নিখুঁত কল্পচিত্র নির্মাণের জন্যে চাই ভিন্নতর দৃষ্টি

মিজানুর রহমান রানা :

একজন কবির কল্পনা যদি কোনোরকম সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ করতে না পারে, কেবলই একগুচ্ছ অতি সাধারণ ইমেজ রচনা করে, তাহলে তার কী মূল্য আছে?

একজন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক বলেন, “সাহিত্য অঙ্গনে কবিতা একটি শক্ত ব্যাপার। তাই সাহিত্যচর্চার শুরুতেই কবিতা কাম্য নয়, কারণ কবিতা রচনা করতে গিয়ে অনেকেই তাদের শব্দভাণ্ডার সমৃৃদ্ধ না হওয়া সত্তে¡ও লিখতে গিয়ে ছন্দ ও ভাবের মিল খুঁজে পায় না। ফলে পংক্তিমালা এলোমেলো হয়ে যায়। কবির নাম হয় কষ্ট কবি।” তিনি একজন তরুণ সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশকারীকে এ উপদেশ দিয়েছিলেন, সাহিত্যচর্চার প্রথমেই কবিতা রচনা না করে প্রবন্ধ, গল্প ইত্যাদি রচনা করার জন্যে। কারণ, কবিতা রচনার চেয়ে গল্প, প্রবন্ধ রচনা কিছুটা সহজসাধ্য। মনের মতো কাহিনীকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই রচনা করা যায়। গল্পের কল্পচিত্রে কল্পলোক, বাস্তব, অবাস্তব সবকিছুই সন্নিবেশিত করা যায়। তবে হ্যাঁ, এতে কিন্তু শুদ্ধ ভাষাজ্ঞান, ভাষা রীতি অনুসরণ অতীব জরুরী। ভাষা রীতি এমন হবে না, যা আধুনিক সমাজ-সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গল্পে কল্পচিত্রভিত্তিক পরাবাস্তব বিষয়ের অবতারণা করা তেমন কোনো কিছু নয়, হয়তো তা’ পরবর্তী যুগে সত্যে প্রমাণিত হতে পারে। যা বর্তমানকালে বাস্তব নয়, সম্পূর্ণ অবাস্তব। গল্পের কল্পচিত্রকে মানুষ যদি তাৎক্ষণিক বাস্তবে পরিণত হতে না দেখে তাহলে তো তাকে অবাস্তব বলা অযৌক্তিক নয়।

কবিতার ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়াবলী একটু ভিন্নমাত্রা বহন করে। কারণ, বর্তমান সমাজ-সভ্যতার অগ্রসরমান ক্রমবিকাশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আধুনিক কবিগণ তাদের রচিত কবিতায় নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে কল্পচিত্রের আশ্রয় নিয়েছেন। এজরা পাউন্ড কল্পচিত্র প্রসঙ্গে বলেন, “কল্পচিত্র হচ্ছে সে শব্দ সমষ্টি, যা এক অমূল্য মুহূর্তে ভাবাবেগ ও তীক্ষè বুদ্ধিমত্তার জটিল গ্রন্থি উন্মোচন করে। উপমা বা রূপক যা পারে না একটি কল্পচিত্র তা-ই সম্পন্ন করে থাকে। সংবেদনশীল মানুষের জটিল, বহু স্তরান্বিত অভিজ্ঞতার বর্ণাঢ্য শব্দরূপ এ কল্পচিত্র।” সে কল্পলোকের কল্পচিত্রে ধারণ করা শব্দগুলো কবি বাস্তবতার নিরিখে সাজিয়ে একত্রিত করে বাণীবদ্ধ করে রূপায়ন করেন একখানি নিখুঁত কবিতা।

