আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ও বর্তমান প্রেক্ষিত

সম্পাদকীয়

৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। পৃথিবীর মানুষ যেন মৌলিক অধিকার সাক্ষরতা অর্জন করতে পারে সেজন্যেই এই দিবসের প্রতি এতোটা গুরুত্ব। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হলো জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা বা ইউনেস্কো-ঘোষিত একটি আন্তর্জাতিক দিবস। ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ১৪তম অধিবেশনে ৮ সেপ্টেম্বর তারিখকে “আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো দিবসটি উদ্‌যাপিত হয়। দিবসটির লক্ষ্য ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং সমাজের কাছে সাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরা। বর্তমানে জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র এ দিবসটি উদ্‌যাপন করে থাকে। সেই সূত্রে বাংলাদেশেও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিবসটি মর্যাদার সাথে পালন করে আসছে প্রতি বছর।

আমরা জানি, পৃথিবীর প্রায় ৭৭৫ মিলিয়ন অধিবাসীর ন্যূনতম প্রয়োজনীয় অক্ষরজ্ঞানের অভাব রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি পাঁচ জনে একজন এখনও শিক্ষিত নন এবং এই জনগোষ্ঠীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই নারী। বিশ্বের প্রায় ৬০.৭ মিলিয়ন শিশু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং আরও অনেকের শিক্ষায় অনিয়মিত বা শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। এটা বড়ই দুঃখজনক।

প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২০ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশের বর্তমান সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বর্তমান সরকারের নানামুখী কর্মসূচির কারণে আগের তুলনায় সাক্ষরতার হার উত্তরোত্তর বাড়ছে। তবে এখনও প্রায় ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী নিরক্ষর। এই জনগোষ্ঠীকে সাক্ষর করতে না পারলে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

আমরা এ কথা বলতে পারি যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রজ্ঞা, মেধা আর দূরদর্শিতা দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে হলে জাতিকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার উদ্যোগটি প্রশংসার দাবিদার। বঙ্গবন্ধু দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে এবং শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হিসেবে ঘোষণা করেন। সাক্ষরতা বিস্তারে আন্তর্জাতিক ফোরামের সঙ্গে একাত্বতা প্রকাশ করে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সাক্ষরতা দিবস উদযাপিত হয়।

আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০২১-এর শ্লোগান বা প্রতিপাদ্য হচ্ছে: খরঃবৎধপু ভড়ৎ ধ যঁসধহ-পবহঃৎবফ ৎবপড়াবৎু: ঘধৎৎড়রিহম ঃযব ফরমরঃধষ ফরারফব বা মানব-কেন্দ্রিক মুক্তিলাভের জন্য সাক্ষরতা: ডিজিটাল বিভক্তিকে কমিয়ে আনা। বিশ্বব্যাপী শিশু, যুবক এবং বয়স্কদের শিক্ষা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে কোভিড-১৯-এর কারণে। সাক্ষরতা ও শিক্ষায় প্রবেশের ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্যকে প্রকটতর করেছে এই কোভিড মহামারী। ৭৭৩ মিলিয়ন নিরক্ষর জনগণের জীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে।

তবে বর্তমানে আমরা এক ভার্চুয়াল জগতে অবস্থান করছি। যে জগতের সাথে আমাদের দরিদ্র মানুষের সে ধরনের পরিচিতি অর্থাৎ সাক্ষরতা এখনো খুব একটা পৌঁছায়নি বলে মনে করছি। যারা এর সাথে তাল এখনও মেলাতে পারেনি, তারা ডিজিটালি নিরক্ষর। ডিজিটাল সাক্ষরতা থেকে তারা দূরে থেকেছে। বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় যারা এই আধুনিক ডিভাইসগুলোর সাথে পরিচিত নন, ব্যবহার করতে হিমশিম খাচ্ছেন কিংবা ব্যবহার করতে পারছে না তারা সবাই ডিজিটালি নিরক্ষর।

