ক্ষমা চাওয়া : ক্ষুদীরাম দাস

ক্ষমা চাওয়া নম্রতা বা ভদ্রতার বহিঃপ্রকাশ। ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হলো-কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত এবং নিজেকে সংশোধন করে নতুনভাবে এগিয়ে যাওয়া। সত্যিই মানব সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশই হলো ভুল করা। আমরা অনিচ্ছাকৃত ভুল করি; অর্থাৎ ভুলটা অজানা কারণে হয়ে যায়। এজন্যে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু কখনো কখনো আমরা জেনেশুনেও ভুল করি। আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে পাপকাজ করি আর এজন্যে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ থাকলেও মানবতা স্খলিত হয়। তবে সেটার বেলাওও অনুশোচনা কাজ করলে ক্ষমা চাওয়া যায়; কিন্তু ক্ষমা পাওয়াটা কখনো কখনো হয়ে উঠে না। কিন্তু আমাদের ঈশ^র দয়াময়। তার কাছে কেউ অপরাধ বা পাপ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে তিনি শুনেন, যেভাবে মোশী (যাত্রাপুস্তক ৩৪: ৯ পদ) ঈশ^রের কাছে ই¯্রায়েল জাতির জন্যে ক্ষমা চেয়েছিলেন।

শৌল সদাপ্রভুর বাক্য অগ্রাহ্য করায় তিনি অন্যায় বা পাপ করেছিলেন। আর তিনি (১ শমূয়েল ১৫:২৫ পদ) কীভাবে বিনয়ের সাথে অন্যায় বা পাপ স্বীকার করে পাপের ক্ষমা চেয়েছিলেন। আমাদের জন্যে একটি উদাহরণ হতে পারে যে, কীভাবে আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। অপরদিকে মানুষ হিসেবে আমরা দায়িত্বশীল; তবে আমরাও ভুল করে অন্যায় করে থাকি। সুতরাং আমরা সবসময়ই ঈশ^রের কাছে ক্ষমা প্রত্যাশী।

ক্ষমা প্রার্থনার সাথে দুটি বিষয় থাকে- একটি অনুতাপ ও অনুশোচনা; অন্যটি হলো কটি হলো আন্তরিকতা। এ দুটির অভাব হলে ক্ষমা চাওয়ার মানসিকতা জেগে উঠে না। ক্ষমা চাওয়ার অর্থই হলো খারাপ কাজ হতে দূরে থেকে খারাপ কাজকে ঘৃণা করে অনুশোচনা করা। আর পুনরায় একই কাজ না করার প্রতিজ্ঞা করা। যেমন ঈশ^রের সাথে অন্যায়ের মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট নয়; তেমনি যখন আমরা তার সৃষ্টি কোনো মানুষকে দুঃখ দিই তখনও সেই মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আমরা অহঙ্কারী মানুষ ক্ষমা চাইতে কুণ্ঠাবোধ করি। যাকে আমরা দুঃখ দিয়েছি তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন মনে করি না। এতে করে আমাদের পরস্পরের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

ঈশ^রের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার ফলে আমরা যে সকল ভুল বা অন্যায় করে থাকি তার শাস্তি মাফ হয়ে যায়। আর অনুতাপ বা অনুশোচনার কান্না খারাপ কাজগুলোকে ঢেকে দেয় বা পুনরায় করতে বাধা প্রদান করে। বাইবেলে বার বার ক্ষমা চাওয়ার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং আমরা যখন কারো সাথে অন্যায় আচরণ করি, তখন আমাদের অবশ্যই ক্ষমা চাওয়া উচিত। মানুষ যখন মুক্তির জন্যে অনুশোচনায় ছটফট করে, তখনই ক্ষমা (২ রাজাবলি ৫:১৮পদ) চাওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে; অবশ্যই এমনই হওয়া প্রতিটি মানুষের জীবনের জন্যে দরকার। কুষ্ঠরোগী নামানের আরোগ্য লাভের জন্যে ক্ষমার প্রয়োজন ছিলো। তাই তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন। এভাবে আমাদের প্রত্যেকের ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

আবার কখনো কখনো আমরা আমাদের কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতা (২ রাজাবলি ২৪:৪ পদ) হারিয়ে ফেলি। যা আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। আর যদি আমরা অনেক বেশি পাপ করি তখনই আমাদের মনে এতটা অনুশোচনা কাজ করে যে, কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা পাবো কিনা-সেই সন্দেহ মনের মধ্যে জেগে উঠে। সত্যিই তখনই আমরা উল্টো প্রশ্ন করি-কেনো আমার অন্যায়ের ক্ষমা (ইয়োব ৭: ২১ পদ) পাবো না? ঈশ^রের কাছে সবসময় ক্ষমা চাওয়া যায়। প্রশ্ন হলো-আমরা প্রতিনিয়ত অনেক পাপ করি, কিন্তু কতবার আমরা ঈশ^রের কাছে ক্ষমা চাই? প্রতি মুহুর্তেই আমরা জেনে, না জেনে কিংবা বুঝে, না বুঝে ভুল করেই চলছি। যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি না কেন সর্বদা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকা উচিত। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, আমরা যেন কখনো শয়তানের ফাঁঁদে পড়ে ঈশ^রের আশির্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে না যাই এবং আমরা যেন ক্ষমা প্রার্থনা করার কথা ভুলে না যাই। অপরাধ স্বীকার করার শিক্ষা (গীতিসংহিতা ২৫: ১১ পদ) আমাদের অর্জন করতে হবে।

সমাজে কিছু মানুষ রয়েছে, বিভিন্ন উপায়ে প্রিয়জন বা প্রতিবেশীকে কষ্ট দিয়ে থাকে, ক্ষতি করে থাকে। তাদের মনে একটু চেতনাবোধ হয় না। ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। এভাবে মানুষ প্রিয়জনকে বা প্রতিবেশীকে হারায়, দূরত্ব সৃষ্টি হয়। কষ্ট পাওয়ার কারণে তাদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় ও ভবিষ্যতে তারাও উল্টো বড় ধরনের কোনো ক্ষতি করে দেয়, যেটার জন্যে আমরা মোটেও প্রস্তুত থাকি না। সুতরাং ক্ষতির উপশম এবং মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন ক্ষমার। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আমাদের নিজেদের পাপ ও ভুলত্রুটির ক্ষমার জন্য আমরা যেমন ঈশ^রের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশা করি, তেমনি যাদের সাথে আমরা অন্যায় করি, তাদের কাছেও ক্ষমা চাওয়ার শিক্ষা অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে অবশ্যই। অন্যায় করে ভুল যদি সত্যিই ভুল হয়ে থাকে, তবে সেই ভুলের কথাটি তার কাছে প্রকাশ করে অনুতাপের সাথে ক্ষমা চান। মনে রাখা উচিত, ক্ষমা চেয়ে কেউ ছোট হয়ে যায় না। মানুষ ভুল-ত্রুটিমুক্ত নয়। যে কোনো কাজেই ভুল-ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। কাজেই সব সময় ভুল-ত্রুটি থেকে রক্ষা পেতে ক্ষমা প্রার্থনা করাই উত্তম। কীভাবে সুন্দর করে ক্ষমা চাইতে হয়, তা দায়ুদের কাছ থেকে আমাদের শিখতে হবে। গীতসংহিতা ২৫:১১ পদে রয়েছে, ‘তোমার নামের গুণে, হে সদাপ্রভু, আমার অপরাধ ক্ষমা কর, কেননা তাহা গুরুতর।’ যারা ক্ষমা চায় তারা ক্ষমা পায় ও করুণা পায় (যিশাইয় ৫৫: ৭ পদ)।

