শিল্পী-সাহিত্যকর্মীদেরও পেট আছে!

প্রসঙ্গ : লেখক জাহাঙ্গীর হোসেনের প্রকাশিত লেখা ‘সভ্যতার স্বার্থেই শিল্পী-সাহিত্যকর্মীদের বাঁচাতে আশু পদক্ষেপ আবশ্যক’

ক্ষুদীরাম দাস :

লেখক জাহাঙ্গীর হোসেন একজন প্রাবন্ধিক (আহ্বায়ক, চাঁদপুর লেখক পরিষদ) তার প্রকাশিত লেখাটি পড়ে আমার ভালো লাগলো, আর যথার্থ বলেই মনে হলো। তবে কথা হলো, এ বিষয়ে আরো আগে থেকেই যদি নজর দেয়া যেতো তাহলে শিল্পী-সাহিত্যকর্মীদের বাঁচার পথটা তৈরি হয়ে যেতো। লেখার শিরোনাম থেকেই এটা স্পষ্ট যে, একটা পদক্ষেপ নেয়া দ্রুত দরকার।

আমার মতে, শিল্পীর কাজ; আর সাহিত্যকর্মীদের কাজ সৌখিন, ভালো লাগা অথবা প্রেমিক প্রেমিকাদের মতো ভালোবেসে সময় খরচ করা। এর সাথে শ্রমের মূল্য সংযোজন কতোটা জরুরী হওয়া দরকার সে বিষয়ে আমার প্রশ্ন। সবাই শিল্পী অথবা সাহিত্যকর্মী হতে পারে না, হয়ও না। যদি তাই হতো তাহলে হয়তো রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের মতো লেখক আর রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, এন্দ্রো কিশোরে দেশ ভরে যেতো। শিল্পী গুণ আর সাহিত্য গুণ হলো বিধাতা প্রদত্ত-এ বিষয়ে অবশ্যই শিরোনামের লেখক আমার সাথে একমত হবেন।

যারা সাহিত্য রচনা করেন, তারা অনেকটা ভালো লাগা থেকে, নেশা থেকেই গল্প, কবিতা লিখেন। আর তা’ প্রকাশের জন্যে কোনো মাধ্যমে পাঠান অর্থাৎ কোনো পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে। সেটি প্রকাশিত হয়, আর পাঠক পড়ে জ্ঞানার্জন করেন; লেখক আনন্দিত হয়ে থাকেন। পাঠকের মনে স্থান করে নেন লেখক। লেখক হয়ে উঠেন তার কাছে একজন পরিচিত ও বিশেষ ব্যক্তি বা অনুসরণীয় ব্যক্তিতে। লেখককে শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে বসান। মনে হয়, এটাই লেখকের সবচেয়ে বড় পাওয়া। শিল্পীর বেলাতেও একই কথা বলা যায়। এমন কিছু বিষয় আছে যা অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, যা করেন শিল্পী ও সাহিত্যকর্মীরা। এখন আমার প্রশ্ন যদি তাই হতো, তাহলে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাগুলোর সম্পাদকরা নিশ্চয় লেখকদের কথা চিন্তা করতেন। আর তাদের প্রতিটা লেখার জন্যে সম্মানী বা পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করতেন (কিছু কিছু পত্রিকা লেখকদের সম্মানী দিয়ে থাকেন)। কিন্তু সাহিত্যকর্মীরা সেভাবে কোনো অর্থ পাচ্ছেন না। তাই বলে সাহিত্যিক ও সাহিত্য চর্চা কমে যাচ্ছে না। আর যদি সম্মানী বা পারিশ্রমিকের কথা আসে তাহলে অবস্থাটা কতোটা সম্মানের পর্যায়ে থাকবে সেটাও প্রশ্ন। সে রকম যদি হয়েও যায়, তাহলে লেখকের সংখ্যা বাড়বে, শিল্পীর সংখ্যাও বেড়ে যাবে।

অপরদিকে শিল্পী-সাহিত্যকর্মীদেরও পেট আছে। সেদিকটা চিন্তা করলে তাদেরও পেট ভরা ও সংসারের চিন্তা করতে হয়। যদি শিল্পী-সাহিত্যকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়া হয় তাহলে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশে প্রচুর শিল্পী রয়েছে; বোধ করি লেখকের সংখ্যাও কম নয়। সেই হিসেবে এতো শিল্পী ও লেখকদের যদি ভাতার কথাও চিন্তা করা হয় তাহলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এতো টাকা কোথায় পাওয়া যাবে, সেটাও ভাবা দরকার বৈকি। বোঝার জন্যে যদি নিজেদের সংসারের কথা চিন্তা করি, তাহলে একটা খাত থেকে কমিয়ে তারপর নতুন খাত তৈরি করার ব্যবস্থা করতে হবে। অথবা ঐ টাকা সংগ্রহের জন্যে বৃদ্ধি করতে হবে।

করোনাকালে শুধু মানুষের জীবনই নয়, সবদিকেই সমস্যা তৈরি করেছে। তার ব্যাখ্যা করে শেষ করা যাবে না। আর সেই সাথে অর্থনীতির অবস্থাও খারাপের দিকে। সবারই অবস্থা খারাপ; কে কাকে বাঁচাবে? তবুও মানুষ মানুষের পাশে রয়েছে। সুতরাং সবদিকেই অর্থের সমস্যা; সুতরাং কে কাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করবে?