কোভিড মহামারী সাক্ষরতার গুরুত্বকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এর আত্মিক গুরুত্বের বাইরেও শিক্ষা একটি অধিকার হিসেবে, সাক্ষরতা একজন মানুষকে ক্ষমতায়িত করে, জীবনমান বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং এটি টেকসই উন্নয়নের চালিকাশক্তি। সাক্ষরতা ও ডিজিটাল দক্ষতা এখন প্রয়োজন নিরক্ষর যুবক ও তরুণদের। এটি আরও আবিষ্কার করবে যে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সাক্ষরতা, কাউকে বাদ দিয়ে নয়। কেননা নিরক্ষরতা দূরীকরণের উপর গুরুত্ব দেয়া হলেই মানুষের জীবনমান উন্নত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমাদের মনে রাখা উচিত যে, সাক্ষরতা হচ্ছে সেই সোনালী সূত্র যার মাধ্যমে একজন মানুষের ক্ষমতায়ন ঘটে এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সামর্থ্য অর্জিত হয়। নাম লিখতে পারার, নিজের সম্পর্কে লিখতে পারার মধ্যে সাক্ষরতা আর আটকে নেই। ডিজিটাল সভ্যতার এই যুগে সাক্ষরতাকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে, তা না হলে বৈশ্বিক অগ্রগতি সমতালে তো নয়ই, বরং বহু ব্যবধান নিয়ে এগুবে। ডিজিটালি পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ২০১৭ সালে তাদের একটি প্রতিবেদনে দেখিয়েছিল যে, ওই বছর প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ১৮.৪ শতাংশ। যেসব শিশু কখনোই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি বা যায়নি, তাদের হার প্রায় দুই শতাংশ। এই হারের ওপর ভিত্তি করে হিসেব করা হয়েছে যে, সারাদেশে ৮-১৪ বছর বয়সী প্রায় ২.৮ মিলিয়ন শিশু রয়েছে যারা বিদ্যালয়ের বাইরে অবস্থান করছে। অর্থাৎ, এই অপার সম্ভাবনাময় শিশুরা নিরক্ষর।

কোভিড-১৯ পরবর্তী বর্তমান অবস্থা খুব বেশি সুবিধের মনে হচ্ছে না। কেননা অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা আগের মতো করতে পারছে না। রিডিং ও হাতের লেখা খুবই ধীর গতির অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আশা করছি, বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকমÐলীর সহযোগিতায় দ্রæত হবে বলে আশা করি। অনেক শিশু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পড়াশুনার সাথে যুক্ত হতে পেরেছে এবং পড়াশোনা বুঝতে পারছে তাও কিন্তু নয়। তাদের জন্য প্রয়োজন বিশেষ ব্যবস্থা যা হারিয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া, পড়া ও লেখার দক্ষতা উদ্ধার হওয়ার জন্য প্রয়োজন।

অপরদিকে, পথশিশু হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ কিংবা মৃত্যু, অর্থলোভী কিছু মাদক ব্যবসায়ীর নিষ্ঠুর নজর। চরাঞ্চল নদী ভাঙ্গন, বন্যা কিংবা সাইক্লোন-ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহহারা মানুষদের একটি বড় অংশ আশ্রয় নেয় শহরের বস্তিগুলোয়। এসব পরিবারের শিশুরা নানা ধরনের অদক্ষ শ্রমিক ও শিশুশ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়, যেখানে মেলে নির্যাতন, বৈষম্য, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট। ফলে, তারা অনেক অসামাজিক কার্যকলাপেও জড়িয়ে পড়ে। মূলত তাদের জন্যে শিক্ষার সুযোগ করতে পারলে তারাও সম্পদে পরিণত হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের বিশাল সংখ্যক শিশু যাদের থাকার স্থায়ী জায়গা নেই, নেই বাবা-মায়ের কোনো খোঁজখবর, তারা নেই বিদ্যালয়ে, কে কোথায় কেমন আছে নেই তার কোনো খবর। এটি একটি বিশাল সামাজিক অনাচার। এই শিশুরা সমাজে এভাবেই বেড়ে উঠছে। কী হবে এদের সাক্ষরতা পুনরুদ্ধারের? কোনো ব্যবস্থা হবে কি? নাকি আমরা এসি রুমে বসে পাওয়ার পয়েন্টে প্রেজেন্টেশন দিয়ে এদের নিয়ে কথা বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবো?

আমরা প্রত্যাশা করি, ৮ সেপ্টেম্বর সাক্ষরতা দিবস সফল ও সার্থক হবে।