যারা ন্যায় আচরণ করে ও সত্যের অনুশীলন করে তারা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য (যিরমিয় ৫: ১ পদ)। আমাদের কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা পাওয়ার পথ যেন প্রশস্ত থাকে; অন্যথায় কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে (যিরমিয় ৫: ৭ পদ)। ক্ষমা চাইলে ঈশ^র ক্ষমা করেন (যিরমিয় ৩৩ ঃ ৮ পদ)।

প্রতিদিন আমরা অনেক ভুল করে থাকি। সবসময় আমরা শতভাগ সঠিক থাকতে পারি না। তবে কিছু সময় আমরা এমন কিছু ভুল করে বসি যার জন্য আমাদের স্বাভাবিক জীবনে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয় এবং এই ভুলের কোনো সমাধানে না পৌঁছাতে পারলে হয়তো কিছু সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্যে যত বড় ধরনেরই ভুল হোক না কেন, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য আমাদের ক্ষমা চাওয়া এবং এই ভুলের সমাধান বের করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা থাকে না। সুতরাং যে ভুল বা অন্যায় আমরা করি তার জন্যে ক্ষমা চাওয়া আমাদের উচিত। আমরা অনেক সময় চিন্তা করি, ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যাকে আমরা দুঃখ দিয়েছি, সে খুবই দুর্বল এবং সে আমার কিছুই করতে পারবে না। তবে এটা মনে রাখা উচিত যে, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটে যেতে পারে। সুতরাং আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে দুর্বল অসহায় ভাবা উচিত নয়। সে ক্ষতি করতে না পারলেও, আপনার সমর্থন বা উপকারে আসবে না।

একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। গীর্জায় নোটিশ দেয়া হলো-যেন গীর্জাঘর আগামী রোববার আপনার পরিবার পরিস্কার করে। কিন্তু যে রোববার নোটিশ দেয়া হলো সেদিন আপনি অনুপস্থিত। প্রায় রোববার গীর্জায় অনুপস্থিত থাকার আপনার আর আপনার পরিবারের অভ্যাস। আপনাকে জানানোর দায়িত্ব দেয়া হলো আপনার বন্ধুর উপর। কিন্তু কোনো কারণে আপনার বন্ধু নোটিশের কথা আপনাকে জানাতে ভুলে গিয়েছিলেন। পরের রোববার যখন ঘনিয়ে আসলো তখন হায় হায়! তখন আপনার কেমন লাগবে! ভুল যেহেতু হয়েছে, তাই অবশ্যই আপনার বন্ধুর ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া উচিত হবে। এখানে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নটা চলে। তা না করলে হয়তো আপনাদের বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে! তাহলে এরকম অবস্থায় আপনি পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন?

অনেকের কাছেই ক্ষমা চাওয়ার কাজটি অনেক কঠিন। আমরা ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে কাউকে না কাউকে আমাদের কাজ অথবা আচরণ দ্বারা আঘাত করে ফেলি। এর পরিণাম হতে পারে মারাত্মক। ক্ষমা চাওয়ার মানে হলো, আপনি আপনার ভুলের জন্য যথেষ্ট অনুতপ্ত। ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হলো-আপনি এমন ভুল ভবিষ্যতে আর করবেন না বলে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আপনি একবার ক্ষমা চেয়ে যদি একই ভুল আবার করেন, তবে সেটা কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে পরে না। আর ভুল উপলব্ধির মধ্য দিয়ে ক্ষমা চাওয়ার কাজটাও অতটা সহজ না। একটি ভুল করে ফেলার পর থেকেই আপনার মধ্যে অনুশোচনা কাজ করতে থাকে। কখনো কখনো ক্ষমা চাওয়ার আগে আপনার মাথায় এই চিন্তা কাজ করে যে, “ক্ষমা চাইতে গিয়ে আবার অপমানিত হয়ে আসবো না তো?” ভুল যেহেতু করেই ফেলেছেন, সেহেতু কিছুটা হলেও অপমানের শিকার হবেন সেটা ধরে নিয়েই ক্ষমা চাইতে হবে। তাছাড়া সবসময় যে অপমানিত হবেন এমন তো না। হতেই পারে আপনার ভালোর জন্যই অপরপক্ষ আপনার ভুল আগে থেকেই ক্ষমা করে রেখেছে! সত্যিই অনুশোচনা থেকে ক্ষমা চাওয়ার চিন্তা মাথায় আসে। অবশ্য দুষ্ট ও নিকৃষ্ট অহঙ্কারী মানুষের মধ্যে ক্ষমা চাওয়ার প্রবণতা থাকে না। তারা নিজেদের খুবই ক্ষমতাশালী মনে করে। অবশ্য তারা এই ভুল জায়গা থেকে সরতেই চায় না।

আশীর্বাদপুষ্ট যোষেফের জীবন থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। যোষেফের ভাইয়েরা নির্মম আচরণ করেছিলো তার সাথে। তার ভাইয়েরা যোষেফের অপকার করেছিলো। তার সাথে অধর্ম আচরণ করেছিলো, তাকে বিক্রি করে পাপ কাজ করেছিলো। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিপদের সম্মুখীন হয়ে তার ভাইরো তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো। কেননা তারা অনেক অনুতপ্ত ছিলো (আদিপুস্তক ৫০ঃ ১৭ পদ)। সুতরাং পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আগেই নিজের ভুল স্বীকার করে নিন। আপনি যখনই ভুলটা নিজের বলে মেনে নিবেন তখনই আপনার বন্ধু বা অন্য যে কেউ আপনার উপর রাগ করে থাকলে তার রাগ অনেকটা কমে যাবে। কারণ এখানে আপনি পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টা করছেন না, বরং নিজের ভুল মেনে নিয়েছেন। অর্থাৎ আপনি আপনার ভুলের ব্যাপারে অবগত আছেন এবং এর জন্য কী করণীয় তা নিয়ে কথা বলতেও আপনি আগ্রহী আছেন। সময় থাকতেই নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া উচিত। কেননা, আপনার আচরণের কারণে যে রাগের সৃষ্টি হয় সেটা অনেক মানুষ সামনাসামনি জানায় না। বরং ভেতরে এই রাগ পুষতে থাকে এবং একপর্যায়ে সেই মানুষটির সাথে সম্পর্কের দূরত্ব কেবল বাড়তেই থাকে। আপনি নিশ্চয়ই চান না আপনার ভুলের জন্য সম্পর্ক ভেঙে যাক! বাস্তবিক আমরা চারিদিকে তাকালে দেখতে পাই, এভাবে কতো সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে।

বাস্তবিক অন্যায়ের জন্যে ক্ষমা চাইলে আপনার ব্যাপারে কারো যদি ভুল কোনো ধারণা থাকে, তাহলে তা কেটে যাবে। অন্যথায় চিরজীবনই তা মনে রয়ে যাবে। অথবা ভুলে গেলেও জীবনের কোনো এক সময় হঠাৎই তা মনে পড়বে এবং সে কারণে হিসেবের খাতাটা আবার খোলা হতে পারে। রাগটা মনে জমা থাকতে পারে। আর এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যদি কাউকে দুঃখ বা কষ্ট দেয়ার জন্যে ক্ষমা চাওয়া হয় তাহলে সে রকমটা হবে না। কেননা অন্যায়ের জন্যে ক্ষমা চাওয়ার ফলে তা কেটে যাবে এবং এজন্যে তার মনের মধ্যে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না।

