কাজীদা থেকে মাসুদ রানা হয়ে ওঠার গল্প

ফাতেমা অ্যানি :

বাংলা সাহিত্যের রোমাঞ্চ ও থ্রিলারের নতুন এক লেখনী ভঙ্গির স্রষ্টা তিনি। পাঠক তৈরিতেও কাজী আনোয়ার হোসেন অবদান স্বীকৃত। সেবা প্রকাশনীর মাধ্যমে বড় একটা পাঠক শ্রেণী তৈরি করেছেন তিনি। বাঙালি বিভিন্ন প্রজন্মের শৈশব-কৈশোনকে রঙিন করে দিয়ে ২০২২ সালের প্রথমার্ধেই পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে। তার কৃতিত্ব কিংবা অবদানের কথা সবারই জানা। কিন্তু কীভাবে তিনি হয়ে উঠলেন কাজীদা থেকে মাসুদ রানা?

বয়স মাত্র দশ, সে সময়ই ঘটোৎকচ, যকের ধন, কালো ভ্রমর, ইস্কাবনের টেক্কা এসব বই যেন ছিল তার তটস্থ। এরপর তার হাতে পড়ে রবিনহুড। সেই বইয়ের প্রেমে পড়েই নাকি থ্রিলারের নেশা তৈরি হয়েছিল ছোট্ট আনোয়ারের। ১৯৬৩ সালের মে মাসে ২৭ বছর বয়সে বাবার দেওয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগান প্রেস যার পরবর্তী নাম হয় সেবা প্রকাশনী, তার যাত্রা শুরু করেন, তখন নিজের লেখার বিষয়বস্তু হিসেবে রহস্য-রোমাঞ্চ ঘরানাকেই বেছে নেন।

১৯৬৪ সালে জুন মাসে প্রকাশিত হয় কুয়াশা-১। তবে কাজীদার হাত ধরে মাসুদ রানার আত্মপ্রকাশের কাহিনী বেশ চমকপ্রদ। সময়টা ১৯৬৫ সাল। চলছে পাক-ভারত যুদ্ধ। এরই মাঝে কাজীদার বন্ধু মাহবুব তার বই পড়ে একটুও পছন্দ করলেন না, বরং তাকে জানালেন আধুনিক রহস্য সাহিত্য সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই নাকি কাজীদার।

কাজীদার মন খারাপ হলেও মাহবুবের কিনে দেওয়া ইয়ান ফ্লেমিঙের ‘ডক্টর নো’ বইটি কিন্তু সেই সময় শ্রেষ্ঠ উপহার ছিল তার জন্য। কেননা সেসব বই পড়ার অভিজ্ঞতা থেকেই ঠিক করলেন, তিনিও লিখবেন স্পাই থ্রিলার। স্বদেশের প্রেক্ষাপটে, এক বাঙালি স্পাই। যে স্পাইকে সবাই ‘মাসুদ রানা’ বলে এক নামে চিনি।

তবে এই মাসুদ রানা চরিত্র সম্পর্কে কিন্তু কাজীদার আগে থেকে কোনো ধারণাই ছিল না। তিনি শুধু জানতেন, দেশপ্রেমিক এক দুঃসাহসী বাঙালি যুবকের কাহিনী লিখতে চান। লিখতে লিখতে রানার চরিত্রটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছে তার নিজের কাছে। রানা কী, এবং কী নয় সেটা বুঝতেও বেশ অনেকটা সময় লেগেছে।

মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই ‘ধ্বংস-পাহাড়’। ১৯৬৬ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয় বইটি। তবে কেবল কিছু ইংরেজি থ্রিলার বই পড়েই যে তিনি এই বইটি লিখে ফেলেছিলেন, তা কিন্তু নয়। এই বই রচনার পেছনে তার ছিল লম্বা প্রস্তুতি, নিরলস পরিশ্রম। মোটরসাইকেলে চেপে তিনি ঘুরে বেড়ান কাহিনির ঘটনাস্থল চট্টগ্রাম, কাপ্তাই এবং রাঙামাটি। আজ থেকে ৫৫ বছর আগেকার সেই সময়ে কোনো বাংলা বই লেখার পেছনে এমন অক্লান্ত প্রচেষ্টা কাজীদাকে দিয়েই সম্ভব বটে।

সেবার প্রথম দিককার, বিশেষ করে কুয়াশার প্রথমদিকের বইগুলোর প্রচ্ছদ করতেন প্রখ্যাত শিল্পী হাশেম খান। এরপরে সেবা প্রকাশনীর প্রচ্ছদে নতুন ধারা তৈরি করেন বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরী।