কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলা প্রসঙ্গে

গুলশান আরা বেগম :

মার্চ ২০২০ হতে এ পর্যন্ত কোভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা প্রসংগে যত কথা সরকার মশাই বলেছে, আমরা বড়রা ক’জন তা শুনেছি, ক’জন মেনে চলেছি?

একসাথে দশটি নাপা খেয়ে এয়ারপোর্টের সতর্ক-বেড়ি পার হয়ে ঘরে ফেরার আবেগ প্রদর্শন থেকে শুরু করে লকডাউন অমান্য করে চোর পুলিশ খেলা, করনা অ্যাফেক্টেড হয়ে সরকারি বিধি-নিষেধ অমান্য করে লঞ্চ, ট্রাক ও মাছের ড্রামে করে আপনজনদের কাছে পৌঁছানোসহ কোন কোন অপচেষ্টা আমরা করিনি? করোনাকে মহামারী পর্যায়ে আসার পেছনে তো আমরা অ্যাডাল্টরাই দায়ী।

এমন এক আজব চরিত্র আমাদের, বিদেশের মাটিতে ট্রাফিক আইন মেনে বৃত্তাকারে চার কিলো মিটার গাড়ি চালিয়ে আগের স্থানে ফিরে এসে রোড ক্রস করি, অথচ দেশের মাটিতে ট্রাফিক এর উপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে রোড ক্রস করি।

বড়দের যেখানে এই হাল, সেখানে শিশুদেরকে নিয়ম শিখিয়ে দিলেই ওরা পাই পাই করে কোভিড-স্বাস্থ্য বিধি মেনে ক্লাশ করবে, এর কোন গ্যারান্টি দেয়া অভিভাবক ও স্কুল কর্তৃপক্ষ কারো পক্ষেই সম্ভব হবে কি?

এ দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই কোভিড মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রেখে ক্লাশ নেয়া সম্ভব হবে বলে আমি মনে করিনা। শিক্ষার্থীদের (বিশেষ করে শিশু শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত) পক্ষেও ১০০% স্বাস্থ্য বিধি মেনে প্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া করতে পারার কোন নিশ্চয়তা নেই।

বর্তমানে করোনা মহামারী রূপ ধারণ করেছে। এ অবস্থায় কোমল শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া করলে তাদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যাবে।

প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে আমি মনে করি কমপক্ষে আগস্ট/২০২০ পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত। শিক্ষার্থীরা যতটা পিছাবে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাদের জীবন।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অতিরিক্ত ক্লাশ নিয়ে, ছুটি ছাটা কমিয়ে, প্রয়োজনে আগামী জানুয়ারি মাসকে চলতি শিক্ষা বর্ষের সাথে যোগ করে সিলেবাস ও পরীক্ষা শেষ করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ, যদি শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগের সদিচ্ছা থাকে।

আমরা যদি হিসাব করি

১৭ মার্চ হতে শুরু করে আগস্ট/২০২০ পর্যন্ত পরীক্ষা বাদে মোট ৭৩ দিন ক্লাশ মিস হবে শিক্ষার্থীদের। যদি অক্টোবরে ক্লাশ শুরু করা যায়, তাহলে ডিসেম্বর/২০২০ পর্যন্ত সকল ছুটিছাটা (শুক্রবার ব্যতীত) বাদ দিলে অতিরিক্ত সময় পাওয়া যাবে ২৩ দিন। ২০২১ এর জানুয়ারিকে এ শিক্ষাবর্ষের সাথে যোগ করলে মোট সময় পাওয়া যাবে ৪৮ দিন। বাকি ২৫ দিনের পড়া সিলেবাস কমিয়ে শেষ করা যাবে। এ সময়টাতে কোর্স সম্পন্ন করার নিমিত্তে নিম্ন উল্লিখিত উপায়গুলো অবলম্বন করা যেতে পারে :

