শিউরে ঊঠছে।

এই কদাকার, সঙ্গতীবিহীন দেয়ালটি হল একটি বাঁধ। যে ¯্রােতস্বিনী পাস্টাসা নদীর গতিরোধ করছে। বড় বড় টানেলের ভেতর দিয়ে তার পানির ¯্রােতকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। টানেলগুলি পাহাড়ের গা খুঁড়ে বানানো হয়েছে। এর ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তা বিদ্যুতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এটা ১৫৬-মেগাওয়াট আগোয়ান পানি-বিদ্যুত প্রকল্প। এই বিদ্যুত কল-কারখানায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহ্্রত হয়ে ইকুয়েডরের হাতেগোণা কিছু পরিবারকে ঐশ্বর্যশালী করেছে। কৃষক এবং দেশজ আদিবাসী যারা নদীর দু’দিকে বাস করে, এই বাঁধ তাদের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রনার কারন। পানি-বিদ্যুত প্ল্যান্টটি আমার প্রচেষ্টায় বাস্তবায়িত অনেকগুলি প্রকল্পের একটি। এতে অন্যান্য ইকোনোমিক হিটম্যানেরও অবদান রয়েছে। এই প্রকল্পগুলির কারনেই আজ ইকুয়েডর বৈশ্বিক-সা¤্রাজ্যের সদস্য। সাথে সাথে সুয়ার্স এবং কিচওয়া এবং তাদের প্রতিবেশীরা কেন আমাদের তেল কোম্পানীগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দেয়, তারও কারন ইকোনোমিক হিটম্যান প্রকল্পগুলির জন্য।

ইকুয়েডর বৈদেশিক ঋণে আকন্ঠ ডুবে আছে। এইসব ঋণ শোধ করার জন্য দেশটি জাতীয় বাজেটের একটি অপরিমিত অংশ হ্রাস করতে বাধ্য। এই পুঁজি তার লক্ষ লক্ষ দেশবাসী যারা সরকারিভাবে ভয়ানকভাবে দরিদ্র বলে শ্রেণীভুক্ত, তাদের সাহায্যে ব্যয় করে না। বৈদেশিক ঋণ-পত্রগুলি কিনে নেবার জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইকুয়েডরের মাত্র একটিই উপায় আছে। আর তা হলো তেল কোম্পানিগুলির কাছে ‘ক্রান্তীয়-জঙ্গল’ (জধরহভড়ৎবংঃ) বেঁচে দেয়া। অবশ্য, কেন ‘ইকোনোমিক হিটম্যানের’ লোকজন ইকুয়েডরের উপর অগ্রাধিকারের প্রথম ধাপে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল, তার একটি কারন; এ দেশের আমাজন-অঞ্চলের নিচে তেলের সাগর। যা মধ্যপ্রাচ্যের তেল-ক্ষেত্রগুলির চাইতেও বেশি সমৃদ্ধ বলে বিশ্বাস করা হত। যার ফলে বৈশ্বিক-সা¤্রাজ্য তার ‘মাংশ-খন্ডের‘ অংশ দাবী করে। আর এটার রূপ হল ‘তেলের-বিশেষ সুবিধা-প্রদান‘।

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের পর এই সব দাবী আরও বিশেষভাবে জরুরি হয়ে গেল। ওয়াশিংটনের তখন ভয়, হয়ত মধ্যপ্রাচ্যের (তেলের) সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। এইসব দাবী পেশ করার তালিকায় এক নম্বর ছিল ভেনিজুয়েলা, আমাদের তৃতীয় বৃহত্তম তেলের যোগানদার। সম্প্রতি এ দেশে একজন লোকপ্রিয় প্রেসিডেন্ট, হুগো শেভেজ নির্বাচিত হয়েছে। সে একটি কঠোর অবস্থান নিয়েছে যাকে সে ‘মার্কিনি-সা¤্রাজ্যবাদ‘ বলে আখ্যায়িত করে। সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেল বিক্রি বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে। ইকোনোমিক হিটম্যানরা ইরাক এবং ভেনিজুয়েলাতে ব্যর্থ হয়েছে, কিন্ত আমরা ইকুয়েডরে সফল হয়েছি। এখন যতটা সম্ভব বেশি পরিমানে আমাদেরকে এই দুগ্ধ দোহন করতে হবে ।

সারা পৃথিবীতে ইকুয়েডর একটি আজব দেশ, যাকে ইকোনোমিক হিটম্যান ‘অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক‘ খোঁয়াড়ে পরিনত করেছে। ইকুয়েডরের ‘ক্রান্তীয়-জঙ্গল‘ থেকে উত্তোলিত প্রতি ১০০ ডলার মুল্যের অশোধিত তেলের মধ্যে তেল কোম্পানিগুলি ৭৫ ডলার পেয়ে থাকে। বাকি ২৫ ডলারের মধ্যে চারভাগের তিনভাগ ব্যয় হয় বৈদেশিক ঋণ শোধ করার জন্য। যা থাকলো, তার অধিকাংশই সামরিক এবং অন্যান্য সরকারি খাতে খরচ হয়। শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং দারিদ্র-দুরীকরন কর্মসুচির জন্য থাকে মাত্র ২.৫০ ডলার। এভাবেই আমাজনকে (আমাজন নদীর দেশগুলো) ছিড়েখুঁড়ে প্রাপ্ত প্রতিটি ১০০ ডলারে জনসাধারনের জন্য থাকে মাত্র ৩ ডলারেরও কম। অথচ এই দরিদ্র জনগণের জন্য এই অর্থের প্রয়োজন সবচাইতে বেশি। যাদের জীবন এই বাঁধ, তেল খোঁড়াখুঁড়ি, পাইপলাইনের জন্য আজ বিপরীতমুখী সংঘর্ষের সামনাসামনি। যারা আজ ভেষজ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে মৃত্যুবরন করছে।

এইসব জনসাধারন ইকুয়েডরে যারা সংখ্যায় লক্ষ লক্ষ, সারা গ্রহে বহু বিলিয়ন- এরা সবাই সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদি।
এ কারনে নয় যে তারা কম্যুনিজম বা নৈরাজ্যবাদে বিশ্বাস করে, বা অন্তর্নিহিতভাবে পাপী। কিন্ত শুধুমাত্র এ কারনে যে তারা ‘বেপরোয়া’। এ বাঁধের দিকে তাকিয়ে আমি তাজ্জব বনে গেলাম- যেভাবে আমি প্রায়ই সারা পৃথিবীর অনেক জায়গাতে বিষ্ময় বোধ করেছি। তখন এই জনতা সক্রিয় হয়ে উঠে, যেমন; ১৭৭০ সালে আমেরিকানরা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বা ১৮৮০ সালের প্রথম দিকে ল্রাটিন আমেরিকায় স্পেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়েছিল।

এই আধুনিক সা¤্রাজ্য-নির্মানের সুক্ষèদর্শিতা রোমান সেন্টুরিয়ন্স, স্পেনীশ কনকুইস্টার্ডোস, অষ্টাদশ- এবং উনবিংশ শতাব্দির ইউরোপিয়ান উপনিবেশবাদি শক্তিদের লজ্জা দেয়। আমরা ‘ইকোনোমিক হিটম্যানরা’ ধুরন্ধর কৌশলী এবং শঠ। আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আজ আমরা তলোয়ার নিয়ে কোথাও অনুপ্রবেশ করি না। আমাদের গায়ে কোন বর্ম থাকে না, বা এমন কোনো কাপড় পরিধান করিনা যা আমাদের জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে। ইকুয়েডর, নাইজেরিয়া, এবং ইন্দোনেশিয়ার মত দেশে আমরা স্থানীয় স্কুল-শিক্ষক বা দোকানদারদের মত পোষাক পরিধান করি। ওয়াশিংটন এবং প্যারিসে আমাদের রূপ সরকারি আমলা এবং ব্যাংকারদের মত। পূর্ণ বিনয়ের সাথে ও স্বাভাবিকভাবে আমরা চলাফেরা করি। আমরা প্রকল্পের স্থান পরিদর্শন করি; দারিদ্র-প্রপীড়িত গ্রামে ঘুরে বেড়াই। আমরা পরহিতব্রত প্রচার করি। স্থানীয় পত্র-পত্রিকার সাথে আমরা যে সব চমৎকার মানবিক কাজকর্ম করছি তা নিয়ে আলাপ করি। বিভিন্ন সরকারি কমিটির কনফারেন্স টেবিলে আমরা অংশ নেই। সাথে থাকে আমাদের বিস্তারীত কর্মসুচি এবং আর্থিক সহায়তার প্রক্ষেপন। আমরা হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে ‘বৃহৎ-অর্থনীতির‘ যাদুকরী সাফল্যের উপর বক্তৃতা দেই। আমরা নথীতে আছি, খোলা জায়গাতেও থাকি। এভাবেই আমরা আমাদের চিত্রকে পেশ করি এবং এভাবেই আমাদেরকে গ্রহন করা হয়ে থাকে। এই হল, ‘পদ্ধতি কেমনভাবে কাজ করে তারই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা’।

ঝামেলা বা অপ্রীতিকর কিছু এড়ানোর জন আমরা কদাচিৎ কোনো বেআইনি পথের আশ্রয় নিয়ে থাকি, কারন পদ্ধতিটি স্বয়ং ছল-চাতুরী দিয়ে তৈরি। যাইহোক, এটা অত্যন্ত বড় আকারের কার্যধারা মুলতবী রাখার প্রক্রিয়া। আমাদের যদি পতন হয়, তখন বরং আরও বড় ধরনের অশুভ প্রজাতির আবির্ভাব ঘটে। এদেরকে আমরা ইকোনোমিক হিটম্যানেরা ‘ধূর্ত শৃগাল’ বলি। সেইসব প্রাচীন সা¤্রাজ্যের মধ্যে এরা সরাসরি তাদের উত্তরাধিকার খোঁজে। শৃগালেরা সদাই বিরাজ করে, ছায়ার মধ্যে ওত পেতে থাকে। তাদের যখন আবির্ভাব হয়, রাষ্ট্র প্রধানরা ক্ষমতাচ্যুত বা তারা হিং¯্র ‘দুর্ঘটনায়‘ নিহত হন। হঠাৎ যদি শৃগালরা ব্যর্থ হয়, যেমন তারা আফগানিস্থান এবং ইরাকে ব্যর্থ হয়েছে. তাহলে পুরোনো মডেলদের পুনরাবির্ভাব হয়। যখন শৃগালেরা ব্যর্থ হয়, (তখন আবারো নতুন কৌশলে) তরুন আমেরিকানদের হত্যা করতে এবং নিহত হতে পাঠানো হয়।

আমি যখন দৈত্যটাকে (বিশাল বাঁধ) পাশ কাটিয়ে গেলাম, নদী থেকে উত্থিত সেই ধুসর রঙের কংক্রিটের বিশাল বেঢপ দেয়াল, ঘামে ভিজে যাওয়া আমার গায়ের কাপড়ের জন্য আমি খুবই সচেতন হয়ে গেলাম। সাথে পেটের নাড়িভুঁড়ির শক্ত হয়ে যাবার অনুভুতিও ছিল। আমি মাথা নিচু করে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে আদিবাসি জনতার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এই সা¤্রাজ্য, যার স্থাপনায় আমার সহযোগিতা ছিল, তার অবসান না হওয়া অবধি যারা শেষ ব্যাক্তিটি বেঁচে থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দৃঢ় সংকল্প। আমি অপরাধবোধে নিমজ্জিত হয়ে গেলাম।
নিজেকে প্রশ্ন করি, নিউ হ্যাম্পশায়ারের একটি শান্তশিষ্ট শিশু হয়ে এই ধরনের অপরিচ্ছন্ন ব্যবসায়ে আমি নিজেকে আদৌ কিভাবে যুক্ত করেছি ?

প্রথম পর্ব
১৯৬৩-১৯৭১

অধ্যায়-১
একজন ইকোনোমিক হিটম্যানের জন্ম

নিতান্তই নিষ্পাপভাবে এর শুরু হয়েছিল।
১৯৪৫ সালে মধ্যবিত্ত এক পরিবারে আমি একমাত্র সন্তান হিসেবে জন্ম নিয়েছিলাম। আমার বাবা-মা দুজনেই তিন শতাব্দির নিউ ইংলন্ডের ইয়াংকি গোত্রভুক্ত। তাদের কঠোর, নীতিকৌশল, গোঁড়া রিপাবলিকান মনোবৃত্তি থেকে সদাই শুদ্ধিবাদী নীতিবাগিশ পুর্বপুরুষদের আজন্ম লালিত আচরন প্রতিফলিত হত। তাদের পরিবারে তারাই বৃত্তি নিয়ে প্রথম কলেজে পড়াশুনা করেন। আমার মা হাই স্কুলের ল্যাটিন-শিক্ষয়িত্রী হয়েছিলেন। বাবা নেভী-লেফটেনান্ট হিসেবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি আটলান্টিক মহাসাগেরে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত বানিজ্যিক সামুদ্রিক ট্যাংকারের সশস্ত্র প্রহরীদের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নিউ হ্যাম্পশায়ারের হ্যানোভারে যখন আমার জন্ম হয়, বাবা সে সময় টেক্সাস হাসপাতালে তার ভগ্ন কোমরের চিকিৎসায় সুস্থ হচ্ছিলেন। আমার বয়স এক বছর না হওয়া পর্যন্ত আমি তাকে দেখিনি।