সমাজে কিছু লোকের কাছে ক্ষমা চাওয়াটা খুবই কঠিন অথবা তারা কাউকে দুঃখ দিয়ে, ক্ষতি করে ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন মনেই করে না। তাদের মনের মধ্যে অহঙ্কার কাজ করার কারণে ক্ষমা চাওয়ার মানসিকতা জেগে উঠে না। অন্যদিকে তারা এটাও ভাবতে পারে যে, আমি হলাম ক্ষমতাশালী অথবা সে আমার উপরই নির্ভরশীল এবং আমাকে ছাড়া তার চলবেই না। তাছাড়া সে আমার উপর খুবই দুর্বল, সে আমার কিছুই করতে পারবে না; সুতরাং তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এই ভাবনাটা তাদের জীবনের জন্যে খুবই ক্ষতি নিয়ে আসে। কেননা কেউ কারো মনে আঘাত করার মানে হলো তার মনের মধ্যে বিষবৃক্ষ রোপণ করে দেয়া। আর সেখান থেকে যে বৃক্ষের জন্ম নেবে, তা থেকে উৎপন্ন হওয়া ফল প্রকাশিত হবে ভয়ঙ্কররূপে। পুঞ্জিভূত ক্ষোভের রোষাণলে আঘাতকারী ব্যক্তির সমূহ ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সুতরাং ক্ষমা চেয়ে নেয়া উত্তমই বলতে হবে।

কারো কারো ক্ষমা চাওয়াটা হলো দুর্বলতার প্রকাশ বা ভীতু (!); এটা মোটেও ঠিক নয়। তারা নিজেদের শক্তিশালী মনে করে। এজন্যে ক্ষমা চাইতে পারে না। সত্যিই ক্ষমা চাওয়ার জন্যে মানসিক শক্তির প্রয়োজন। আর যাদের মধ্যে মানবতা রয়েছে, লজ্জাবোধ মারাত্মকভাবে কাজ করে তারাই ভুল হলে স্বীকার করে ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর লজ্জা যার মরে যায়, তার আর কিছুই অবশিষ্ট্য থাকে না।

বাইবেলের রাজা ফরৌণের জীবন সম্পর্কে আমরা জানি। তিনি পাপ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলেন (যাত্রাপুস্তক ১০ঃ১৭ পদ)। তিনি ক্ষমা চেয়েছেন বলে ক্ষমা পেয়েছিলেন। অন্যদিকে ই¯্রায়েল জাতির পাপ কাজের জন্যে মোশীও বার বার ক্ষমা চেয়েছিলেন (যাত্রাপুস্তক ৩২ঃ ৩২ পদ)। আর প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমেই পাপের ক্ষমা হয় (লেবীয় পুস্তক ৪ঃ ২০, ২৬,৩১,৩৫পদ)।

সত্যিই অনেক সময় আমরা অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্যায় কাজ করি বা ভুল করে থাকি। তখনই আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আর ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে তখনই দুঃখ দেয়া ব্যক্তির প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই ও তার অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। এর মাধ্যমে আমরা জানাতে চাই যে তাকে আঘাত করার ইচ্ছা ছিলো না এবং ভবিষ্যতে তার সাথে নিখুঁত আচরণ করা আমার উদ্দেশ্য।

সত্যিকারভাবে অনুশোচনাবোধ যখন আমাদের হৃদয়ে কাজ করে, তখন আমরা যে ব্যক্তির ক্ষতি করেছি তার প্রতি আমাদের সহানুভূতি জেগে উঠে। তখন আমরা যাকে আঘাত করেছি বা বা ক্ষতি করেছি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়াটা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে যে ক্ষমা পাওয়া হয় তাতে সুখানুভূতি জেগে উঠে মনের মধ্যে। কেউ যখন দুঃখিত বলে, তখন এমন আশ্বাস দেন যে পুনরায় এটি আর করবেন না। ক্ষমা চাওয়া মানে হার মানা নয়, নিজেকে ছোট করা নয়। ক্ষমা চাওয়া মানে সম্পর্ক ধরে রাখার জন্যে আন্তরিক হওয়া ও পবিত্র প্রচেষ্টা। সত্যি বলতে, একটা ছোট্ট শব্দ ‘সরি’ বলার মধ্য দিয়ে যদি প্রিয় মুখের হাসি ধরে রাখা যায়, তবে কিসের এতো ইগো?

কেউ কারো সাথে খারাপ আচরণ করলে যদি এজন্যে তার হৃদয়ে চেতনা জেগে উঠে বা কষ্ট অনুভব হয়; তাহলে বুঝতে হবে তার মধ্যে বিবেকবোধ কাজ করছে-এটা মনুষ্যত্বের লক্ষণ ও একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিগণিত। আর সত্যিই যদি খারাপ লাগে, তাহলে প্রথম পদক্ষেপ হলো ক্ষমা চেয়ে নেয়া। মানুষের জীবনে ক্ষমা চাওয়ার অভ্যাসটি মহৎ গুণের একটি। আমরা সবাই জানি ক্ষমা করা মহৎ গুণ। কিন্তু ক্ষমা চাওয়া তার চেয়েও মহৎ। কারণ মনে অহঙ্কার থাকলে ভুল বুঝার পরেও ক্ষমা চাওয়া যায় না। কিন্তু ক্ষমা কেউ চাইলে করাই যায়? ক্ষমা করলে বড় হয়, ক্ষমা চাইলে ছোট হওয়ার নামে আরো বড় হওয়া যায়-তাই এটা আরো মহৎ। তবে ক্ষমা চাওয়াটা নিজের মন থেকে চাইলেই সেটাকে বলা যাবে সেটা মহৎ। কিন্তু অনেকেই যে ‘ঝড়ৎৎু’ বলে ক্ষমা চায় – সেটার ৯০% সময়েই কিন্তু নিজের মন থেকে মেনে নেয়া ক্ষমা চাওয়া হয়ে থাকে না। কোন না কোন চাপের কারণেই চায়। যার কাছে চায় সেও জানে। তবুও সে ক্ষমা করে। তবে কারো কারো কাছে এই শব্দটি ফ্যাশন! কিন্তু কারো হাত ধরে বলতে হবে যে, ভাই আমার ভুল হয়ে গেছে আমাকে মাফ করে দিন । এভাবে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা পাওয়াই যায়, কিন্ত এভাবে ক্ষমা চাওয়া কি এতো সহজ?। এটাই হচ্ছে সত্যিকারের ক্ষমা চাওয়া। কারো মনে আঘাত দিয়ে কথা বলার পরে বুঝলেন কাজটি আপনার অন্যায় হয়েছে। এক্ষেত্রে যদি আপনি উত্তম উপায়ে ক্ষমা চাইতে পারেন তাহলে এক্ষেত্রে আপনাকে অহঙ্কারমুক্ত বলা যেতে পারে।

