আমরা চাই মাদকের রাজত্ব ধ্বংস হোক

সম্পাদকীয়
মাদকের রাজত্ব যখন বেড়ে যায় তখন মাদক গ্রহণকারী রাজাদের দিনগুলো সোনালী হয়ে উঠে। কিন্তু অতিরিক্ত বেড়ে গেলে ‘ঠেলার নাম বাবাজি’র মতো ‘ছেড়ে দে মা কাইন্দ বাঁচি’র মতো দৌড়ে পালাতে হয় সে কথা ভুলে যায়। সুশীল সমাজের এতো প্রচেষ্টা, আইনের এতো কড়াকড়ি থাকা সত্বেও মাদকের সাথে জড়িতদের কোনোভাবেই দমানো যাচ্ছে না। মাদকের এতো নেশা যে, সবকিছু উপেক্ষা করে হলেও আবারো ওরা জেগে উঠে কোনো না কোনোভাবে।

প্রিয় সময়ে প্রকাশিত ‘কুমিল্লায় ১৬ মাসে মাদক উদ্ধার প্রায় ৮৬ কোটি টাকার মাদক উদ্ধার’ শিরোনামে সংবাদটি আমাদের সকলকে হতবাক করেছে নিশ্চয়। আমরা এমনটা কোনোভাবেই উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে আশা করি না। আমরা জানি, বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে মাদক একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই মাদকের কারণেই বৃদ্ধি পেয়েছে অপরাধ প্রবণতা। তাছাড়া আমরা জানি যে, যেসব খাদ্য, পানীয় বা বস্তু সুস্থ মস্তিষ্কে বিকৃতি ঘটায়, জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ করে এবং নেশা সৃষ্টি করে সেগুলো মাদক দ্রব্যের অন্তর্ভূক্ত। মাদক মানুষের জ্ঞান ও চেতনাকে বিলুপ্ত করে দেয়। মাদক নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে বর্তমানেও কম হচ্ছে না। পত্র পত্রিকায় লেখালেখিও কম হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ফেন্সিডিল ক্রয়-বিক্রয় হয়।

মাদক গ্রহণের ফলে শারীরিক ক্ষতির শেষ নেই। মাদক দ্রব্য গ্রহণের ফলে, ফুসফুস ও মস্তকের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে থাকে। হৃদয় স্পন্দন ও নাড়ির গতি বৃদ্ধি পায়, চোখ রক্ত বর্ণ হয় এবং মুখ ও গলা শুকিয়ে আসে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। এতে হজম শক্তি বিনষ্ট হয়, খাদ্যস্পৃহা কমে যায় মানবদেহে ক্রমাগত অপুষ্টি বাসা বাধতে থাকে। স্থায়ী কফ, কাশি এবং য²ারোগের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় পঙ্গুত্বে পরিণত হয় এবং মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তাছাড়াও মাদকদ্রব্য ব্যবহারে মানুষের বিবেক বুদ্ধির ওপর দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিবেক বুদ্ধি লোপ পায়, হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সাধারণত দেখা যায় যে, মানুষ যতক্ষণ নেশাগ্রস্ত থাকে, ততক্ষণ তার বিবেক বুদ্ধি কোনো কাজই করতে পারে না। আরো রয়েছে, মাদকাসক্তি মারাত্মক অপব্যয়। একজন মাদকাসক্তের জন্য দৈনিক প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয়। মদ্যপানে প্রচুর ধন-সম্পদ অপব্যয় ও অপচয় হয়। মাদকের কারণে সামাজিক অবক্ষয়ের শেষ নেই। ব্যভিচার ও নরহত্যার অধিকাংশই বিষধর মাদকাসক্তির পরিণাম। ট্রাক, বাস, ট্যাক্সি ইত্যাদি যানবাহন সংঘর্ষ ও দুর্ঘটনা অনেক সময় মাদকাসক্ত চালকের কারণেই ঘটে থাকে। মাদকের জন্য শুরু করে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, গুম, অপহরণ, ধর্ষণসহ সব ধরনের অপরাধ ঘটে। এছাড়াও মাদকের ফলে পরিবেশ দূষিত, যৌনশক্তি লোপ, দুঃখ-দারিদ্র্য বৃদ্ধি এসব আমরা স্বচক্ষে দেখছি।