কবিতায় বর্ণিত প্রতিটি শব্দের বা বাক্যের বাস্তবতা, ভাষারীতি, ছন্দমিল অতি নিখুঁত শিল্পীর তুলির আঁচড়ে পরিস্ফুটন হয়ে থাকে। কখনো তা’ বাস্তব, সরাসরি আবার কখনো তা’ রূপক অর্থে ভিন্ন ভিন্ন অর্থপ্রকাশ করে। হিউম মনে করতেন, কবিতা হবে সংক্ষিপ্ত, সঠিক কল্পনা আর সুনির্দিষ্ট বর্ণনায় দীপ্ত। Imagist আন্দোলন আরম্ভ করার সময় পাউন্ড তাই হিউমের ৫টি ছোট কবিতাকে বেছে নিয়েছিলেন দৃষ্টান্ত হিসেবে। আমরা প্রত্যক্ষ করি, একজন সাধারণ মানুষ কোনো কিছু বর্ণনা দেয়ার সময় অনেক সময় উপমার আশ্রয় নেয়। কারণ লোকে সহজ কথায় বস্তুর মর্মে ঢুকতে পারে না। কবিতা এই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলার কাজটি নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে পারে। ফলে তার জন্যে প্রয়োজন সতেজ বিশ্লেষণ, নিত্য-নতুন অলংকরণ ও প্রয়োজনমাফিক বাক্যবিন্যাস বা ভাষা রীতি। এছাড়াও প্রয়োজন হয় মনোহর, আনকোরা উপমা।

‘নিখুঁত কবিতা আসলে একটি নিখুঁত কল্পচিত্র’- বক্তব্যটি এজরা পাউন্ডের এবং এটা ছিলো তার একটি স্লোাগান। এই শ্লোগানটি বিগত শতাব্দীর গোড়ার দিকে অতি দ্রুত পরিচিতি পেতে থাকে। কারণ, কল্পচিত্র হলো এক কথায় মানুষের অন্তরে গভীরভাবে ফুটে ওঠা একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন মানসচিত্র। একজন গভীর চিন্তাশীল কবির মনের প্রতিক্রিয়াজাত অর্থবহ শব্দবিন্যাসের ভেতর দিয়ে যে সুন্দর চিত্র ফুটে ওঠে কবিতায় সেটাই কল্পচিত্র।

এখানে বলা যায়, শব্দ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা দেখি যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শব্দ এককভাবে উচ্চারিত হয় না। শব্দ অর্থসঙ্গতি খুঁজে পায় একটি বাক্যের ভেতর। আবার দেখা যায়, এক একটি শব্দ তার আগের ও পরের শব্দের অর্থ ও ব্যঞ্জনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। এখানে বলা দরকার, কোনো বিশেষ শব্দের মানে জানা না থাকলেও এ প্রসঙ্গে বাস্তব চিন্তা-ভাবনা, অনুমান, উপস্থিত বুদ্ধিকে খাটিয়ে তার সাহায্যে অর্থ উদ্ধার করতে পারা যায়। এ বিষয়টি ভিন্ন ভাষায় লেখা গল্প-উপন্যাসের বেলায় বেশি হয়ে থাকে। তবে কবিতাতেও তা’ লক্ষ্য করা যায়। যেমন ধরুন, একটি শব্দের একাধিক অভিধানিক অর্থ থাকতে পারে। সেগুলো প্রত্যক্ষ অর্থ। প্রত্যক্ষতার বাইরেও উক্ত শব্দটির আলাদা অর্থ থাকতে পারে, তা’ মানুষের প্রত্যাহিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বুঝা যায়। ‘কথাটা শুনে রহিমের মুখ কালো হয়ে গেল’Ñ বর্ণিত বাক্যের ‘কালো’ শব্দটির একাধিক অর্থদ্যোতনা লক্ষ্য করা যায়। দৃষ্টান্তটি খুব সাধারণ মনে হয়। কিন্তু কবিতায় তার চাইতেও অনেক বেশি প্রতীকী, অনেক গভীর ভাবসঞ্চারি শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কবিতার অঘোষিত একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে। যদিও অনেকেই মনে করেন, ‘আধুনিক যুগে আধুনিক গদ্য কবিতা কোনো নিয়ম-শৃঙ্খল মানে না। অন্তমিল, ছন্দ-মাধুরী, অলংকরণ ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না।’