টিল্টন স্কুলে তিনি ভাষা শিক্ষা দেবার একটি চাকুরি নিলেন। নিউ হ্যাম্পশায়ারের উপকন্ঠে এটি ছিল ছেলেদের একটি আবাসিক স্কুল। গর্বের সাথে মাথা উঁচিয়ে একটি পাহাড়ের উঁচুতে স্কুল ক্যাম্পাস দাঁড়িয়ে ছিল। কেউ কেউ বলত, উদ্ধতের মত। স্কুলটি ছিল একই নামের, শহরের সুউচ্চ শিরোপা। এই বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি গ্রেড-লেভেল ছিল ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ ক্লাস পর্যন্ত। ছাত্রের সংখ্যা ৫০ জন করে সীমাবদ্ধ ছিল। ছাত্রদের অধিকাংশই ছিল বুয়েন্স আয়ার্স, কারাকাস, বোস্টন, এবং নিউইয়র্কের সম্পদশালী পরিবারের অভিজাত সন্তান।

আমাদের পরিবারের আর্থিক সংকট ছিল- যদিও খুবই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমরা নিজেদেরকে কখনই দরিদ্র হিসেবে দেখতাম না। অবশ্য স্কুুলের শিক্ষকরা খুবই সামান্য বেতন পেতেন। যা আমাদের প্রয়োজন, সবই আমাদেরকে বিনামুল্যে দেয়া হত যেমন; খাবার, বাড়ি, ঘর গরম করার হিটার, পানি ইত্যাদি। এছাড়া যেসব কর্মীরা আমাদের উঠোনের ঘাস কাটত এবং বেলচা দিয়ে বরফ সাফ করত, তাদের বেতন। আমার চার বছর বয়েস থেকে আমি স্কুলের খাবার ঘরে খাওয়া শুরু করি। আমি ফুটবলের পরিচর্যা করতাম। আমার বাবা ছিলেন স্কুল ফুটবল টিমের কোচ। খেলোয়াড়দের কাপড় বদলানোর ঘরে আমি তোয়ালে এগিয়ে দিতাম।

স্কুলের শিক্ষক এবং তাদের স্ত্রীরা যে স্থানীয়দের চাইতে নিজেদের অনেক বড় মনে করতেন, কথাটি নিতান্তই সত্য। গরিব চাষী আর দরিদ্র শহরবাসীদের উপর রাজত্ব করা সামন্তবাদি প্রভুদের মত আমার বাবামার ঠাট্টা তামাশায় আমি অভ্যস্ত ছিলাম। আমি জানি এটা রসিকতার চাইতেও একটু বেশি বাড়াবাড়ি। আমার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুল-বন্ধুরা ছিল এই কৃষক শ্রেনীর, খুবই গরিব। তাদের বাবা-মা নোংরা কৃষক, কাঠ চেরাই করা করাতি, এবং কারখানার শ্রমিক। তারা পাহাড়ের উপরে “প্রিপারেটরি স্কুলের” ছাত্র-শিক্ষকদের উপর ছিল অসন্তÍষ্ট; অপরদিকে আমার বাবা-মা শহরের মেয়েদের সাথে মেলামেশা করতে আমাকে নিরুৎসাহ করতেন। যাদেরকে তারা বলতেন, ‘অশিষ্ট’ এবং ‘নোংরা’। আমি এসব মেয়েদের সাথে অবশ্য ক্লাস-ওয়ান থেকেই স্কুলের বই-পত্র, চকখড়ি আদান প্রদান করতাম। পরবর্তী বছরগুলিতে আমি তাদের তিনজনের সাথে প্রেমও করেছিঃ এ্যান, প্রিসীলা, এবং জুডি। বাবা-মার অবস্থান ও ভাবনা-চিন্তা বুঝতে আমার খুব কঠিন সময় গেছে। বলা বাহুল্য, আমি তাদের এসব ইচ্ছা বরাবরই এড়িয়ে চলতাম।

আমার পিতামহ ১৯২১ সালে হ্রদের তীরে একটি কুটীর নির্মান করেছিলেন। প্রতি বছর বাবার তিনমাসের গ্রীষ্মকালীন ছুটি আমরা এখানে কাটাতাম। এর চারদিকে ছিল জঙ্গল, রাতে আমরা পেঁচা এবং পাহাড়ী সিংহের ডাক শুনতে পেতাম। আশে পাশে কেউ থাকত না। হেঁটে যাবার দুরত্বের সীমানায় আমিই ছিলাম একমাত্র বালক। প্রথম দিকে আমি দিন কাটাতাম এইসব কল্পনা করে। পতিত দুঃখের দিনে অসহায় রমনী- যাদের নাম এ্যান, প্রিসীলা, বা জুডি (এ সব চিন্তা বয়সের উপর নির্ভরশীল ছিল) তাদের সঙ্গ পাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকতাম। নিঃসন্দেহে আমার অনুরাগ তেমনি তীব্র ছিল যেমন ছিল ল্যান্সলটের গুইনিভারের জন্য- এবং তা ছিল আরো বেশী গোপন।

চৌদ্দ বছর বয়েসে, টিল্টন স্কুলে আমি বিনামুল্যে টিউশন পেতাম। বাবামার খোঁচাখুঁচিতে, শহরের সব কিছুই (খেলাধুলা, বন্ধুত্ব, বেড়ানো) আমি প্রত্যাখান করেছিলাম এবং পুরোনো বন্ধুদের সাথে আমার আর কখনই দেখা হয়নি। ছুটিতে আমার নতুন সহপাঠিরা যখন তাদের দেশের বাড়ি এবং বহুতল অট্টালিকার ছাদের বিলাস-কক্ষে (পেন্টহাউস) যেত, পাহাড়ের উপরে আমি একা থাকতাম। তাদের উঁচু সমাজের বান্ধবীরা ছিল সব নবাগতা। আমার কোনো বান্ধবী ছিল না। যেসব মেয়েদের আমি চিনতাম, তারা ছিল সবাই ‘নোংরা’। আমি তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছি এবং তারা আমাকে ভুলে গিয়েছে। আমি একা থাকতাম- এবং মারাত্বকভাবে হতাশ ছিলাম।

ছলেবলে কাজ উদ্ধার করতে আমার বাবা’মা খুবই পটু ছিলেন। তারা আমাকে সব সময় আশ্বস্ত করতেন। এমন সুযোগ পাওয়া আমার একটি বিশেষ অধিকার এবং একদিন আমি এজন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হবো। আমি নিখুঁত একটি স্ত্রী পাবো, আমাদের উচ্চ নৈতিক মাপকাঠিতে যে পুরোপুরি খাপ খাবে। ভেতরে ভেতরে আমি যদিও ক্ষুব্ধ হতাম। কিন্তু মেয়েদের সান্নিধ্যের জন্য আমার মন সর্বদাই ব্যাকুল থাকতো। যৌনতা-নিয়ে ঢিলেঢালা ধারণা থাকা একজন মেয়েমানুষের সাহ্নিধ্য অত্যন্ত যাদুকরী।