লেখক লিখেছেন, ‘কিন্তু সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে জড়িত শিল্পীগণ মুখ থুবডে আছে। তাই শিল্পীদের পক্ষে নতুন করে কোনো কিছু নির্মাণ অসম্ভব হয়ে পডেছে। সে কারণেই তারা প্রকট অর্থ সংকটে পতিত। কেউ কেউ তো জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে। সময়ের সাথে সাথে এ সঙ্কট আরও বড হবে।’ এই অংশটুকুতে মনে হলো, করোনা মহামারীর আগে সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে জড়িতরাই অর্থ তাদের এই কাজের মাধ্যমেই অর্থ উপার্জন করতেন; আর এখন করোনা মহামারীর কারণেই তাদের অর্থ উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। বিষয়টি কি সে রকমই বোঝাচ্ছে না? যদি তাই হয়, তাহলে শিল্পী ও সহিত্যকর্মীরা গরীব থাকতো না।

আমি লেখকের সাথে একমত যে, তিনি লিখেছেন ‘ শিল্পীরা অর্থসংকটে কারও কাছে হাত পাততে পারে না। লাজুক এ শিল্পীরা এ জায়গায দিশা খুঁজে না পাওয়ায় থমকে যাচ্ছে তাদের মেধা ও মননশীলতা।’ যদি তাই হয় তাহলে এভাবে চিন্তা করাটা কতোটা লাভজনক হবে? সরকার কি শিল্পী ও সাহিত্যকর্মীদের কথা আলাদাভাবে চিন্তা করবে। আদিতেও করেনি, ভবিষ্যতে করবে কিনা প্রশ্ন! তবে আমার আপনার এ কথাগুলো কতোটুকু বাস্তবায়িত হতে পারে সেটাই প্রশ্ন। আপনি এক জায়গায় বলেছেন, ‘করোনা মহামারিকালে তাদের জীবন-জীবিকার ভার সরকার তথা জাতিকেই নিতে হবে। করোনা পরিস্থিতিতে আর্থিক দৈন্যতা মোকাবেলায় কোনোমতে তাদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা ও পোশাক পরিচ্ছদের যোগান দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ আমিও সাদামাটাভাবে বলতে চাই যে, এটা আদৌ সম্ভব হবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা কতোবার পরিবর্তন করতে হয়েছে সেটা কি আমরা জানি না! আর এখন শিল্পী ও সাহিত্যকর্মীদের তালিকা করতে গেলে সরকারের কতো টাকা ব্যয় করতে হবে সেটা কি চিন্তার বিষয় নয়? এই তালিকা করতে গেলেই তো বিশাল সময় চলে যাবে, তালিকা করতে গিয়ে টাকার খরচ হবে, অনেককে শ্রম দিতে হবে। করোনাকালে এই কাজ করাটা কতোটা কষ্টকর হবে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থাৎ বাড়তি ঝামেলা হবে বলে আমি মনে করছি; তবে আপনার দাবিও অযৌক্তিক নয়।

লেখক যথার্থই লিখলেন যে, ‘এবারও বিনোদন-সংস্কৃতি খাত অবহেলিত। সাহিত্যকর্মের জন্যে নির্দিষ্ট কোনো কিছু নেই। অথচ যে শিল্পী নাটক কিংবা গান করেন, সেটা কিন্তু একজন লেখকই লিখেন। প্রথম লেখককেই লিখতে হয, তারপর হয় প্রদর্শন। এসব শিল্পী নেপথ্যে থাকার কারণেই দর্শক-স্রোতাদের কাছে পরিচিতি কম। যে কোনো মুহূর্তে কবি-লেখকদের ভূমিকা না থাকলে ভাল কাজ সম্পন্ন হতে পারে না। যেমন সংবাদকর্মী তথ্য সংগ্রহ না করলে মানুষ তথ্য পাবে কোথায়? সেক্ষেত্রে কবি, লেখক ও সাংবাদিকদের ভূমিকাই সংস্কৃতি কাজের সূচনালগ্ন। অথচ রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা তাদের ক্ষেত্রে তুলনামূলক কমই রাখা হচ্ছে। সাহিত্যের সাথে সাথে সংস্কৃতির কোনো বাদানুবাদ নেই বরং পরিপূরক। অর্থাৎ সাহিত্যকর্মই সংস্কৃতি। সংস্কৃতির পাটাতনই সাহিত্য।’ এটা স্বাভাবিক যে, গানের জন্যে শিল্পীই কিন্তু শ্রোতার হৃদয় দখল করে নেন। তাকেই সবাই চিনে, এটা একেবারে সত্য। কিন্তু সেই গানটি যে লিখেছে, কেউ চিনে না, আলাদাভাবে শ্রোতাও কে লিখেছে গানটি সেটা খুঁজতে যান না। লেখক সাহেব, দুঃখ পাবেন না; হয়তো এটাই স্বাভাবিক। যদি তাই হতো তাহলে গানের রচয়িতাকে আগেই চিনে নিতো সবাই।