এটা সত্য যে, দৈনন্দিন জীবনে আমাদের অনেকের সঙ্গে চলতে হয়। কেউ বন্ধু হয়, কেউ শত্রæ হয়। তবুও আমাদের চলতে হয়। এটিই পৃথিবীর নিয়ম। কিন্তু এই চলার মধ্যে আমরা অনেকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফেলি, নিজের অজান্তেই। হয়তো পরে সেটি বুঝি যে, সেটি ভুল ছিলো। তখন হয়তো আর ক্ষমা চাওয়ার মুখ থাকে না বা ইগোর কারণে চাইতেও ইচ্ছা হয় না। মনে করি যে, যে দুঃখ পেয়েছে সে অনেকদিন পর সময় অতিক্রম হলে ভুলেই যাবে বা ভুলেই গেছে। আসলে তা নয়; যে আঘাত পায়, সে কিন্তু অনেকদিন মনে রাখে। অথবা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার মনে জেগে উঠে। আর জেগে উঠা কষ্টগুলো জমতে থাকায় আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। এই যে মানুষের রোষানলে পড়ে থাকাটা জীবনের কোনো এক সময় আমাদের খারাপ সময়ের দিকে নিয়ে যায়। হয়তো এভাবেই একটি সুন্দর সম্পর্ক ভেঙে যায়। সে জন্যে ‘কোনো একসময় আমি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও’- এভাবেই দোষ স্বীকার করে বলুন। সরাসরিভাবে বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা পাওয়া যায়। সত্যিই, এভাবেই আমরা ঈশ^রের বিরুদ্ধেও পাপ করি। তখন আমাদের উচিত ঈশ^রের কাছেও ক্ষমা চাওয়া। ১ম যোহন ১ অধ্যায় ৯ পদে রয়েছে, ‘যদি আমরা আপন আপন পাপ স্বীকার করি, তিনি বিশ^স্ত ও ধার্মিক, সুতরাং আমাদের পাপ সকল মোচন করিবেন, এবং আমাদিগকে সমস্ত অধার্মিকতা হইতে শুচি করিবেন।’ আর এ ধরনের ক্ষমা চাওয়া হলো যদি আমরা ঈশ^রের বিরুদ্ধে পাপ করি তখন আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। তেমনিভাবে মানুষকে দুঃখ দিয়েও আমরা ঈশ^র থেকে বিচ্ছিন্ন হই। তখনও আমাদের দুঃখ দেয়া মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত; তাহলে ঈশ^রও আমাদের ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দেবেন। যদি আমরা কারো সাথে খারাপ আচরণ করি, তাহলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে মন থেকে অনুতপ্ত, সেটি কথায় তাকে বুঝিয়ে দেয়া উচিত। তখন কথা বলতে হবে বিনয়ী সুরে ও নরম ভাষায়। আপনার বিনয়ের সম্পূর্ণটুকু উপস্থাপন করতে হবে। কিন্তু আমরা সে রকমটি করি না-এ ভালো অভ্যাসের গুণটি আমাদের নাই। ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হলো-আর কখনও এমন হবে না-এভাবে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নতুন হিসেবে প্রস্তুত করা। ঈশ^রকে যেভাবে আমরা প্রার্থনায় বলি যে, আমি আর পাপ করবো না, তেমনি কাউকে আমরা দুঃখ দিলে আর এমন খারাপ ব্যবহার হবে না-এভাবে তাকে জানিয়ে দেয়া উচিত। সত্যিই কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হয় না। এই কথাটি যদি মানেন, তাহলে অবশ্যই তার কাছে আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আর তা না হলে বরং আপনি নিজেই কষ্ট পাবেন। দরকার কী কাউকে কষ্ট দিয়ে নিজে কষ্ট পাওয়া। সুতরাং অন্যায়ের পর দেরি না করে ক্ষমা চাওয়াটা মানুষের ভালো মানুষের পরিচয়। ঈশ^রের কাছে পরিশুদ্ধ জীবন পেতে ক্ষমা চাওয়ার বিকল্প নেই। দৈনন্দিন জীবনে আমরা দিয়াবলের কুমন্ত্রণায় অনেক পাপ করি। চলার পথে বুঝে না বুঝে, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনেক জঘন্যতম অপরাধও করে থাকি। তাই জঘন্যতম কোনো কারণে অপরাধ সংঘটিত হয়ে গেলে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে ঈশ^রের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা দরকার। বাইবেলের বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেছেন। অন্যায় বা অপরাধের পর ক্ষমা প্রার্থনা না করা মারাত্মক ভুল বা অন্যায়। এর জন্যে আমাদের জীবনে দুঃখ নেমে আসতে পারে। কারণ, অন্যায় বা অপরাধী ব্যক্তি নিজেও জানে না সে কখন মৃত্যুবরণ করবে। আবার এ পাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করার সুযোগ আসবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং যখনই কোনো অপরাধ সংঘটিত হবে তখনই দেরি না করে ক্ষমা প্রার্থনা করা দরকার। প্রতিটি মানুষের উচিত একটা অন্যায় করে দিয়াবলকে খুশি করার পর সদাপ্রভুর কাছে ক্ষমা না চেয়ে দ্বিতীয় আরেকটি অন্যায় করে দিয়াবলকে শতগুণ খুশি করা উচিত নয়।

বাইবেলের গীতসংহিতায় দায়ূদকে আমরা দেখি তার অন্যায়ের জন্যে বা পাপের জন্যে তিনি বার বার অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি ঈশ^রের অধিক নৈকট্যের ফলে অধিক ভালোবাসায় এভাবে বিশেষ ক্ষমাপ্রার্থী হতেন। ১ম যোহন ১ অধ্যায় ৯ পদে রয়েছে, ‘যদি আমরা আপন আপন পাপ স্বীকার করি, তিনি বিশ^স্ত ও ধার্মিক, সুতরাং আমাদের পাপ সকল মোচন করিবেন, এবং আমাদিগকে সমস্ত অধার্মিকতা হইতে শুচি করিবেন।’

প্রেরিত ৩:৩৮ পদে বলা হয়েছে, ‘এইজন্য আমার ভাইয়েরা, আপনাদের জানা দরকার যে, যীশুর মধ্য দিয়েই আপনাদের কাছে পাপের ক্ষমা পাবার বিষয়ে প্রচার করা হচ্ছে।’ সুতরাং আমাদের পাপের জন্যে তার কাছে আমরা ক্ষমা চাইতে পারি। আমাদের ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কেননা আমাদের ক্ষমার দরকার আছে। কেননা ‘ক্ষমা’ মানে পরিস্কার করে মুছে ফেলা, ছেড়ে দেয়া। আমরা যখন কারও কাছে অন্যায় করি, তখন তার কাছে ক্ষমা চাই যেন আমাদের পুরানো সম্পর্ক ফিরে পেতে পারি। ক্ষমা পেতে চাইলে একজনকে অবশ্যই ক্ষমা পাবার উপযুক্ত হতে হবে। ক্ষমা চাওয়া হচ্ছে ভালোবাসা, দয়া ও অনুগ্রহের কাজ। ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হচ্ছে এমন এক সিদ্ধান্ত যে আপনি যার ক্ষতি করেছেন তার ক্ষতি পুষিয়ে দিবেন ও তাকে ভালোবাসবেন, তার আর ক্ষতি করবেন না।

পবিত্র বাইবেল আমাদের বলেছে যে, আমাদের সকলেরই ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়া দরকার। আমরা সকলেই পাপ করেছি। উপদেশক ৭:২০ পদে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ‘পৃথিবীতে এমন কোন সৎ লোক নেই যে সব সময় ভালো কাজ করে, কখনও পাপ করে না।” ১ যোহন ১:৮ পদে বলা হয়েছে, “যদি আমরা বলি আমাদের মধ্যে পাপ নেই তবে আমরা নিজেদের ফাঁকি দিই। তাতে এটাই বোঝা যায় যে, আমাদের অন্তরে ঈশ্বরের সত্য নেই।” সমস্ত পাপই হচ্ছে চুড়ান্তভাবে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা (গীতসংহিতা ৫১:৪ পদ। এই কারণেই ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমা লাভ করা আমাদের জন্য একান্তই দরকার। আমাদের পাপ যদি ক্ষমা না হয়, তাহলে আমরা আমাদের পাপের ফল হিসাবে অনন্তকাল ধরে শাস্তি ভোগ করব (মথি ২৫:৪৬; যোহন ৩:৩৬ পদ)।