আমি কিন্তু এর ঘোর বিরোধী। আসলে উদারমনা বা আধুনিক হতে গিয়ে কেউ যদি তার ঘরের চাল, বেড়া ইত্যাদি বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে নির্মাণ না করে শুধু খুঁটি বসিয়েই ভাবে যে, তার ঘর সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, তাহলে কি পরিপূর্ণ ঘর হয়ে যাবে? একটি ঘরে যেমন চাল, বেড়া, খুঁটিসহ আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্রের প্রয়োজন হয়, তেমনি কবিতার জন্যেও অন্তমিল, ছন্দ-মাধুরী, অলংকরণ, ভাষা রীতি, বাস্তবতা, সামঞ্জস্যপূর্ণ, ভাবসঞ্চারি, প্রতীকী শব্দ প্রয়োগ ইত্যাদি অপরিহার্য। যেমন ধরুন নিম্নের কবিতাটি:
“ওই বনজোছনায় উড়ে বেড়ায় জোনাকিরা
বাতাসে শিষ দেয় শালিখ
এমনি রাতে বের হই আমি
ভালো লাগে চাঁদের আলো।”

কেমন হলো? প্রথমত ‘বনজোছনায় উড়ে বেড়ায় জোনাকিরা।’ জোনাকিরা আসলে কি বনজোছনায় উড়ে বেড়ায়? বাস্তবে নয়, যদি রূপক হয় তাহলেই হতে পারে। তবে বাস্তবতা এই যে, জোনাকিদের অন্ধকারেই মানায় এবং অন্ধকার রাতেই জোনাকিদের দৃষ্টিগোচর হয়, বনজোছনায় নয়। কবিতাটি এমন হলে কেমন হয়?
“ওই বনজোছনায় ঘুরে বেড়ায় আমার মন একাকী
অন্ধকার রাতে যেমন আলো দেয় সহস্র জোনাকি
বাতাস শিষ কাটে, শালিকেরা ঘুমায় আনমনে
এমনি রাতে আমি বের হই সঙ্গোপনে।”

উদ্দেশ্য ছাড়া যেমন লক্ষ্য অর্জন করা কষ্টসাধ্য, এমনকি অনেকক্ষেত্রে সম্ভবপরও নয়, তেমনি কবিতার ক্ষেত্রেও প্রয়োজন অনুশীলন, ভাষা, শব্দ ও ছন্দের মাধুর্য ও উৎকর্ষতা। সে সাথে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন, রচনাটি যেন একেবারেই অসারতাপূর্ণ, অসম্পূর্ণ না হয়। একজন কবি লিখেছিলেন, “কপাল ভিজিয়া গেল নয়নের জলে।” কবি এরপর বহু চেষ্টা করেও পরের লাইন রচনা করতে সক্ষম হননি। কারণ নয়নের জলে কি কখনো কপাল ভিজে? ব্যাপারটা অবাস্তব, তাই না? কিন্তু যখন একজন প্রতিভাবান কবি ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামালেন, তখন তিনি পরের লাইনটি বাস্তবতায় ভরিয়ে দিলেন। তিনি লিখে দিলেন, “পা দুখানি বাঁধা ছিলো কমলের ডালে।” বাহ্ হয়ে গেল সার্থক রচনা।
‘কপাল ভিজিয়া গেল নয়নের জলে
পা দুখানি বাঁধা ছিলো কমলের ডালে।’

প্রকৃত প্রতিভাসম্পন্ন, চিন্তাশীল অধ্যবসায়ী কবি-সাহিত্যিকগণ সত্যিকার অর্থে শুধু ভাষার উৎকর্ষতাই সাধন করেন না, বরং তাঁরা বাস্তবতার নিরিখে নিত্য-নতুন শব্দমালাও তৈরিও করেন। কবিরা শব্দ নিয়ে খেলা করেন, শব্দের বীজ বপন করেন। সেই বীজ থেকে অংকুর গজায়। অংকুর বড় হয়ে মহীরুহে পরিণত হয়।

একজন চাষী যেমন যেমন ধান বপনের আগে জমিটি কর্ষণ করেন, প্রয়োজন হলে আগে গোবর বা জৈব সার দিয়ে জমির উর্বরতা বাড়িয়ে নেন তারপর ধান বপন করেন। বপন করেই তিনি বসে থাকেন না। সবসময় জমি পাহারা দেন, যাতে পশু-পাখি তার বপনকৃত ধানের শিষগুলো বিনষ্ট করতে না পারে। তেমনি একজন কবিকেও কবিতা রচনার আগে তাকে কবিতা রচনার প্রয়োজনে ভাষা কর্ষণ বা উৎকর্ষতা, পরিশুদ্ধতা ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক ভাবতে হয়।

