নির্লজ্জ আচরণ অমানবিক ও পাশবিকতার পরিচয় দিলো বৃদ্ধ পিতার সন্তান

২৯ জুলাই ২০২০ খ্রিস্টাব্দ
১৪ শ্রাবণ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ
০৭ জিলহজ ১৪৪১ হিজরি
বুধবার

সম্পাদকীয় ..

বাবাকে নিয়ে নচিকেতার গানটির কথা আমাদের সকলের নিশ্চয় মনে আছে। খুবই জনপ্রিয় ও মর্মান্তিক একটি গান। প্রিয় সময়ে প্রকাশিত ‘ছেলের ৫টি বাড়ি, তবুও বাবাকে রেখে গেলেন রাস্তায়!’ শিরোনামে সংবাদটি তো আরো বেশি মর্মান্তিক বলে নির্দেশ করে। কতোটা নির্লজ্জ আচরণ, অমানবিক ও পাশবিকতার পরিচয় দেখিয়ে দিলো এক বৃদ্ধ পিতার সন্তান। কী এমন নির্মম কারণ থাকতে পারে সন্তানের এ হেন আরণের? যতোই অভাব থাকুক, একজন পিতা কিম্বা মাতা তার সন্তানকে না খাইয়ে রাখে না। যথাসাধ্য চেষ্টা করে সন্তানকে ভালো রাখার জন্যে। পিতার শরীরে যতক্ষণ রক্ত চলমান থাকে, শক্তি যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই সন্তানদেরকে প্রতিপালন করে। একজন পিতা হলো সন্তানের সবচেয়ে বড় আশ্রয়। অর্থাৎ পিতা হলো কোনো সন্তানের জন্যে সবচেয়ে বড় খুঁটি! নির্ভরতার একটা বড় জায়গায়। যেখানে ভর করে কোনো মানুষ সাহসের সাথে চলতে পারে।

সময় যেমন কারো জন্যে থেমে থাকে না, তেমনি বয়সও কারো জন্যে আটকে থাকে। একসময় তাকে বৃদ্ধ হতে হবে। যখন একজন পিতা বৃদ্ধ হয়, তখন শেষ জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্থান হচ্ছে তার সন্তানরা। তখন সন্তানদের উপর বাবা অথবা মা নির্ভর করতেই পারে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অথবা নৈতিক দিক থেকেও একজন সন্তানের উচিত মা বাবার প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করা। বিশেষ করে একজন পিতা অথবা মা যখন বৃদ্ধ হবে। এমন কোনো আচরণ করা যাবে না, যে আচরণের মাধ্যমে পিতা মাতা মনে কষ্ট পায়। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করাই হলো সন্তানের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। পিতা মাতার যখন বয়স হবে তখন তাদের যে কোনো সমস্যায় তাদের পাশে থাকা উচিত। এ সময় তাদের বয়স বৃদ্ধির কারণে অনেক রোগ হয়ে থাকে। তখন যথাসাধ্য তাদের সেবাযতœ করা সন্তানের কর্তব্য ও নৈতিক দায়িত্ব।

প্রকাশিত সংবাদে আমরা একজন সন্তানের নির্মমতার পরিচয় দেখতে পেলাম। যা’ আমাদের ভাবিয়ে তোলে, কাঁদায়, আমাদের মনে আঘাত করে, হাজারো প্রশ্নের হুঁকি দিয়ে যায়-যার কোনো সঠিক উত্তর আমরা পাই না। আমাদের মনে অনেক ঘৃণা ও ধিক্কার জন্ম দেয়। থু থু দিতে ইচ্ছে করে। মনুষ্যত্বের গায়ে কালিমা লেপন করেছে এই সন্তান। এমন মানুষের জন্ম না হলেই বরং ভালো ছিলো।

ধিক, সেই সন্তানকে; যে এমন জঘন্য আচরণ করেছে তার বাবার সাথে। মনুষ্যত্ববোধ তার মধ্যে নেই। নিষ্ঠুরতায় ছেয়ে গেছে তার হৃদয়। আমরা এমন জঘন্য আচরণকারীকে ঘৃণার চোখে দেখি-ঘৃণার চোখে দেখা উচিত।