১। কঠিন বিষয় গুলোর উপর স্কুল সময়ের বাহিরে সকালে রুটিন ভিত্তিক দুটো করে অতিরিক্ত ক্লাশ নেয়া।
২। সিলেবাস এর যে অংশটুকু নিচের শ্রেণীর সিলেবাস এর সাথে সম্পৃক্ত, কম গুরুত্বপূর্ণ কিংবা যে অংশটুকু উপরের শ্রেণীতে ভালোভাবে পড়ানোর সুযোগ আছে – এগুলো বাদ দিয়ে সিলেবাস কমিয়ে আনা।
৩। কিছু কিছু বিষয় সাজেশনভিত্তিক পড়ানো।
৪। অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর তিনমাস পুরোপুরি ক্লাশ নিয়ে ১১/০১/২০২১(জানুয়ারি/২০২১) তারিখের দিকে বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া।
৫। যেসব প্রতিষ্ঠান হোমওয়ার্ক, হোম টেস্ট বা অনলাইন টেস্ট নিয়েছে ঐসব পরীক্ষার সাথে অক্ট,নভ,ডিস এ তিন মাসে তিনটি মাসিক পরীক্ষা (কমপক্ষে বিশ নম্বর করে) নিয়ে এসব পরীক্ষার নম্বরের একটা অংশ বার্ষিক পরীক্ষার সাথে যোগ করা।
৬। লকডাউনে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা এবং আর্থিক সহায়তা দিয়ে শিক্ষাবর্ষ চলমান রাখতে সাহায্য করা।
৭। সম্ভব হলে ৫০/৬০ জনের চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী যে সব শ্রেণীতে এদেরকে একাধিক সেকশনে ভাগ করে পড়ানো।
৮। জোড় বিজোড় ক্রমিক নম্বরে সেকশন ভাগের পরিবর্তে সবল-দুর্বল এভাবে ভাগ করে পাঠদান করা, যাতে সিলেবাস দ্রুত শেষ করা যায়।
৯। ১০/জানুয়ারি,২০২১ এর পরে ২০২০ সালের বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া।
এদিকে আমরা শিক্ষক কর্মচারী স্বাস্থ্য বিধি মেনে নিয়মিত অফিস করতে পারি। প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কাজ, অনলাইন ক্লাশ নেয়া, হোম টেস্ট নেয়ার আয়োজন করা সহ অনেক কাজ প্রতিষ্ঠানে এসে করা যায়। ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে হোম ওয়ার্ক দেয়া ও তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া যায়। ইতোমধ্যে আমার প্রতিষ্ঠান সহ অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকগণ কাজ শুরু করেছেন।
কোভিড-১৯ মহামারী পর্যায় থেকে স্বাভাবিক পর্যায়ে না আসলে এবং World Health Organization (WHO) এর দেয়া নির্দেশনা মেনে ক্লাশ চালানো নিশ্চিত না করা পর্যন্ত শিশুদেরকে প্রতিষ্ঠানে ডাকা কোনভাবেই ঠিক হবেনা।

বর্তমানে যেভাবে মানুষ চলাফেরা করছে দেখা যায় সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি ১০% ও মানা হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ শীঘ্রই কমে যাওয়ার বা নিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠান খুলে বাচ্চাদেরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া শিক্ষক ও অভিভাবক কেহই চাইবেনা।

আমি শিক্ষক, পাশাপাশি একজন অভিভাবক ও। আমাকে স্কুল খুলতে বাধ্য করা হলে ও, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিরাপদ পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত আমি নিজেই আমার সন্তানদেরকে প্রতিষ্ঠানে পাঠাবোনা। তাদের জীবনের নিরাপত্তা আগে, তারপর পড়ালেখা।
চলুক আরো কিছুদিন এভাবে, শিক্ষার্থীরা ঘরে থাকুক আরো, নিরাপদে থাকুক আরো কিছুদিন।

লেখক পরিচিতি : গুলশান আরা বেগম
প্রধান শিক্ষক, আবেদা নূর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়
গল্লাই, চান্দিনা, কুমিল্লা।