আমার সংবাদকর্মী জীবনের অন্যতম সাফল্যের দিন আজ

আশিক বিন রহিম  :

আজ আমার সংবাদকর্মী জীবনের অন্যতম সাফল্যের দিন। পেশাগত জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি আজ পেলাম।

গেলো দুই বছর আগে জেলার প্রত্যন্ত একটি চর এলাকায় ৩য় শ্রেণী পড়ুয়া এক মাদ্রসা ছাত্রীকে ক’জন যুবক ধর্ষণ শেষে হত্যা করে বিলের মধ্যে ফেলে রাখে। এরপর বিষয়টি ভিন্ন খাতে নিতে গ্রামের মোড়লদের সহায়তায় বলা হয়, ‘মেয়েটিকে ভূতে মেরেছে।’ ফলে পোস্টমর্টেম ছাড়াই দাফন হয় তার।

কোনো এক মাধ্যমে আমার সাথে পরিচয় হয় মেয়েটির অসহায় বাবার। খুবই দরিদ্র একজন পিতা। চোখে সমস্যা, কম দেখেন। এই নিয়েই গ্রামের বাজারে সামান্য সেলাই কাজ করে সংসার চালান। পুরো বিষয়টি শুনে প্রথমেই তাকে আইনের সহযোগিতা নিতে বলি।

তারপর অনুসন্ধানে নেমে একের পর এক সংবাদ প্রচার করে প্রশাসনের নজরে আনার চেষ্টা করি। সংবাদ প্রচার হবার পর তৎকালিন পুলিশ সুপার ছুটে যান ঘটনাস্থলে। আদালতের নির্দেশে লাশ উত্তোলন করা হয়। পোস্টমর্টেমে মিলে ধর্ষণের আলামত।

এদিককে নামধারী ক’জন সাংবাদিক পত্রিকা হাতে ছুটে যায় সেই গ্রামে, অভিযুক্তদের পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে খবরটি ধামাচাপা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। আবার ওই এলাকার কোনো কোনো সাংবাদিক ফোন ধরে আমাকে ধন্যবাদ জানান, বলেন- আমরা লিখতে পারিনি, (স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির হস্তক্ষেপ থাকায়) আপনি লিখেছেন, আপনাকে ধন্যবাদ।

আমি কলম বন্ধ না করে একের পর এক সংবাদ লিখে যাই। চাঁদপুরের প্রায় সবগুলো পত্রিকা এই সংবাদ প্রকাশ করে, কাজটি আরো সহজ করে দেয়। মেয়েটির হতদরিদ্র পিতা জোর করে মাঝেমধ্যে ২/১শশ’ টাকা পকেটে পুরে দেবার চেষ্টা করেন।

সরলকণ্ঠে বলেন, ‘আপনার ছেলের জন্যে চিপস্ কিনে নিয়েন, আমার তো টাকা নাই, আপনার জন্যে দোয়া করি।

আমি তাঁকে বুকে জড়িয়ে বলি- ‘টাকা লাগবে না, দোয়াটুকুই চাই’। তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে গলায় জড়িয়ে কেঁদে উঠেন। বলেন- ভাই, আপনার ঋণ আমি জীবনেও শোধ দিতে পারবো না। আপনার লেখনির জন্যেই ভূতে মারা মেয়ের হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। ওরা আমার ছোট্ট মেয়েটাকে খারাপ কাজ করে মেরে ফেলছে, আমি বেঁচে থাকতে হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে চাই’।

আমি লোকটাকে সান্ত্বনা দেই, ধৈর্য ধরুন, আপনি অবশ্যই বিচার পাবেন। প্রশাসন তাদের শ্রম, মেধা দিয়ে প্রতিদিন শত শত ভালো কাজ করছে। নিশ্চই আপনার ঘটনাটিও সেই ভালো কাজের অংশ হয়ে আছে।

এরপর দিন যায়, মামলার তদন্তভার নতুন নতুন কর্মকর্তার হাত বদলায়, পুলিশ সুপার বদলায়, কেবল আসামীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। মেয়েটির হত্যার বছরপূর্ণ হয়, আমি আবার নতুন করে কলম ধরি। পত্রিকায় শিরোনাম হয় ‘_ হত্যার এক বছর, দুই বছর পূর্ণ হলো, আসামীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে’।

সেদিন চাঁদপুরের মান্যবর পুলিশ সুপার চাঁদপুর স্যারকে নিজের লেখা বই তুলে দিতে গিয়ে খুব করে একটা আবদার করি- ‘স্যার __ খুনের আসামীরা আজো আটক হয়নি’।

পুলিশ সুপার মহোদয় চমৎকার সুন্দর মনের মানুষ। সাথে সাথে মামলার বিষয়টি টুকে রাখেন নিজের ব্যক্তিগত নোটবুকে। তিনি আসামীদের আটক করার কথা দেন।

অবশেষে মাত্র ১ সপ্তাহের মাথায় মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে একজন আসামী আটক হয়। আজ আদালতে সে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী দিয়েছে, এবং হত্যা ও ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে।

বিকেলে ফোন আসে। হতভাগী মেয়েটির অসহায় পিতা ফোন করে কান্নাজড়িত গলায় এইসব কথা জানায়… আর বলেন- আপনার ঋণ জীবনেও শোধ করতে পারবো না… আমি যতোদিন বাঁচবো, আপনার জন্যে, আপনার পরিবারের জন্যে দোয়া করবো।

আমার খুব ভালো লাগে। মনটায় অদৃশ্য শান্তি অনুভব করি। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে এরচেয়ে বড় পুরস্কার আর কি হতে পারে।

♥♥♥
আপনার প্রতি বিনীত কৃতজ্ঞতা চাঁদপুরের মান্যবর পুলিশ সুপারর মহোদয়।