প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, পৃথিবীতে শুধুই একজন রবীন্দ্রনাথ, একজন নজরুল, একজন মাইকেল মধুসূদন, একজন জীবনানন্দ প্রমুখ আছেন। দ্বিতীয় কোনো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল মধুসূদন, জীবনানন্দ বা তাঁদের সাথে তুলনীয় কেউ আছেন কি? এদের মধ্যে শুধুমাত্র বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামই স্কুলের পাঠ সমাপ্ত করেনি। তবুও তিনি হয়েছেন জাতীয় কবি। কিন্তু অন্যরা যেমন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, মধুসুদন দত্ত এরাতো স্কুল-কলেজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অধ্যয়ন করার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম তেমন একটা পাননি। কারণ, তাঁর জীবন কেটেছে দুঃখ-দারিদ্র্য, অবহেলা, সার্বিক কষ্টের মধ্য দিয়ে। স্কুলের পাঠ শেষ না করে তিনি চলে গিয়েছিলেন যুদ্ধে। তাঁর বেশিদূর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু কবি নজরুল কি এমনি এমনিই বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন বলা যাবে? তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনিও চাষীদের মত শব্দের বীজ বপন করে তা’ থেকে নতুন শব্দচারার অংকুর গজিয়েছেন। এটা ছিলো তাঁর গভীর অধ্যবসায় ও সাধনা। জীবনের চাওয়া-পাওয়ার অসামঞ্জস্যতা, দুঃখ-কষ্ট, দেশপ্রেম ও সাহিত্যের প্রতি গভীর ভালোবাসা তাঁকে করেছে সত্যিকার সোনা।

আজকের যুগে এদের মতো যদিও কবি প্রতিভা জন্মায় না তবুও আল-মাহমুদ, শামসুর রাহমান, সমুদ্র গুপ্ত, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শহীদ কাদরী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আবুবকর সিদ্দিক প্রমুখের মতো কবি আছেন যাদের কাব্য রচনা অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের এবং সেই রচনা বাস্তবতার নিরিখে মহামূল্যবান। এদের কবিতা কিন্তু এমনি এমনিই হয়ে যায়নি। এদেরকেও জীবনের অনেকটা সময় ধরে কবিতা নিয়ে উপরে বর্ণিত চাষীর মতো কর্ষণ, সার প্রয়োগ, বীজ বপন, আগাছা পরিষ্কার ও পশুপাখির আক্রমণ থেকে চাষকৃত ফসলকে বাঁচানোর জন্যে পরিশ্রম করতে হয়েছে। ক্ষেতে বীজ বপন করলেই যেমন ফলন হয় না, তেমনি দু’চার লাইন রচনায়ই তা’ কবিতা তথা সাহিত্য বলে পরিগণিত হয় না। অনেকে মনে করেন, শুধুমাত্র কল্পনাই কবিতার সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই যার কল্পনার প্রখরতা যত বেশি তিনিই ততো বড় কবি। কোলরিজ, ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ কিন্তু ওই মত সম্পূর্ণভাবে মানেননি। কল্পনা- সেতো অলীক চিন্তার ফসল নয়। তাই দেখা যায়, খামখেয়ালিপূর্ণ উচ্চারণ উন্নতমানের কবিকল্পনার পরিচয় বহন করে না।

কবিতা মূলতঃ শব্দশিল্প। তাই কবিতা রচনার ক্ষেত্রে এতে সঠিক শব্দের বহুমাত্রিক উচিত প্রয়োগই হলো কবির প্রধান ও প্রাথমিক কাজ। কবিতায় কল্পলোক, বাস্তব, অবাস্তব ও ভাষা রীতির সুষ্ঠু ও সম্পূর্ণ সার্থক প্রয়োগ এবং নিখুঁত কল্পচিত্র নির্মাণের জন্যে চাই ভিন্নতর দৃষ্টি, কবিমনের বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনার বাণী। যা প্রচলিত ভাষার অভিধানিক চরিত্র বদলে দিয়ে স্বাধীন শব্দার্থের নিজস্ব এলাকায় বিন্যস্ত করতে সক্ষম হয়।