আমরা পরিস্কার বুঝতে পারছি যে, সেই বৃদ্ধ পিতা কতো বড় নির্মমতার শিকার হয়েছেন। অবহেলা করে অসহায় বয়স্ক বাবাকে রাস্তায় ফেলে দেয়া পাশবিক আচরণ। প্রায় বার দিন সেই বয়স্ক ব্যক্তি অসহায় অবস্থায় ছিলেন। তাও আবার খোলা আকাশের নিচে। এক সন্তানের মনে নিষ্ঠুরতা; আর অন্য সন্তানের মনে মমতা জেগে উঠে খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকা বয়স্ক ব্যক্তির উপর। খোলা আকাশের নিচে ফেলে রেখে যেতে নিজের সন্তানের বুক একটু কাঁপেনি; আর অন্যের সন্তান এসে পরম মমতায় হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। আরো জঘন্য বিষয় যে, এখনো অবদি সেই বয়স্ক ব্যক্তির পরিবারের কোনো ব্যক্তির খোঁজ মেলেনি। অথবা কেউ তার খোঁজও করেনি। মুমূর্ষু অবস্থায় পরে রয়েছেন হাসপাতালের বেডে।

এমন জঘন্য ঘটনা আমাদের সমাজের জন্যে কী শিক্ষা বহন করে? আমরা কী পেতে পারি এমন ঘটনা থেকে? একসময় আমাদের সকলেরই এই বয়স আসবে। অসহায় পিতার অশ্রæহীন দৃষ্টিতে অনিশ্চয়তার হাজারো প্রশ্ন জেগে উঠা স্বাভাবিক। খোলা আকাশের নিচে থাকতে থাকতে হয়তো চিন্তা করেছেন, যে সন্তানকে এতো পরম মমতায় বড় করেছেন, নিজের খাবার তার মুখে দিয়েছেন, নিরাপত্তার ছায়া দিয়ে গেলেন দিনের পর দিন-আর এখন সেই সন্তানই তাকে রাস্তার উপর ফেলে রেখে চলে গেলো। এমন ভাবনার কী উত্তর দেয়া যেতে পারে এই বয়স্ক ব্যক্তিকে। কী সান্ত¡না হতে পারে এই অসহায় ব্যক্তির জন্যে?

আরো দুঃখজনক বিষয় হলো, সেই বৃদ্ধ পিতা অনিচ্ছা সত্বেও মানুষকে কেঁদে কেঁদে বললো, ‘ছেলে আমাকে বলল, তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করব। এরপর আমাকে রেখে গেল। বড় ছেলের পাঁচটা বাড়ি আছে ঢাকায়।’ এ রকম হাজারো গল্প আছে আমাদের সমাজে। যেখানে পিতা মাতা সন্তানের কাছে থাকতে পারছে না। অনেক অবহেলায় তাদেরকে থাকতে হচ্ছে। যেমন এই বৃদ্ধ ব্যক্তিটির ঢাকার মতো শহরে পাঁচটি বাড়ি থাকতেও সে কোথাও আশ্রয় নিতে পারলো না। তার সন্তানরা তার প্রতি ভালোবাসা দেখালো না, দেখিয়েছে অবহেলা ও নির্মমতা!

সত্যিই প্রতিটি মানুষেরই একটা বয়স আসে, যখন সন্তানদের উপরই তাদের নির্ভর করতে হয় বেশি। এই বয়স্ক ব্যক্তি শারীরিকভাবে যত কষ্ট পাচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন সন্তানদের এমন আচরণের কারণে। প্রতিনিয়ত মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তিনি সময় পার করছেন। তবে এটা সত্যিই যে, এ ঘটনাটি আমাদেরকে দারুণভাবে সাবধান করে দিচ্ছে। সন্তানদের প্রতি বিশ^াসের জায়গাটি দুর্বল করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সময় এসে গেছে, বৃদ্ধ ব্যক্তিদের বেঁচে থাকার জন্যে নতুন আইন প্রণয়নের। যে আইন প্রতিটি ব্যক্তির জন্যেই সহায়ক হবে। অন্তত বয়সকালে যেন সন্তানদের অসহায় আচরণের মধ্যে থাকতে না হয়।