যাইহোক, বিদ্রোহ না করে বরং আমি আমার ক্রোধকে দমন করতাম এবং (প্রতিযোগিতায়) অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়ে আমার হতাশাকে চাপা দিতাম। একজন উল্লেখযোগ্য প্রতিভাবান ছাত্র ছিলাম আমি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দু‘টি খেলার দলের আমি ছিলাম অধিনায়ক। ছিলাম স্কুল সংবাদপত্রের সম্পাদক। আমার ধনী সহপাঠিদের একটা কিছু করে দেখানোর পর চিরজীবনের জন্য টিল্টন স্কুল পরিত্যাগ করতে আমি দৃঢ়সংকল্প ছিলাম। উঁচু ক্লাসে পড়ার সময়, ব্রাউন এবং মিড্লবেরী কলেজে পড়াশুনার জন্য আমি পুরো স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। আমি ব্রাউনে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। আসল কারন আমি একজন খেলোয়াড় হতে চেয়েছিলাম যেহেতু এটা অবস্থিত ছিল একটি শহরে। আমার মা মিড্লবেরী থেকে বিএ ডিগ্রি নিয়েছিলেন। বাবা সেখান থেকে এমএ পাশ করেছেন। সুতরাং যদিও ব্রাউন কলেজ আইভি লীগের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু তাদের পছন্দ ছিল মিডলবেরী।

“খেলাধুলাতে যদি তোমার পা ভেঙ্গে যায়?” বাবা বললেন। “কাজেই উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ নেয়াটাই উত্তম।” বাবার এহেন মনোভাব আর মন্তব্যের জন্য আমি মনে মনে ক্ষুন্ন হলাম।

আমার ধারনায়, মিডলবেরী ছিল টিল্টন স্কুলের একটি স্ফীত রূপ মাত্র। যদিও গ্রামীন নিউ হ্যাম্পসায়ারের বদলে এটা ছিল গ্রামীন ভারমন্টে। এটা ঠিক, এখানে ছিল সহশিক্ষা। কিন্ত তুলনামুলক ভাবে আমি ছিলাম গরিব আর সবাই প্রায় ধনী। এবং গত চার বছর আমি যে স্কুলে পড়েছি, সেখানে কোনো ছাত্রী ছিল না। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল কম, নিজেকে শ্রেণীচ্যুত মনে করতাম। খুবই দুঃখী ছিলাম। আমি বাবাকে খুব অনুনয় বিনয় করে বললাম- আমাকে এক বছর অবকাশ বা বিরতি দেবার জন্য। আমি বোস্টনে যেতে চেয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে জীবন আর রমনীদের জানতে চাই। উনি এসব শুনতেই চাইলেন না। বরং প্রশ্ন করলেন “আমি অন্য বাবামার ছেলেদের কিভাবে কলেজে ভর্তির জন্য প্রস্তুত করব, যেখানে আমার নিজের ছেলেই কোনো কলেজে যেতে চায় না” ?

আমি বুঝতে পেরেছিলাম, জীবন বিভিন্ন ধরনের আকষ্মিকতা আর কাকতালীয় ঘটনার সমষ্টি। কিভাবে আমাদের এসবে প্রতিক্রিয়া হয় এবং অনেকেই যাকে বলে, ‘স্বাধীন-ইচ্ছা‘, আমরা কিভাবে তার প্রয়োগ করি- এটাই সবকিছু। ভাগ্য পুননির্ধারনের চক্রের সীমানার মধ্যে আমরা যা বেছে নেই, তা আমাদের পরিচয় নির্ধারন করে। যুগপৎ দুটি প্রধান ঘটনা যা আমার জীবনকে তার অবয়ব প্রদান করেছে, ঘটেছে মিডলবেরীতে। প্রথমটির আবির্ভাব এক ইরানীর রূপে। তার বাবা একজন জেনারেল, যিনি ছিলেন রেজাশাহ পেহলভীর ব্যক্তিগত উপদেষ্টা। দ্বিতীয়জন একটি সুন্দরী যুবতী, নাম এ্যান, আমার শৈশবের প্রিয়া।

প্রথমজন যার নাম ফরহাদ (ইরানী) রোমে পেশাদার ফুটবল খেলোয়ার ছিল। জন্মসুত্রে তার দেহটি ছিল ক্রীড়াবিদের। ঢেউ খেলানো চুল। নরম আখরোটের মত চোখ, খাড়া নাক। সব মিলিয়ে এক ঐশ্বরিক মহিমা যা রমনীদের জন্য ছিল অতি আকর্ষনীয়। অনেক দিক দিয়েই সে ছিল আমার বিপরীত। আমি তার বন্ধুত্ব জয় করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি। সে আমাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছিল যা আমার পরবর্তী বছরগুলিতে বেশ ভালোমত অনেক কাজে এসেছিল। আমি এ্যানের সাথেও পরিচিত হয়েছিলাম। যদিও সে অন্য একটি কলেজের একজন তরুনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হত, আমাকেও সে তার ডানার নিচে জায়গা দিয়েছিল। আমাদের বন্ধুত্ব ছিল নিষ্কাম। তার সাথে সম্পকর্টি ছিল আমার জীবনের প্রথম অকৃত্রিম ভালোবাসার একটি সত্যিকারের অভিজ্ঞতা।

ফরহাদ আমাকে এলকোহল পান করা, পার্টিতে অংশ গ্রহন করার জন্য উৎসাহ দিত। আমি বাবা-মাকে অবজ্ঞা করতাম। সচেতনভাবে আমি পড়াশুনা বন্ধ করার পথ বেছে নিয়েছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি লেখাপড়ার অবসান ঘটাবো, আমার বাবা যাই মনে করুন না কেন। পরীক্ষায় আমার কৃতকার্যতার মান নি¤œগামী, আমার স্কলারশিপ বাতিল হয়ে গেল। কলেজে চার বছেেরর কোর্সের দ্বিতীয় বছরের অর্ধপথে পদার্পন করেই আমি পড়াশুনার পাট বন্ধ করে দিলাম। বাবা আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করার হুমকি দিলেন। ফরহাদ আমাকে প্ররোচিত করেছিল। আমি ডিনের অফিসে ঝড়ের মত ঢুকে কলেজ ত্যাগ করার ঘোষনা দিয়েছিলাম। এটা ছিল আমার জীবনের একটি অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর ঘটনা।

শহরে স্থানীয় একটা মদ্যশালায় আমি ও ফরহাদ একসাথে আমার শেষ রাতটি উদযাপন করলাম। দৈত্যাকৃতির একজন মাতাল কৃষক আমাকে অভিযুক্ত করেছিল, আমি নাকি তার স্ত্রীর সাথে ফষ্টিনষ্টি করেছি। আমাকে দুহাতে জমিন থেকে তুলে নিয়ে দেয়ালে ঠেসে ধরেছিল। ফরহাদ আমাদের দুজনের মধ্যে এসে একটি চাকু বের করে কৃষকের চিবুকে খোলাখুলি আঘাত করে আমাকে সেখান থেকে টেনে ঘরের কোণায় এনে একটি জানালা দিয়ে ঠেলে আমাকে বাইরে অর্টার নদীর খাঁড়ির উপরে সরু গলিতে নিয়ে এসেছিল। লাফিয়ে আমরা নদী পার হয়ে হোষ্টেলে ফিরে এসেছিলাম।

