রতন ভাইকে দেয়া কথা রাখতে পারিনি

ফয়েজ আহমেদ :
হাসান আহমেদ রতন (৪০), শাহরাস্তি পৌরসভার নিজমেহার গ্রামের মৃতঃ দাঈমুদ্দিনের পুত্র। ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোঃ মিজানুর রহমানের ভাই। আমার বাড়ি হতে ১ কিঃমিঃ দূরে হবে ওনার বাড়ি। শাহরাস্তি থানার বিভিন্ন হত্যা ও অপমৃত্যু মামলায় লাশের সুরতহাল এবং মর্গে পাঠাতে কাজ করতেন। স্থানীয়ভাবে উনি ডোম রতন হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

আমার সাথে প্রায় ১৬ বছরের সম্পর্ক। ওনার অন্য ভাইদের কাকা ডাকলেও ওনাকে রতন ভাই বলেই ডাকতাম। কোন অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেই সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ওনার ব্যস্ততা দেখতাম। অনেক সময় বিকৃত পঁচে যাওয়া লাশ ময়নাতদন্তের জন্য প্রক্রিয়া করতে গিয়ে অনেক পুলিশ ও সাংবাদিককে গন্ধ এড়াতে মুখ ঢাকতে দেখেছি। রতন ভাই এসবে ভ্রæক্ষেপহীন। বলতেন আমি গন্ধকে ভয় পেলে কে কাজ করবে?

গত বছর লকডাউনে আমাকে একটি সেফটি গগলস কিনে দেয়ার অনুরোধ করলে আমি সাথে সাথে আমার ব্যবহারের গগলসটি ওনাকে দিয়ে দেই (তখন লকডাউনে নতুন কেনা সহজ ছিল না)। সর্বশেষ গত ১ জুলাই নাওড়ায় নিহত নূরুল আমিনের লাশ প্রসেসিংয়ের সময় ওনাকে দেখেছিলাম

। বিকেল হয়ে যাওয়ায় পরদিন লাশ মর্গে পাঠাতে হয়েছিল। রতন ভাই রাতে ওই অর্ধ বিকৃত লাশ পাহারা দিয়ে রেখেছিলেন। আমাদের সাথে রসিকতা করে বলতেন মরে গেলে কেউ পাশে না থাকলেও তিনি থাকবেন। মঙ্গলবার ১৩ জুলাই রাত পৌনে ১২ টার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি চলে গেলেন পরপারে। ওইদিন বিকেলে চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন তিনি। রাতে ওনার আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন হয়েছিল। শাহরাস্তি থানা অফিসার ইনচার্জ মোঃ আবদুল মান্নান নিজে বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে আইসিইউর ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানে নেয়ার আগেই তিনি পরপারে চলে গেলেন। চাঁদপুর জেলা পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ স্যারও বারবার ফোনে তার চিকিৎসার খোঁজ খবর নিয়েছেলেন।

কয়েকদিন আগে আমাকে ডেকে বললেন, দেখ ভাই কেউ অস্বাভাবিক ভাবে মরে গেলে আমি ছাড়া পাশে কেউ থাকে না। অথচ আমার কাজটি সরকারি না। আমি এই কাজ করতে গিয়ে জীবন পার করে ফেলেছি। আমার সন্তানদের ডোমের সন্তান বলে পরিচয় দিতে হয়। তুমি আমার বিষয়ে একটু লেখালেখি করতে পারবে?

আমি বললাম ইনশাআল্লাহ পারবো, এজন্য আমি ওসির বক্তব্য নিব। পরদিন বিষয়টি ওসি সাহেবের সাথে শেয়ার করলে তিনি এ ব্যপারে বক্তব্য দিবেন বলে জানান। ২/৩ দিন পর রতন ভাইকে বললাম আমাকে একটু সময় দিতে হবে। তিনিও সময় দেয়ার সম্মতি দিয়েছিলেন, কিন্তু সময় আমাদের সহায় হন নি। আমাকে সময় না দিয়েই তিনি চলে গেলেন।

রাতে ওনার ভাইয়েরা ওসি সাহেবের কাছে গিয়েছিলেন বিনা ময়নাতদন্তে দাফনে সহায়তার জন্য। ওনার এক ভাই কান্না জড়িত কন্ঠে বলেছিলেন ‘স্যার, সারাজীবন আমার ভাই ময়নাতদন্তের জন্য কাজ করেছেন। আজ তাকে বিনা ময়নাতদন্তে দাফনের সুযোগ করে দেয়া যায় না? অফিসার ইনচার্জ তার ভাইদের অনুরোধ রেখেছেন। এ কথাগুলো যখন লিখছি তখন ওনার লাশ নিয়ে ঢাকা হতে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে। মনের মধ্যে একটা বিষয় বারবার রক্তক্ষরণ বইয়ে দিচ্ছে, রতন ভাইয়ের মতো লোকদের কর্মের স্বীকৃতি কবে হবে? আমিও তো একটা সংবাদ লিখার কথা দিয়েছিলাম। সে কথা তো রাখতে পারিনি।