আমরা প্রকাশিত সংবাদে দেখেছি, হতবাক হওয়ার বিষয়। ‘কুমিল্লা জেলা জুড়ে ১৬ মাস অভিযান পরিচালনা করে ১০ টন গাঁজাসহ ২৬ কোটি ৮৫ লক্ষ ৫৩ হাজার ৯ শত টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরণের মাদক উদ্ধার করেছে জেলা পুলিশ। এ সময় মাদক পাচাঁর ও ব্যবসায় জড়িত ৪ হাজার ৩২৩ জনকে আটক করা হয়।

তবে আমরা মনে করি, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতিকে বিধ্বস্তকারী মরণব্যাধি ব্যাধি হচ্ছে মাদক। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জঘন্য পাপাচার। আর মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি চরম অপরাধ। তাই এহেন ঘৃণ্য দ্রব্যের ব্যবহার ও প্রসার রোধ করা দরকার। মনে রাখতে হবে মাদক নির্মূল কারো একার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রয়োজন সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। যারা মাদক দ্রব্য প্রস্তুত, এর প্রচলন ও সরবরাহ কাজে জড়িত তাদেরকে দেশ ও জাতির স্বার্থে এ ঘৃণ্য কাজ বর্জন করা উচিত। তারা সমাজকে সুন্দর সুশৃঙ্খল করার জন্য নিজেদের আর্থিক ফায়দা লুটার পরিবর্তে মদসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবে। সেই সাথে পরিবারগুলোর প্রধানদেরও দায়িত্ব পালন করা উচিত। পিতা-মাতা, অভিভাবকবৃন্দ যারা পরিবার প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন, তারা নিজেদের সন্তানদের মাদক দ্রব্যের ক্ষতি সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত করবেন এবং তাদের মধ্যে ও কু-অভ্যাস যেন কোন মতেই গড়ে উঠতে না পারে, সে ব্যাপারে সদা সর্তক থাকবেন। তারা যাতে অসৎ ও দুশ্চরিত্র বন্ধু বান্ধব ও সঙ্গী-সাথী যোগাড় না করতে পারে বা তাদের সাথে মিশতে না পারে, সে ব্যাপারে সুদৃষ্টি রাখবেন। সন্তানদের স্নেহ ও মায়া-মমতা দিয়ে সর্বদা কাছে রাখবেন এবং পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করবেন।

শিক্ষকগণ তাঁদের সুন্দর চরিত্র, আচার-আচরণ, আদেশ ও উপদেশের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে মাদক মুক্ত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। যদি শিক্ষকগণ ছাত্র-ছাত্রীদের এ মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও উপদেশ দিতে থাকেন, তাহলে ছাত্ররা এ কুপথে অগ্রসর হতে সাহস পাবে না। ফলে মাদক মুক্ত সমাজ গড়ে উঠবে। সেই সাথে দেশের মানুষ যে কোন সামাজিক সমস্যা সমাধানে মসজিদের খতিব, ঈমাম ও আলেমগণের সাহায্য-সহযোগিতা ও পরামর্শ কামনা করেন।

তাছাড়া সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীগণ যদি মাদক দ্রব্যের প্রসার রোধের দৃঢ়সংকল্প নিয়ে প্রচেষ্টা চালান তাহলে দেশকে মাদকমুক্ত রাখা সম্ভব হবে। সরকার মাদক দ্রব্যের বিরুদ্ধে যে আইন প্রণয়ন করেছে তার সঠিক প্রয়োগ থাকলে সমাজে মাদক দ্রব্য আর দেখা যাবে না কেউ ব্যবহার করবে না। আমরা চাই মাদকের রাজত্ব ধ্বংস হোক।