পরের দিন সকালে, ক্যাম্পাস পুলিশ যখন আমাদের জেরা করল, আমি মিথ্যা কথা বললাম। আমি ঘটনাটির বিন্দুবিসর্গও জানি না। সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করলাম। তথাপি ফরহাদকে বহিস্কৃত করা হল। আমরা উভয়ে বোস্টনে চলে এসে সেখানে দু‘জনে মিলে একটি এপার্টমেন্ট ভাড়া করলাম। হিস্টের্র রেকর্ড আমেরিকান-সানডে এডবার্টাইজার সংবাদপত্রে আমি একটি চাকুরি নিলাম। আমার পদটি ছিল, সানডে-এডভার্টাইজারের প্রধান সম্পাদকের ব্যক্তিগত সহকারি।

সেবছরের (১৯৬৫) শেষের দিকে, সংবাদপত্রের আমার কয়েকজন বন্ধুকে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের জন্য বাছাই করা হল। আবার একই ধরনের ঘটনা এড়ানোর জন্য, আমি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস- এডমিনিষ্ট্রেসন বিভাগে ভর্তি হলাম। ঐ সময়ে এ্যান তার পুরোনো বন্ধুর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিল এবং সে প্রায়ই মিড্লবারী থেকে আমার কাছে বেড়াতে আসত। আমি তার আগ্রহকে আনন্দের সাথে উপভোগ করতাম। ১৯৬৭ সালে সে বিএ পাশ করে। আমার তখন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি শেষ করতে এক বছর বাকি ছিল। অনমনীয়ভাবে, বিয়ে না হলে সে আমার সাথে একত্রে বসবাস করতে রাজী হয়নি। ঠাট্টা করে যদিও আমি অনুযোগ করতাম, সে আমাকে বø্যাকমেইল করছে, আসলে ভেতরে ভেতরে আমি ছিলাম ক্ষুব্ধ। কারন তার এই মনোভাবকে আমি আমার বাবামার এক পালা নীতিবোধের গোঁড়ামী ও ঔচিত্যবোধের অনুবর্তন লক্ষ্য করতাম। তবে পরস্পরে আমাদের সময়কে আমরা বেশ উপভোগ করতাম এবং আমি তাকে আরও বেশি করে পেতে চাইতাম। আমরা বিয়ে করলাম।

এ্যানের বাবা, এজন প্রতিভাবান ইঞ্জিনিয়ার, মিসাইলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীর নৌপথে চলাচলের পরিকল্পনার পরিচালক ছিলেন। নৌবাহিনীতে এ জন্য তাকে একটি প্রভাবশালী উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করা হয়। তার সবচাইতে ঘনিষ্ট বন্ধু, যাকে এ্যান আংকল-ফ্র্যাংক বলত (আসল নাম নয়) তিনি এনএসএর (জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সি) উচ্চতম সারির একজন প্রশাসক। এটি হল আমেরিকার সবচাইতে কম পরিচিত, কিন্ত অধিকাংশ কারনে বৃহত্তম গোয়েন্দা সংস্থা।

আমাদের বিয়ের কিছুদিন পরে, সামরিক বাহিনী থেকে আমার শারীরিক পরীক্ষার আহŸান এল। আমি উত্তীর্ন হলাম। যার দরুন বিএ পাশ করার পরই ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগদানের অনিবার্যতার সামনাসামনি হলাম। দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়াতে যুদ্ধ করার ধারনায় আমি আবেগের বিহŸলতায় ছিন্নভিন্ন হয়েছিলাম, যদিও যুদ্ধ আমাকে সব সময় মুগ্ধ করত। আমার ঔপনিবেশিক পুর্বপুরুষদের গল্প-কাহিনীর সাথে আমি বড় হয়েছি। এদের মধ্যে ছিল টমাস পেইন এবং এথান এলান। আমি নিউ ইংলন্ডের সর্বত্র ভ্রমন করেছি। ফরাসী এবং রেড-ইন্ডিয়ান উভয় এলাকার দেশের যুদ্ধের সব ময়দান এবং বিপ্লবী-যুদ্ধ ও নিউ ইয়র্ক শহরতলীর যুদ্ধক্ষেত্র, সব আমার দেখা। আমি হাতের কাছে পাওয়া প্রতিটি ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ি। বস্তুতঃ, যখন সামরিক বাহিনীর বিশেষ দল প্রথমবারের মত দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়াতে অনুপ্রবেশ করেছিল, তখন আমি যোগ দিতে খুবই আগ্রহী ছিলাম। কিন্ত সংবাদমাধ্যমে যখন আমেরিকান নীতির বর্বরতা এবং সঙ্গতিহীনতা উন্মুক্ত হল, আমার হৃদয়ে আমি এক পরিবর্তন অনুভব করেছি। আমি মনে মনে চিন্তা করতাম, পেইন এখন বেঁচে থাকলে কোন পক্ষে যুদ্ধ করতেন ? আমি নিশ্চিত, তিনি আমাদের ভিয়েতকং-শত্রæদের সঙ্গে যোগ দিতেন।

আংকল-ফ্রাংক আমাকে রক্ষা করলেন। তিনি খবর দিলেন, এনএসএর একটি চাকরি যা বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে আমাকে নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করতে সহায়তা করবে। তিনি তার এজেন্সিতে আমার জন্য বেশ কয়েকটি দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। একদিন এর মধ্যে ছিল পরিশ্রান্তিকর পোলিগ্রাফিক বিদেশী সম্প্রচার ধারনের ইন্টারভিউ। আমাকে বলা হল, এই সব পরীক্ষার মারফত নির্ধারন করা হবে আমি এন.এস.এ.তে কাজ ও প্রশিক্ষন গ্রহন করার জন্য যোগ্য ব্যক্তি কি না। যদি আমার যোগ্যতা প্রমানিত হয়, তাহলে আমার শক্তি এবং দুর্বলতার একটি রূপরেখা পাওয়া যাবে, যা ব্যবহার করে আমার পেশাগত জীবনের মানচিত্র অংকন করা হবে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করে, আমি নিশ্চিত ছিলাম, এসব পরীক্ষায় আমি অবশ্যই ফেল করব।

প্রশ্নোত্তরের সময় আমি স্বীকার করেছি, বিশ্বস্ত আমেরিকান হিসেবে আমি যুদ্ধের বিরোধিতা করেছি। আমি খুবই আশ্চর্য হলাম, এ বিষয়ে প্রশ্নকারীরা তেমন আগ্রহ দেখালেন না। বদলে তারা আমার লালন-পালন, বাবা-মার প্রতি আমার মনোভঙ্গি, একজন গোঁড়া নীতিবাগীশ দরিদ্র পরিবারে আমি বড় হয়েছি এবং সহপাঠিদের অনেকেই ছিল ধনী এবং ‘সুখই পরামার্থ‘ এই মতে বিশ্বাসী, এসবের প্রেক্ষিতে আমার আবেগ নিঃসৃত মননশীলতা নিয়ে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। মহিলা-সংসর্গ ও সেক্স বঞ্চিত পরিবেশ, টাকাপয়সার অভাব এবং এসব কারনে আমার জীবনে হতাশা এবং পরিণামে আমার ভেতরে যে স্বপ্ন-জগতের উত্থান হয়েছে, তা নিয়েও আমার সাথে অনেক বাক্যবিনিময় করলেন। ফরহাদের সাথে আমার সম্পর্ক নিয়ে তাদের গভীর মনোযোগ আমাকে বিষ্মিত করেছে। তাকে রক্ষা করার জন্য আমি যে ক্যাম্পাস পুলিশের কাছে মিথ্যা বলতেও প্রস্তুত ছিলাম, এ বিষয়েও তাদের অত্যন্ত ব্যগ্রতা।