যে কোনো দোষের জন্যে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। অন্যায় করলে অবশ্যই ক্ষমা চাওয়া উচিত। কেউ যদি মনে করেন, ক্ষমা চাওয়া মানেই হলো অন্যের কাছে ছোট হয়ে যাওয়া; আসলে এটা সঠিক নয়। ক্ষমা চাওয়া হলো, নিজেকে সঠিক মানুষ ও আদর্শ মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা। আবার কেউ কেউ আছেন, ক্ষমা চাইতে লজ্জাবোধ করেন; অবশ্য ক্ষমা না চাওয়াই হলো অমানবিক ও লজ্জার বিষয়। ক্ষমা চাওয়ার মানে হলো, মানুষের মাঝে নিজেকে মূল্যবান হিসেবে উপস্থপন করা।

ক্ষমা চাইতে হবে আন্তরিকভাবে। অন্তর থেকে ক্ষমা না চাইলে নিজের প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ সৃষ্টি হবে না। যদি এমন হয় যে, দায়সারাভাবে যদি ক্ষমা চাওয়া হয়, তাহলে ভুক্তভোগী মানুষটির কাছে রোষানলে পরার সম্ভাবনা শতভাগ। ক্ষমা না চাইলে, আপনার ঔদ্ধত্য প্রকাশ পাবে। কাউকে দুঃখ দিয়ে কোনো এক সময় যদি অনুশোচনা জেগে না উঠে তাহলে তার মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ আছে বলে মনে হয় না। সত্যিই এটা খুবই দুঃখজনক ও নির্মমতার পরিচয়। কারো সাথে অন্যায় হয়ে থাকলে এজন্যে কী কী ক্ষতি হয়েছে বা তার কতটা কষ্ট হয়েছে সেটাও ভাবা দরকার। পূর্ণ সহমর্মিতা নিয়ে সততার সাথে ক্ষমা চাওয়া উচিত ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। অবশ্যই যার কাছে ক্ষমা চাওয়া হয় তার স্বার্থে ক্ষমা চাওয়া উচতি; মোটেও নিজের স্বার্থে নয়। যাকে কষ্ট দিলেন, তার মানসিক অবস্থার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া উচিত।

বাইবেল বলে, শুধুমাত্র মৃত্যুই হচ্ছে আমাদের পাপের উপযুক্ত শাস্তি। রোমীয় ৬:২৩ পদের প্রথম অংশ ঘোষণা দিয়েছে, ‘পাপ যে বেতন দেয় তা’ মৃত্যু …’, আর আমাদের পাপের জন্যই আমরা অনন্ত শাস্তি পাবার যোগ্য হয়েছি। কিন্তু ঈশ্বর, তাঁর নিখুঁত পরিকল্পনা মতোই যীশুখ্রীষ্ট মানুষ হলেন (যোহন ১:১ ও ১৪ পদ)। যীশু ক্রুশে মৃত্যুবরণ করলেন, আমাদের পাওনা শাস্তি মৃত্যুকে তিনিই গ্রহণ করলেন। ২ করিন্থীয় ৫:২১ পদ আমাদের শিক্ষা দেয়, “যীশু খ্রীষ্টের মধ্যে কোনো পাপ ছিলো না; কিন্তু ঈশ্বর আমাদের পাপ তাঁর উপর তুলে দিয়ে তাঁকেই পাপের জায়গায় দাঁড় করালেন, যেন খ্রীষ্টের সঙ্গে যুক্ত থাকবার দরুন ঈশ্বরের পবিত্রতা আমাদের পবিত্রতা হয়।’

কিন্তু আমরা মানুষ এতো নিশ্চয়তা জানার পরেও নিজের ভাইয়ের সাথে দিনের পর দিন অন্যায় করে চলেছি। আমাদের অন্যায় কাজের জন্যে বিনয়ী হতে পারি না বলে ক্ষমা চাইতে পারি না। অহঙ্কার আমাদের চেপে ধরে, আর আমরা নিজেকে বিবেকবর্জিত হিসেবে অন্য মানুষের মনের মাঝে স্থান দিই। ক্ষমা চাইতে আমরা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করি। যদি তাই হল তাহলে আমরা মন থেকে চাইতে পারি না।

বাইবেল আমাদের পাপ ক্ষমা ও স্বীকারোক্তি সম্পর্কে অনেক কিছু বলে। পাপের পরিণতি সম্পর্কে আমরা শিখি এবং অন্যদের যে ক্ষতি আমরা করি তা আমাদের জানতে হবে; কেনই বা ক্ষমা চাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যীশু ক্রুশে মৃত্যুবরণ করলেন, আমাদের পাওনা শাস্তি তিনিই গ্রহণ করলেন! ঈশ্বর হিসাবে যীশুর মৃত্যুবরণ সমস্ত পৃথিবীর জন্যে পাপের ক্ষমা পাবার উপায় হল। ১ যোহন ২:২ পদ ঘোষণা করেছে, ‘আমাদের পাপ দূর করবার জন্যে খ্রীষ্ট তাঁর জীবন উৎসর্গ করে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করেছেন। কেবল আমাদের পাপ নয়, কিন্তু সমস্ত মানুষের পাপ দূর করার জন্যে তিনি তা’ করেছেন।’ যীশু মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠেছেন, পাপ ও মৃত্যুকে পরাজিত করে তাঁর বিজয় ঘোষণা করেছেন (১ করিন্থীয় ১৫:১-২৮ পদ)। যীশু খ্রীষ্টের মৃত্যু ও পুনরুত্থানের জন্যে ঈশ্বরের গৌরব করি এবং রোমীয় ৬:২৩ পদের দ্বিতীয় অংশটি সত্য বলে দেখতে পাই, ‘কিন্তু ঈশ্বর যা’ দান করেন তা’ আমাদের খ্রীষ্ট যীশুর মধ্য দিয়ে অনন্ত জীবন।’

বাইবেলে আমরা দেখি, যোনা ঈশ্বরকে অমান্য করেছিলেন এবং এই অন্যায়ের জন্যে ক্ষমা চাইলেন। নিজের পাপের জন্যে তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন, যে পাপ তার অজানা ছিলো। আবার যোষেফের ভাইয়েরা ক্ষমা চেয়েছেন দাসত্বের মধ্যে যোষেফকে বিক্রি করে অন্যায় কাজের জন্যে। আমাদের অন্যায় কাজের জন্যে আমরা যদি ক্ষমা না চাই, তাহলে ঈশ^রের কাছে ক্ষমা চাইলেও আমরা ক্ষমা পাই না। যাকোব ৬: ১৬ পদে রয়েছে, ‘অতএব, তোমরা একজন অন্যজনের কাছে আপন আপন পাপ স্বীকার কর, ও একজন অন্যজনের নিমিত্ত প্রার্থনা কর, যেন সুস্থ হইতে পারে। ধার্মিকের বিনতি কার্যসাধনে মহাশক্তিযুক্ত।’ সুতরাং এ অংশের অর্থ হলো, আমাদের অন্যায় কাজের জন্যে নত হওয়া ও স্বীকার করে প্রার্থনা করা উচিত। এতে প্রত্যেকেই সুস্থ থাকতে পারবে। কেননা একজন ধার্মিক ব্যক্তির আন্তরিক প্রার্থনায় মহা ক্ষমতা আছে এবং বিস্ময়কর ফলাফল পাওয়া যায়।