লেখকের সাথে আমিও একমত হয়ে বলতে চাই যে, বিনোদন-সংস্কৃতি খাত কেন যে অবহেলিত? ‘ আমরা জানি সংস্কৃতির উন্নতি মানেই শিক্ষার উন্নতি। তাই দেশকে উন্নতির দিকে ধাবিত করতে গেলে সংস্কৃতিতে পৃষ্ঠপোষকতা অনিবার্য।’ এ নীতিতে বিবেচনা করে সরকারকে ভেবে দেখা দরকার ও আরো গুরুত্ব দেয়া উচিত।

লেখককে বলতে চাই যে, ‘অর্থই অনর্থের মূল’ বলে কথা আছে। যেখানে অর্থ আছে সেখানে কী ঘটে সেটা আমরা নিশ্চয় জানি। যদি আপনার দাবি অনুযায়ী শিল্পী-সাহিত্যকর্মীদের বিষয়ে বিবেচনা করে বাজেট প্রণয়ন করা হয় তবে সেখানে শিল্পী-সাহিত্যকর্মীদের ব্যক্তিত্ব, সম্মান ঠিক থাকবে তো! নাকি টাকার গন্ধে সব লণ্ডভণ্ড হবে!

সাহিত্যকর্মকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সুতরাং এটা যথার্থ যে, শিক্ষার্থী তথা শিক্ষিত ও সমঝদার মানুষের মেধা-মনন আরো বিকশিত করতে এবং দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য লিপিবদ্ধ করতে এবং মেধা-মনন উৎকৃষ্ট ও বিকশিত করতে এ খাতে বরাদ্দ না করে পথ মসৃণ হতে পারে না। প্রকাশনা, গান, পুস্তক এ সবকিছুতেই সাহিত্যের অনন্য অবদান। এ দিকটিকে খাটো করে দেখার বিষয় নয়। এ ক্রান্তিকালে সংস্কৃতিকর্মীর পাশাপাশি কবি-লেখকগণও দুঃখ-দুর্দশায় রয়েছে। করোনাকাল যদি আরও দুই কিংবা তিনবছরও স্থায়ী হয়, তাহলে সাহিত্য-সংস্কৃতির উপর নির্ভর করা পেশাজীবীগণের বেঁচে থাকাই হুমকিতে পড়বে। সুতরাং অন্তত করোনা কালে তাদের কথাও চিন্তা করা দরকার। সত্যিই আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন এসব সাহিত্য আন্দোলনই বটে। ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মীরাই ছিলেন উপদেশক।

শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্য যদি দুর্বল হয়ে যায় তাহলে গোটা জাতি দুর্বল হয়ে পড়বে। মানুষের মনুষ্যত্বকে জিইয়ে রাখার জন্যে এর বিকল্প নেই। মানুষকে সৃজনশীল হতে হলে শিল্প সংস্কৃতি ও সাহিত্যের কাছে আসতেই হবে। এমনিতেই মানুষ অশান্তিতে রয়েছে, পরিবারে অশান্তি, ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘাত, পাড়ায় পাড়ায় সংঘাত, দলে দলে দলাদলি। ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের প্রতি মানুষ কতো নির্মম ও নিষ্ঠুর হয়ে যায়। চারিদিকে দুর্নীতি, অবিশ^াসের ছড়াছড়ি, অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এসবকে কাটিয়ে উঠতে শিল্প সংস্কৃতি ও সাহিত্যের কোনো বিকল্প হতে পারে না। আমাদের সাহস অর্জনের জন্যে, আনন্দে জীবনযাপনের জন্যে, পরস্পরে মানবতা বিলিয়ে দেবার জন্যে, দেশপ্রেমের মনোভাব জাগিয়ে তোলার জন্যে, আমাদের চেতনাকে জাগিয়ে তোলার জন্যে শিল্প সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সত্যিই লেখকের সাথে একমত হয়ে বলতে চাই যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, আর্থিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হয়ে আরো এগিয়ে যেতে চাই। আর এজন্যে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।