প্রথমে আমার মনে হয়েছিল এ সমস্ত বিষয় আমার সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারন হবে। এন.এস.এ. আমাকে প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্ত আমাদের কথাবার্তা চলতেই থাকল, যার অর্থ এর বিপরীত। বেশ কয়েক বছর পরেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম এনএসএর দৃষ্টিভঙ্গিতে এসব নেতিবাচক তথ্য আসলে সন্দেহাতীত এবং সুনিশ্চিত আধার। তাদের বিবেচনা ও মুল্যনির্ধারনের উপাত্ত আমার দেশভক্তি ও বিশ্বস্ততার সাথে অল্পই সংশ্লিষ্ট। বরঞ্চ মুল প্রসঙ্গ হল, আমার জীবনের হতাশা। বাবামার প্রতি আমার ক্রোধ, মহিলাদের জন্য আমার এক ধরনের আবিষ্টতা, এবং প্রাচুর্যভরা জীবনযাপনের প্রতি আমার ব্যগ্রতা, তাদেরকে কৌতুহলি করেছিল। তারা ভেবেছিল এসব হলে আমাকে প্রলুব্ধ করা যাবে। স্কুলে এবং খেলাধুলায় অন্যদের চাইতে ভালো করার দৃঢ়সংকল্প, বাবার বিরুদ্ধে আমার চুড়ান্ত বিদ্রোহ, বিদেশীদের সাথে আমার স্বচ্ছন্দ মেলামেশা করার ক্ষমতা, এবং স্বেচ্ছায় পুলিশকে মিথ্যা বলার ইচ্ছা, এ সবই যথার্থ গুণাবলী হিসাবে তারা বিবেচনা করে। পরে আমি আরও জানতে পেরেছি, ফরহাদের বাবা ইরানে আমেরিকার গোয়েন্দাদের সাথে কাজ করতেন। ফরহাদের সাথে বন্ধুত্ব¡ আমার জন্য অবশ্যই ছিল একটি ইতিবাচক যোগ্যতা।

এন.এস.এ.তে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কয়েক সপ্তাহ পরে, আমাকে একটি চাকরি দেয়া হল। বেশ কয়েকমাস পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি পাওয়ার পর আমাকে গোয়েন্দা-বিদ্যার প্রশিক্ষন শুরু করতে হবে। অবশ্য তার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে চাকরিটি গ্রহন করতে হবে। ঝোঁকের বশে আমি বিশ্বদ্যিালয়ের একটি সেমিনারে অংশ নিলাম। উদ্যোক্তা ছিল একটি শান্তিবাহিনী (চবধপব ঈড়ৎঢ়ং)। চাকরিজীবি হিসেবে এখানেও যোগদান করা যায়। এনএসএর মত তারও একটি আকর্ষণ আছে। যারা এখানে কাজ করে, তারা বাধ্যতামূলক সামরিক-বাহিনীর নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার যোগ্যতা রাখে।

এই সেমিনারে যোগদান করার ইচ্ছাটি ছিল সাধারন একটি ‘যুগপৎ-ঘটনা‘ যাকে তখন আমি খুব একটা গুরুত্ব দেইনি। কিন্ত পরে আমার “জীবনযাত্রা-পরিবর্তনের’’ উপলক্ষ হয়েছিল। শান্তিবাহিনীর সংগ্রহ-কর্মীরা পৃথিবীর বিভিন্ন বিপন্ন এলাকার বিবরন দিলেন, যেখানে বিশেষভাবে স্বেচ্ছাসেবক প্রয়োজন। এর একটি ছিল আমাজন গ্রীষ্মমন্ডলীয় অরন্যাঞ্চল, বক্তা বললেন যেখানে ইউরোপীয়ানদের আগমনের পুর্বে আদিবাসীরা জন্মসুত্রে উত্তর আমেরিকার প্রকৃত স্থানীয় দেশজ হিসেবে বাস করত।

নিউ হ্যাম্পশায়ারের ‘আবনাকিদের‘ মত জীবন যাপন করার স্বপ্ন ছিল আমার। যেখানে প্রথম আমার পুর্বপুরুষরা বসতি স্থাপন করেছিলেন। আমি জানতাম আমার শিরায় আবনাকি-রক্ত রয়েছে। আমি চাইতাম, তারা বনজঙ্গলের লোক-বিদ্যা খুবই ভালোভাবে বুঝত, এবং শিখত। শান্তিবাহিনীর সংগ্রহকর্তার বক্তৃতা শেষ হবার পর আমি তার সাথে আমাজনে কাজ করার সম্ভাব্যতা নিয়ে কথা বললাম। তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন, ঐ অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবীদের প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরি, সেখানে আমার কাজ করার সুযোগ অবশ্যই রয়েছে। আমি আংকল ফ্রাংককে টেলিফোন করলাম।

আমি বিষ্মিত হলাম, আংকল ফ্রাংক আমাকে শান্তিবাহিনীর সাথে কাজ করার প্রস্তাবটি বিবেচনা করার জন্য উৎসাহ দিলেন। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন, হ্যানয়ের পতনের পর বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের কাছে একটি সুনিশ্চিত ব্যাপার আমাজন একটি ‘গরম-এলাকা‘ হবে।

“অঞ্চলটি তেলে ভরপুর’’, তিনি বললেন। “সেখানে আমাদের দক্ষ এজেন্ট প্রয়োজন- এমন ধরনের লোকজন যারা স্থানীয় অধিবাসীদের বুঝতে পারে’’। তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন, শান্তিবাহিনী একটি উত্তম প্রশিক্ষণ-ভুমি। আমাকে তিনি ভালোমত স্পেনীশ ভাষা শেখার জন্যও চাপ দিলেন। সাথে সাথে স্থানীয় আদিবাসীদের আঞ্চলিক উপভাষাও শিখতে হবে। তিনি বিড় বিড় করে আরও বললেন, “সরকারি চাকরী না করে শেষ পর্যন্ত তুমি হয়তো একটি বেসরকারি কোম্পানীতে কাজ করবে”।