আপনি কি আপনার পাপের ক্ষমা পেতে চান? আপনার মধ্যে কি পাপবোধের বিরক্তিকর অনুভূতি রয়েছে, যা থেকে আপনি বের আসতে পারেন না? আপনি আপনার পাপের ক্ষমা লাভ করতে পারেন, যদি আপনি যীশু খ্রীষ্টকে আপনার উদ্ধারকর্তা বলে বিশ্বাস করেন। ইফিষীয় ১:৭ পদ বলেছে, ‘ঈশ্বরের অশেষ দয়া অনুসারে খ্রীষ্টের সংগে যুক্ত হয়ে তাঁর রক্তের দ্বারা আমরা মুক্ত হয়েছি, অর্থাৎ পাপের ক্ষমা পেয়েছি।’ যীশু আমাদের পক্ষে সব ঋণ পরিশোধ করেছেন, যেন আমরা ক্ষমা পাই। আপনাকে শুধুমাত্র যীশুর মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে যে, যীশু আপনার পাপের ক্ষমা দিতেই মৃত্যুকে বরণ করেছেন- তিনি আপনাকে ক্ষমা করবেন! যোহন ৩:১৬-১৭ পদে রয়েছে, ‘ঈশ্বর মানুষকে এত ভালোবাসলেন যে, তাঁর একমাত্র পুত্রকে তিনি দান করলেন, যেন যে কেউ সেই পুত্রের উপরে বিশ্বাস করে সে বিনষ্ট না হয় কিন্তু অনন্ত জীবন পায়।’

ঈশ^রের বিরুদ্ধে আমরা যেন পাপ করেছি, তার জন্যে আমাদের শাস্তি পাওনা রয়েছে। কিন্তু যীশুখ্রীষ্ট আমাদের পাওনা শাস্তি নিজেই নিয়েছেন যেন তাঁকে বিশ্বাস করে আমরা ক্ষমা পেতে পারি।
তবে আমরা আমাদের পাপের জন্যে, প্রতিদিনের অন্যায়ের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী। কেননা ক্ষমাপ্রার্থী আমাদের পাপ স্বীকার করার একটি উপায়। যেহেতু আমরা পাপ করেছি; তাই আমরা আমাদের পাপের জন্য ক্ষমা খুঁজছি।

পবিত্র বাইবেলের মথি ৫ অধ্যায় ২৩ ও ২৪ পদে রয়েছে, ‘অতএব, তুমি যখন যজ্ঞবেদির নিকটে আপন নৈবেদ্য উৎসর্গ করিতেছ, তখন সেই স্থানে যদি মনে পড়ে যে, তোমার বিরুদ্ধে তোমার ভ্রাতার কোন কথা আছে, তবে সেই স্থানে বেদির সম্মুখে তোমার নৈবেদ্য রাখ, আর চলিয়া যাও, ্রথমে তোমার ভ্রাতার সহিত সম্মিলিত হও, পরে আসিয়া তোমার নৈবেদ্য উৎসর্গ করিও।’-যারা অন্যায় করে, যারা মানুষকে দুঃখ দেয়, যারা মানুষের ক্ষতি করে তাদের জন্যে এই অংশটুকু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ, নির্মম প্রকৃতির মানুষ কখনো মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতে চায় না। এ কারণে তাদের জীবনেও দুঃখ কষ্ট নেমে আসে খুব শীঘ্রই। আর তাদের জন্যে ২৫ পদে কঠিন ও সতর্কীকরণ কথাটি রয়েছে যে, ‘তুমি যখন বিপক্ষের সঙ্গে পথে থাক, তখন তাহার সহিত শীঘ্রই মিলন করিও, পাছে বিপক্ষ তোমাকে বিচারকর্তার হস্তে সমর্পণ করে, ও বিচারকর্তা তোমাকে রক্ষীর হস্তে সমর্পণ করে, আর তুমি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হও।’ অর্থাৎ কারো জীবনে ক্ষতি করে থাকলে তার সাথে দ্রæত ক্ষমা চেয়ে সমাধানে আসা উচিত ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করা উচিত। অন্যথায় আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি দীর্ঘদিন আঘাত পাওয়ার দরুণ আপনাকে মনে রাখবে এবং তার মনে যে বিষবৃক্ষ জন্ম নিয়েছে সেই হেতু একদিন ঠিকই আপনাকে চরম পরিণতিতে আসতে হবে।

এমন অনেকে আছে, মা-বাবা জীবিত অবস্থায় তাদের সঙ্গে অনেক সময় ভালো ব্যবহার করে না। তাদের মনে বিভিন্নভাবে কষ্ট দিয়েছে, মা বাবার অবাধ্য হয়েছে, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। মৃত্যুর আগে তাদের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া হয়নি ও তাদেরকে সঠিকভাবে প্রতিপালন করা হয়নি। আর মৃত্যুর পর এখন খুবই অনুতপ্ত হচ্ছে এবং মনের দিক থেকে শান্তি পাচ্ছে না। এজন্যে সব সময় একটা অপরাধবোধ কাজ করে। কেনো? কারণ, ক্ষমা চাওয়ার শিক্ষা ছিলো না বা সে রকম মানসিকতা তৈরি হয়নি।

নৈতিক শিক্ষা আমাদের বলে যে, নিজের অন্যায় স্বীকার করা দুর্বলতা নয়; বরং মনুষ্যত্বের বড় গুণ! কেউ ভুল করলে তা স্বীকার করে নেয়ার মধ্যে দুর্বলতা নাই। আবার অনেকেই খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে মনে করেন ভুল করেছি তাতে কি; বরং স্বীকার করলে দুর্বলতাই প্রকাশ করা হলো। সত্যিকারে ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া হলো সদ্গুণ। অন্তর থেকে ক্ষমা প্রার্থনা হলো দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সম্পর্ক বজায় রাখার জন্যে খুব প্রয়োজনীয়। কেননা কেউ আপনার ব্যবহারে বা কর্মে আহত হলে তাঁদের চিহ্নিত করা এবং তাঁদের আঘাতে সমব্যথি হওয়া। যত দ্রæত আমরা বলতে পারি, নিঃশর্তভাবে ‘আমি সত্যি দুঃখিত’-ততই ভালো ও মঙ্গল। আন্তরিকভাবে ভুল স্বীকার করা সরল শক্তিমানকেই সাজে। ‘আমি দুঃখিত’ এমন বলে পাশ কাটানো ঠিকই। সত্যিকারে তাদের মধ্যে ক্ষমা চাওয়ার মানসিকতা ও নিজেকে সংশোধন করার ইচ্ছে নেই। একটা অহঙ্কারে ডুবে গিয়ে সেখান থেকে বের হতে পারে না।

অনেক সময় সভা-সমিতি-আলোচনায় একজনের ভুল বের করাও অনেকের আনন্দ দেয়। তাই ক্ষমা চেয়ে দুর্বলতা প্রকাশে অনেকে রাজি হন না। তবে একটি কথা ঠিক, আমরা যাকে বা যাদের নেতা মানি, তাঁরা যদি নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত না হন, অন্তত ক্ষমাপ্রার্থনা না করেন, তাহলে সেই নেতার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। সেই ব্যক্তির প্রতি সকলের মনে মনেই ঘৃণা জন্ম নেয়। সত্যিই জীবনে সুখী হতে হলে বা নিরাপদে থাকতে হলে ক্ষমা চাওয়ার মতো মহান হৃদয়ের অধিকারীও হতে হয়। আমাদের দাম্পত্য জীবনে এটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। জীবনসঙ্গী যদি ভুল করে আর সে জন্যে হয় অনুতপ্ত, ক্ষমা চায়, দুঃখিত বলে; তখন মনের কালো মেঘ উড়ে যায়, আর জীবনে ফিরে আসে শান্তি ও আনন্দ। অন্যদিকে ক্ষমা চাওয়ার ফলে আমাদের সামাজিক সম্পর্কের মান উন্নত করে এবং তৃতীয় পক্ষকেও উপকৃত করে; এটি এমন একটি ক্রিয়া যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সবাই জয়ী হয়। নিজে ভুল করলে বা ভুল সিদ্ধান্ত নিলে, ভুল স্বীকার করাকে দুর্বলতার প্রকাশ মনে হতে পারে। অথচ ব্যাপারটি উল্টো। ভুল, অন্তর দিয়ে স্বীকার করা, মহত্তে¡র প্রকাশ, একটি সদ্গুণ, নিজের ভেতরের সংহতি ও শক্তির প্রকাশ। বিপদে, বিপর্যয়ে, দুঃসময়ে নিজের গুণের প্রকাশ ঘটানো বরং মহৎ গুণ। একজন নেতার মধ্যে নিজের ভুল স্বীকার করার মতো শক্তি, বিশ্বাস ও সচেতনতা থাকা মহত্তে¡র লক্ষণ। ক’জনেরই বা তা থাকে?