কবিতা রচনার ক্ষেত্রে কবির কল্পলোকের কল্পচিত্রে থাকবে বাস্তবতায় মেশানো, অবাস্তবতা নয়। আজকের পরিচিত দৈনন্দিন বাস্তবও যে ক্রমশ সার্কাশসদৃশ এবং তার মধ্যেই যে বসন্তকাল শুকিয়ে শেষ হয়ে গেছেÑএ অনুভবেরও কিন্তু জন্ম দেয় একজন কবির কবিতা। ঘোড়া কিংবা কোকিলকে আমরা যতটা পছন্দ করি, শেয়াল কিংবা শকুনকে কিন্তু সেই একইভাবে গ্রহণ করতে পারি না। আমরা দেখি জীবনানন্দের কবিতায় এ অনুপস্থিত ছায়াচ্ছন্ন বাস্তবতা, জীবনের সঙ্গে যার গোপনীয় সুরঙ্গলালিত সম্বন্ধ; সম্বন্ধের ধূসরতা ও নতুনত্ব’। অন্ধকার বনলতা সেন এই দুর্নিবার বেদনাকে অতিক্রম করার প্রবল আগ্রহে ভয়াবহ বাস্তব দ্বারা আক্রান্ত কবি তখনই চান এ রকম প্রথাবদ্ধ বাস্তব, যাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং যার আহার-নিদ্রা-মৈথুনের চক্রে সুতোয় জড়িয়ে যাচ্ছি। এর প্রতিপক্ষ শক্তিকেই বলা হচ্ছে ‘অনুপস্থিত বাস্তব’, যাকে আমরা আদৌ দেখতে পাচ্ছি না এবং যার ছায়াচ্ছন্ন আভাসের মধ্যেই আমরা নিবেশিত হয়ে ভেঙে দিতে চাইছি এই বাস্তবতার চক্র। তিনি অনুমান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন পূর্ববর্তী বাংলা কবিতায় কল্পলোক আছে, কিন্তু সে কল্পলোক অসীম অভিসারী রোমান্টিক কল্পলোক, যে কল্পলোকের ভেতর রয়েছে বাস্তবকে মাঝখানে মধ্যবিন্দু রেখে এবং কখনও-বা বাস্তবকেই অস্বীকার করে তার চারপাশের আবেগাশ্রিত পরিভ্রমণ। কিন্তু কোথাও সেই কল্পলোক থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে না পরাবাস্তবের আধুনিকতা, যার মাধ্যমে ব্যক্তির গভীর অস্তিত্বের সংকটকে এবং অবচেতনার গূঢ় রহস্যকে প্রতিফলিত করা যায়। ‘ঝরা পালকে’ তাই কবির মগ্নস্বরের আহŸান-‘হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক।’ এই যে কল্পলোকের প্রতি আহŸান, যে ব্যক্তিগত আহŸানের সঙ্গে জীবনানন্দ মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁর স্বপ্নময়ূরের ডানা- এ থেকেই বুঝা যায় যে কল্পলোকের মাধ্যমে তিনি বাস্তব পরাবাস্তববাশ্রিত একটি পৃথিবীর সন্ধানী, যে পৃথিবী অনেক কবির কাছেই অচেনা। অথচ যে পৃথিবীকে অনেক কবিই ‘খুঁজে মরে অনিবার, পায় নাকো পথের সন্ধান।’

তখনই জীবনানন্দ লেখেন:
“ফাগুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী,
অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,
লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ,
অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি,
রামধনু রঙের কাচের জানালা,
ময়ূয়ের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়
কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের
ক্ষণিক অভাস
আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।”
(নগ্ন নির্জন হাত : বনলতা সেন)

উন্নতমানের ভাব ও প্রকাশরীতির বাস্তবতার কারণে অগ্রসর কবিতা সব সময়ই বহু যুগ পরের পাঠক ও সমালোচকদের কাছে সাদরে গ্রহণযোগ্য হয়। জন ডান, জেরাল্ড মেনলি হপকিনস, জীবনানন্দ দাস প্রমুখ তার অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রবীন্দ্রনাথও তার শেষ জীবনে কবিতায় কল্পচিত্র প্রয়োগের ব্যাপারে অতি সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। তার মধ্য বয়সে রচিত কবিতা ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’র কথা বলা যেতে পারে। যেখানে সম্পূর্ণ কবিতায় ফুটে উঠেছে বাস্তব কল্পলোকের কল্পচিত্র ও ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বহুমাত্রিক প্রকাশ।