আমি বুঝিনি, তিনি সে সময় আমাকে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন। আমার কাছে মনে হয়েছিল, বরঞ্চ আমার গোয়েন্দার চাকরি থেকে ’ইকোনোমিক হিট ম্যান’ হিসেবে পদাবনতি হল। যদিও আমি কখনই এই পদটির নাম শুনিনি। হয়তো পরবর্তী বেশ কয়েক বছর শুনবও না। আমার কোনো ধারনাই ছিল না, শত শত নরনারী পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যারা ’পরামর্শদাতা-ফার্ম এবং অন্যান্য বেসরকারি ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানের‘ জন্য কাজ করে। যারা কখনই কোনো সরকারি-এজেন্সির তহবিল থেকে এক পেনিও বেতন পায় না। তথাপি তারা সা¤্রাজ্যের স্বার্থরক্ষায় কাজ করছে। আমার চিন্তায় কখনই ছিল না, একটি নতুন শ্রেনী, যাদের পদের নাম আরও বেশি সুভাষিত। বর্তমান শতাব্দির শেষে তাদের সংখ্যা হাজার হাজার হয়ে যাবে। শেষ অবধি আমি এই বর্ধিষ্ণু সেনাবহরের আকার গঠনে একটি উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করব।

এ্যান এবং আমি শান্তিবাহিনীতে দরখাস্ত দিলাম। আমরা অনুরোধ করেছি আমাজন অঞ্চলে নিযুক্তির জন্য। যখন আমাদের প্রার্থনা মঞ্জুরের বার্তা এল, আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল একটি চরম নিরাশা। চিঠিতে লেখা ছিল, আমাদের ইকুয়েডরে পাঠানো হবে।

আহা না! আমার ভাবনা। আমি আমাজনে যেতে চেয়েছিলাম, আফ্রিকায় নয়।

আমি একটা মানচিত্রে ইকুয়েডরের খোঁজ নিলাম। খুবই মুষড়ে পড়লাম যখন আফ্রিকা মহাদেশের কোথাও এ দেশটির সন্ধান পেলাম না। অবশ্য সুচিপত্রে আমি অবিস্কার করলাম, দেশটি লাটিন আমেরিকায়। ম্যাপে দেখলাম, এখানকার সব নদীই আন্দিজ পর্বতমালার হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে শক্তিমান আমাজন নদীর দিকে প্রবাহিত। আরও কিছু পড়াশুনার পর আমি আশ্বস্ত হলাম, ইকুয়েডরের বন-জঙ্গল, পৃথিবীর সামান্য কয়েকটি বৃহত্তম বৈচিত্রশালী এবং দুর্জয়-দুর্গম বনভুমির অন্যতম। সেখানে আদিবাসী দেশজ জনসাধারন এখনও প্রায় শত শত বছর আগের মতই জীবনযাপন করে। আমরা চাকরি গ্রহন করলাম।

এ্যান এবং আমি দক্ষিণ কালিফোর্নিয়াতে শান্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছি। ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা ইকুয়েডর রওনা হলাম। আমাজনে আমরা সুয়ার আদিবাসীদের সাথে বসবাস করেছি। তাদের জীবনযাত্রা প্রকৃতপক্ষেই উত্তর আমেরিকার উপনিবেশ-পুর্ব দেশজ অধিবাসীদের মতই। আন্দিজ পর্বতমালায় ইনকাদের উত্তরসূরীদের সাথেও আমরা থেকেছি। এটা পৃথিবীর এমন একটি অঞ্চল, যার অস্তিত্ব এখনও আছে তা আমি স্বপ্নেও দেখিনি। তখন পর্যন্ত লাটিন আমেরিকার যে কয়েকজনকে আমি চিনতাম, তারা সবাই ছিল আমার বাবার স্কুলের ধনী প্রিপারেটরী-ছাত্র। আমি এই সব আদিবাসীদের প্রতি খুবই সহানুভুতিশীল ছিলাম, যারা শিকার এবং কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। তাদের সাথে আমি এক ধরনের প্রাচীন আত্মীয়তা বোধ করতাম। যে ভাবেই হোক, তাদের দেখে আমার শহরবাসীদের কথা মনে হত, যাদের আমি পেছনে ফেলে এসেছি।

একদিন এক ব্যক্তি, নাম আইনার গ্রীভ, (চাস-টি-মাইন, ইনকর্পোরেশনের (গঅওঘ) ভাইস-প্রেসিডেন্ট) কেতাদুরস্ত স্যুট পরে, প্লেনে চড়ে আমাদের পাড়ায় হাজির হলেন। এটি একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতা ফার্ম, যার প্রচার খুবই কম, মোটামুটি আত্মগোপন করে থাকে। এর দায়িত্ব ছিল তথ্যানুসন্ধান করা, ইকুয়েডর এবং প্রতিবেশী দেশগুলিকে বিশ্বব্যাংকের হাজার হাজার কোটি ডলারের ঋণ দেয়া যায় কিনা, সে সম্পর্কে। যা দিয়ে এসব দেশে পানি-বিদ্যুত বাঁধ এবং অন্যান্য অবকাঠামো-প্রকল্প নির্মান করা হবে। আমেরিকার রিজার্ভ সেনাবাহিনীতেও আইমার ছিল একজন কর্ণেল।

তিনি আমার সাথে গঅওঘ এর মত একটি কোম্পানীতে কাজ করার সুযোগ সুবিধা নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। শান্তিবাহিনীতে কাজ নেবার আগে এনএসএ আমাকে নির্বাচন করেছিল, এবং আমি ওদের কাছে ফিরে যাবার কথা বিবেচনা করছি, এটা শোনার পর তিনি আমাকে জানালেন, মাঝে মাঝে তিনি এনএসএর সাথে দ্বিপাক্ষিক সংযোগের কাজ করেন। আমাকে একটি বই দিলেন। এতে আমার সন্দেহ হয়েছিল, আমার সাথে তার দেখা করার অন্যতম কারন ছিল আমার কর্মশক্তির মুল্যায়ন করা। আমার এখন বিশ্বাস, তিনি আমার জীবন-পঞ্জীর বর্তমান রূপটি পর্যালোচনার দায়িত্বে ছিলেন। বিশেষ করে তিনি আমার সহ্য-ক্ষমতা যাচাই করতে চেয়েছিলেন। অধিকাংশ উত্তর-আমেরিকানদের কাছে যে আবহাওয়া বৈরী, সেখানে আমি টিকে থাকতে পারি কিনা।

ইকুয়েডরে কয়েকদিন আমরা একসাথে কাটালাম। তারপর পরস্পরে চিঠিপত্রে যোগাযোগ করতাম। তিনি আমাকে ইকুয়েডরের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা মুল্যায়ন করে রিপোর্ট পাঠাতে বলেছিলেন। আমার একটি ছোট পোর্টেবল টাইপ-রাইটার ছিল। আমি লিখতে পছন্দ করতাম। কাজেই তার অনুরোধ রক্ষা করে বেশ আনন্দ পেয়েছি। প্রায় এক বছর ধরে আমি আইনারকে কমপক্ষে দীর্ঘ পনেরোটি চিঠি লিখেছি। এই সব চিঠিতে আমি ইকুয়েডরের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে আমার অনুমান, ভাবনাচিন্তা বর্ণনা করেছি। আমি তাকে অবগত করেছি, তেল কোম্পানীর সাথে খোলাখুলি সংঘর্ষজনিত পরিস্থিতিতে স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বর্ধমান হতাশা, আন্তর্জাতিক সাহায্য-সংস্থা, এবং অন্যান্য সব উদ্যোগ সম্পর্কে, যা প্রয়োগ করে তাদের আধুনিক পৃথিবীতে টেনে আনার চেষ্টা চলছে।