আমরা প্রভুর প্রার্থনায় বলে থাকি যে, ‘– যারা আমাদের উপর অন্যায় করে, আমরা যেমন তাদের ক্ষমা করেছি তেমনি তুমিও আমাদের সমস্ত অন্যায় ক্ষমা কর ঃ এতে বলা হয়েছে আমরা যেন ঈশ্বরের কাছে আমাদের পাপ স্বীকার করি এবং পাপ থেকে দূরে থাকি; এছাড়াও ঈশ্বর যেমন আমাদের ক্ষমা করেন তেমনি আমরাও অন্যদের ক্ষমা করি।

বাইবেলে আমরা ক্ষমা চাওয়ার অনেক উদাহরণ জানতে পারি। যেমন-যোনা ঈশ^রের অবাধ্য হয়ে পালাতে গিয়েছিলো। অবশেষে সে ঈশ^রের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো তার পাপের জন্যে। তাছাড়া যোষেফের ভাইয়েরা তাকে দাসত্বের মধ্যে বিক্রি করার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল। ক্ষমা চাওয়ার একটি উপায় হলো, আমাদের পাপ স্বীকার করা, যা’ আমাদের দৈনিক খ্রীষ্টান হিসেবে উচিত ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সত্যি, আমরা যখন ক্ষমা প্রার্থনা করি, তখন আমরা আমাদের পাপের ক্ষমা লাভ করি। কখনও কখনও আমরা তাঁর প্রতি অবিচার করেছি।
এটা সত্যি যে, কেউ কেউ নিজের মনের মধ্যে থাকা অহংকারবোধের কারণে ‘আমি দুঃখিত’ কথাটাও বলা তাদের কঠিন হয়ে পড়ে। ক্ষমা চাওয়াটা তাদের জন্যে মোটেও সহজ নয়। বরং তারা উল্টো নিজের মনে মনে খোঁড়া যুক্তিকে চেপে বসে থাকতে চান। তবে যখন মনে হয় যে, আমার অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং এর জন্যে আপনি নিজে এই সমস্যার জন্য দায়ী তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষমা চাওয়া উচিত। অনেক সময় এমন হয় যে, ‘আমি কেন তার কাছে ক্ষমা চাইব? সে আমার কী করতে পারবে?’

কারো কারো জীবনে এটা হয় যে, হয়তো এমন একটা পরিবারে বড়ো হয়ে উঠেছেন, যেখানে ক্ষমা চাওয়া ততটা প্রচলিত ছিলো না। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তা হলে বলবো আপনি হয়তো নিজের দোষ স্বীকার করতে শেখেননি। ছোটোবেলায় ঠিকমতো এই অভ্যাস গড়ে না তোলায়, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও আপনার মধ্যে তা’ গড়ে ওঠেনি। ক্ষমা চাওয়া হলো, আগুনের উপর বালতি দিয়ে জল ঢালা। ক্ষমা চাওয়া মতবিরোধের বিধ্বংসী অগ্নিশিখাকে নিভিয়ে দিতে পারে। আমাদের এটা চিন্তা করা উচিত যে, যখন কেউ আপনার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল, তখন আপনার কতটা ভালো লেগেছিল। সেভাবে আমরাও কেনো এমনটা করতে পারি না? ক্ষমা না চাইলে মনে করবেন না যে, সময়ের সাথে সাথে একসময় সব ঢেকে যাবে। আপনার আচরণের ফলে সৃষ্ট অনাকাক্সিক্ষত পরিণতির জন্যে আপনি ক্ষমা চাইতে পারেন। ক্ষমা চাওয়ার ফলে আপনি যাকে দুঃখ দিয়েছেন, তার দুঃখ ভুলে যেতে সাহায্য করবে। অন্যথায়, তার মনে যে বীজ রোপন করলেন সেজন্যে কোনো একদিন আপনাকে প্রতি দিতেও হতে পারে। মনে রাখবেন, কাউকে দুঃখ দিলে সে জন্যে তার মনে যে ক্রোধের সৃষ্টি হবে সেই ক্রোধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর ক্ষমা চাওয়াকে হার হিসেবে নয় বরং আপনার জীবনে জিত হিসেবে দেখা উচিত। হিতোপদেশ ১৮ অধ্যায় ১৯ পদ আমাদের কঠিন একটি কথা বলে, একজন ব্যক্তি যিনি রেগে থাকেন, তার মন জয় করা ‘দুর্ভেদ্য প্রাচীর ঘেরা শহর জয় করার থেকেও কঠিন।’ সুতরাং পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ার আগেই শাস্তি স্থাপন করা উচিত। বাইবেলের মথি ৫ অধ্যায় ২৫ পদে কঠিন কথা রয়েছে, ‘তুমি যখন বিপক্ষের সঙ্গে পথে থাক, তখন তাহার সহিত শীঘ্র মিলন করিও, পাছে বিপক্ষ তোমাকে বিচারকর্তার হস্তে সমর্পণ করে, ও বিচারকর্তা তোমাকে রক্ষীর হস্তে সমর্পণ করে, আর তুমি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হও।’ সুতরাং মন থেকেই ক্ষমা চাওয়া উচিত। অনেক সময় আমরা নিজেকে নির্দোষ করার জন্যে যুক্তি দেখাই। নিজের আচরণের স্বপক্ষে যুক্তি দেখানো এবং ক্ষমা চাওয়া এক বিষয় নয়। হিতোপদেশ ১৮ অধ্যায় ১৭ পদে যে বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে, তাতে মনে হতেই পারে যে, সমর্থনকারী ধার্মিক বলে বোধ হতে পারে, অথবা কারো কারো কাছে সত্যিই ভালো মানুষ হতে পারে, কিন্তু যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা দুঃখ পেয়েছে সেই জানে তার বিষয়ে। এটা হলো আসল সত্য! আর এতে করে তার মনে একটা স্থায়ী দাগ কেটে গেলো। রোমীয় ৪ অধ্যায় ৭ পদ আমাদের সবার জন্যে!

ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হলো, নিজেকে মুক্ত করা, নিজেকে সংশোধন করা, শান্তি ও সুখ ফিরিয়ে আনা। ক্ষমা চাওয়া সুন্দর অভ্যাসগুলোর মধ্যে একটি। কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার পর তার সঙ্গে ক্ষমা চাওয়ার অভ্যাস থাকা জরুরি। জীবনে চলার পথে ভুলভ্রান্তি হতেই পারে, বিচলিত না হয়ে নির্দ্বিধায় ভুল স্বীকার করে বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নেয়া উচিত। এতে কেউ ছোট হয় না, বরং সততার পরিচয় ফুটে উঠে।
জীবনে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল ভুল স্বীকার করার অভ্যাস গড়ে তোলা। আমরা যাদের সাথে বাস করি এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা কোনোদিনই ভুল স্বীকার করবে না। ভুল স্বীকার করে জয়ী হওয়া বিবেকের প্রতি তাড়না সৃষ্টি করা। মানবিক দিক দিয়ে হেরে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। আর তারা জীবনে বহুবার এভাবে হেরে যেতে প্রস্তুত; কিন্তু তবুও ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত নয়। নিজের অন্যায়ের ক্ষমা চাওয়ার অভ্যাস তাদের মধ্যে গড়ে উঠে না। সম্পর্ক মজবুত রাখতে হলে একে-অপরের কথা বুঝতে হয়। জীবনে অনেক কিছু মানিয়েও নিতে হয়। অতএব, নত হওয়াতে কোনো অমর্যাদা হতে পারে না। নত হয়ে ক্ষমা চাওয়া একজন মানুষের চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণগুলোর অন্যতম। জীবনের কোনো এক সময় হয়তো নিজের ভুল যে বুঝতে পারলে দ্রæত ক্ষমা চেয়ে নেয়া উচিত। অন্যথায় সুযোগ হারাতে হতে পারে। আর ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হলো, একই পরিস্থিতি আর তৈরি হবে না, এক ভুল বারবার করেন না।
করোনা মহামারী এখন আর দূরের খবর নয়। প্রতিদিন নিজেদের কাছের মানুষ, পরিচিত লোক ও আপনজন আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। মারা যাচ্ছে আত্মীয়স্বজন ও সাথী বন্ধুবান্ধব। সারা দেশে প্রতিদিন প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাস ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে।
আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পুনরায় দেখা হবে, আনন্দ পরিস্থিতি আবার ফিরে পাব সে আশা একবারেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। করোনাভাইরাস মহামারীতে পৃথিবীর অনেক মানুষ মারা যাবে এটাই বাস্তব। এ অবস্থায় বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীদের কথা খুবই স্মরণ হয়। আপন কেউ ফোন করলে হাতের শান্তভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলি। জানি না কোন দিন এ কথাই শেষ কথায় পরিণত হবে। খবরে আসবে তিনি আর নেই। তখন ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ থাকবে না। জীবনে চলাফেরার ফাঁকে বহুজনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। বন্ধুবান্ধব এবং সঙ্গীদের সঙ্গে চলাফেরা, রকমারি আচার-আচরণ, লেনদেন বহু কিছু হয়েছে। অনেকের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সৎ পরামর্শ পেয়েছি, শিক্ষা গ্রহণ করেছি তাদের কাছে আমরা ঋণী। সবার কাছে এ মুহুর্তে ক্ষমা চাই। অন্যের মন থেকে প্রতিশোধের মনমানসিকতা পরিহার করি করতে ক্ষমা চাওয়ার বিকল্প হতে পারে না। সামান্য দুনিয়ায় প্রতিশোধের মনমানসিকতার জন্ম দিয়ে কোনো লাভ নেই। চলার পথে, কাজের ফাঁকে, কত কত মানুষের সঙ্গে কী কী আচরণ হয়ে যায়? আমরা কখনো বাসে, রেলে বা বিমানে ভ্রমণ করি। জনসমাগমে অংশ নিই। একসঙ্গে বাস করি। কোথাও একত্রে জব করি। তখনই আমরা কত মানুষকে কষ্ট দিই। বিরক্ত করি। সিগারেটের ধোঁয়ায় যে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, ঘামের গন্ধে পাশের লোক বসতে পারছে না, মুখের গন্ধে কেউ কথা বলতে চায় না। এভাবে আরও কতজনকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দিয়েছি তাদের পরিচয় আমাদের জানা নেই। দুঃখি ও ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে অনেকটা পার্থক্য আমরা উপলব্ধি করতে পারি। দুঃখিত খুব সহজেই বলে দেযা যায়, কিন্তু ক্ষমা চাওয়াটা অতেটা সহজ নয়। দুঃখিত এবং ক্ষমা প্রার্থনা দুটো শব্দ যা অনুশোচনা প্রকাশ করে। আমরা প্রায়ই এই শব্দগুলির একটি ব্যবহার করি যখন আমরা কোনও ভুল বা ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি। যদিও অনেকে ধরে নিয়েছে যে “আমি দুঃখিত” এবং “আমি ক্ষমা চাইছি” বলার অর্থ একই, তবে উভয়ের মধ্যে একটি সূ² পার্থক্য রয়েছে। দুঃখিত বললে কিছু সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি কেবল প্রকাশ করা হয় মাত্র। ক্ষমা চাওয়ার অর্থ বোঝা যাচ্ছে যে, আপনি দোষ বা ভুলের দায় স্বীকার করার পাশাপাশি এটি সম্পর্কে আপনার দুঃখ ও কষ্ট প্রকাশ করছেন। এটাই দুঃখিত এবং ক্ষমা প্রার্থনার মধ্যে প্রধান পার্থক্য। সত্যিই, যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে ক্ষমা চায় না সে সাধারণত অনুশোচনা প্রকাশ করে না; শুধুমাত্র স্বার্থ উদ্ধারের জন্যেই ক্ষমা চায়। ভুল স্বীকার করাকে কখনো নিরুৎসাহিত করা উচিত নয়। কেননা, ভুল স্বীকার করা একটি ইতিবাচক মানবিক ধর্ম। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মেই এই ক্ষমা প্রার্থনার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আসলে ভুল স্বীকার করতেই হবে। ভুল থেকেই ‘ঠিক’-এ যেতে হয়। যেমন অন্ধকার থেকে আমরা আলোর পথযাত্রী। ঠিক সেভাবেই অসত্য থেকে সত্যের পথে যাত্রা।
সত্যিই, আমাদের প্রত্যেকেরই ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে মনপরিবর্তন ও পাপ মোচন (প্রেরিত ৫ঃ৩১) হওয়া উচিত। তাহলে আমরা পরিশুদ্ধ হতে পারবো। সেই সাথে আমাদের প্রতিজ্ঞা করা উচিত, যেন আমরা পুনরায় পাপের পথে ফিরে না যাই। ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে দুষ্টতা থেকে আমরা ফিরতে পারি। নিজেকে পরিবর্তন করতে পারি। তখন আমাদের হৃদয়ের খারাপ কল্পনা থেকে আমরা মুক্ত হতে (প্রেরিত ৮ঃ২২) পারি ও ক্ষমা নিশ্চিত পেতে পারি। অথচ অনেক সময় আমরা ঈশ^রের কাছেও ক্ষমা চাই না। কিন্তু ঈশ^রের কাছে আমাদের অন্যায়ের জন্যে বিশ^াস সহকারে ক্ষমা চাইলে (লূক ৫ঃ২০) তিনি ক্ষমা করেন। আর যারা ক্ষমা পায় তারা অনেক প্রশান্তিতে জীবনযাপন করে (লূক ৭ঃ ৪৭ থেকে ৪৯)। যারা ন¤্রতার সাথে ঈশ^রের কাছে ক্ষমা চায় ও মধ্য পথ হতে ফিরে আসে ঈশ^র তাদের ক্ষমা করেন (২ বংশাবলি ৭ঃ১৪; দানিয়েল ৯ঃ৯, ১৯ ও যিশাইয় ৩৩ঃ২৪; যিরমিয় ৩১:৩৪, ৩৬:৩)। আমরা যখন প্রার্থনা করি, তখন যেন মন থেকেই ঈশ^রের কাছে প্রার্থনা করি যে, ‘প্রভু আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আমি তোমার কাছে ক্ষমা পাবো; কারণ, আমিও ক্ষমা করেছি-আমেন’ মথি ৬ঃ১২।