যখন আমার শান্তিবাহিনীর ভ্রমন সমাপ্ত হল, আইনার মাইনে চাকরি নেবার একটি ইন্টারভিউতে অংশ নেবার জন্য কোম্পানীর সদর দফতর বোস্টনে আমাকে আমন্ত্রন জানালেন। আমাদের ব্যক্তিগত সাক্ষাতের সময় তিনি জোর দিয়ে বললেন, মাইন কোম্পানীর প্রাথমিক কাজ হল কারিগরী। কিন্ত তার সবচাইতে বড় খরিদ্দার বিশ্বব্যাংক, সম্প্রতি চাপ দিচ্ছে, সে যেন তার কর্মচারীদের মধ্যে অর্থনীতিকদের অন্তর্ভুক্ত করে। যারা সমালোচনার দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক ভবিষদ্বানী তৈরি করবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে কারিগরী প্রকল্পের পরিমান, বিস্তার এবং বাস্তবায়নযোগ্যতা নির্ধারন করা যায়। তিনি আমাকে বিশ্বাস করে গোপন কথাটি জানিয়েছিলেন, এর আগে তিনি তিনজন যোগ্য অর্থনীতিবিদ নিয়োগ করেছিলেন। তাদের সবারই নিখুঁত প্রশংসাপত্র ছিল। দু‘জনের ছিল এমএ ডিগ্রি এবং তৃতীয়জন পিএইচডি। কিন্ত তারা সবাই দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

আইনার বললেন, “যে সমস্ত দেশে বিশ্বাসযোগ্য অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না, সে সব দেশের অর্থনৈতিক ভবিষদ্বানী করার মত ধারনাশক্তি বা ক্ষমতা থাকে চরম দুর্বল। “তিনি আমাকে আরও বললেন, এ ছাড়াও, তারা সবাই চাকরির চুক্তিপত্রে উল্লেখিত শর্তপূরন করতে সক্ষম হয়নি। এটা তাদের জন্য সম্ভবও ছিল না। এজন্য তাদের প্রয়োজন ছিল ইকুয়েডর, ইন্দোনেশীয়া, ইরান, এবং মিসরের মত দেশের দুর্গম এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রমন করে স্থানীয় নেতৃবৃন্দদের সাথে কথা বলা, তাদের সাক্ষাতকার নেয়া। এইসব অঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাব্যতার উপরে তাদের উচিৎ ছিল পেশাগত মুল্যায়ন করা। পানামার একটি দুর্গম অজপাড়াগাঁয়ে একজন মানসিক বৈকল্যের শিকার হয়ে গেল। পানামার পুলিশ তাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে এসে একটি প্লেনে তুলে দেয়। সে আমেরিকায় ফিরে আসে।

তুমি আমাকে যেসব চিঠি লিখেছ, তাতে বোঝা যায় প্রয়োজনে তুমি যেকোনখানেই তোমার মাথা গলাতে পিছপা হবে না, যেখানে কোনো উপাত্ত পাওয়া যায় না। ইকুয়েডরে তোমার জীবন যাপনের যে পারিপার্শ্বিকতা, আমি স্থির বিশ্বাসী, তুমি প্রায় সর্বত্রই টিকতে পারবে। আমাকে বললেন, ইতিমধ্যেই তিনি উল্লেখিত তিনজনের মধ্যে একজন অর্থনীতিবিদকে বরখাস্ত করেছেন এবং বাকি দুজনের জন্যও একই ব্যবস্থা নিতে তিনি প্রস্তুত, যদি আমি চাকরি নেই।

পরবর্তী ঘটনা, ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে মাইন ফার্মে আমাকে অর্থনীতিবিদের একটি পদ দেয়া হল। আমার বয়স তখন ২৬। একটি যাদুকরী বয়েস, যখন বাধ্যতামূলক সামরিক নির্বাচনী কর্ত্তৃৃপক্ষ আমাকে আর ডাকবে না। এ্যানের পরিবারের সাথে আমি পরামর্শ করলাম। তারা সবাই আমাকে চাকরি নেবার জন্য উৎসাহিত করলো। আমার মনে হল, আংকল ফ্রাংকও তাই চান। আমার স্মরণ হল, তিনি একবার এই সম্ভাব্যতার কথা বলেছিলেন, শেষ পর্যন্ত আমি কোনো বেসরকারি ফার্মে কাজ নেব, যেখানে আমার পেশাগত জীবনের সমাপ্তি হবে। খোলাখুলি কখনই তিনি কিছু বলেননি। কিন্ত আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম, আমার মাইন-ফার্মের চাকরিটি তিন বছর আগে আংকল ফ্রাংক আমার জন্য যে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন এটি তারই ফলশ্রæতি। এ ছাড়া, ইকুয়েডরে আমার অভিজ্ঞতা এবং সে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমার লেখালেখি করার ইচ্ছাও কাজে এসেছে।

আমার মাথায় কয়েক সপ্তাহ নানা চিন্তা ঘুরাঘুরি করলো। আমার অহংবোধেও আঘাত অনুভব করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি মাত্র একটি বিএ ডিগ্রি নিয়েছি। যা দিয়ে একটি অর্থনীতিক-পদে চাকরী করা শোভা পায় না। তদুপরি এমন একটি উঁচুদরের পরামর্শদাতা কোম্পানীতে। আমি জানতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অনেক সহপাঠিই যারা বাধ্যতামুলক সামরিক নির্বাচনে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এমবিএ বা অন্যান্য ডিগ্রি নেবার জন্য পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে, তারা হিংসায় জ্বলবে। আমি নিজেকে একজন উদ্ধত স্পাই হিসেবে কল্পনা করেছি। যে চমকপ্রদ, অদ্ভুত সব দেশে সফর করে। বিলাসী হোটেলের সুইমিঙ পুলের পারে বসে আরামে আলসেমী করে। তার চারদিকে জমকালো বিকিনি-পরা সুন্দরী রমনীদের সমাবেশ, হাতে মার্টিনির গøাস।

যদিও এসবই অলীক কল্পনা মাত্র, পরে দেখলাম, এদের মধ্যে বেশ কিছুতে সত্যের লেশ রয়েছে। আইনার আমাকে একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে ভাড়া করেছিলেন। কিন্ত শীঘ্রই আমি জানতে পারলাম, আমার আসল কাজ এই পদটি ছাড়িয়ে অনেক দুরে। বাস্তবে এটা জেমস বন্ডের (দু:সাহসিক ছায়াছবি) অনেক কাছাকাছি, যা আমি কোনোদিনই ধারনা করতে পারিনি।

চলবে …

ইকোনমিক হিটম্যান : পর্ব-২