করোনার মধ্যেও মৌলভীবাজার সীমান্তে থেমে নেই চোরাচালান

জেলা প্রতিনিধি :

করোনাভাইরাসের এ দুর্যোগকালেও থেমে নেই সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান। সবাই যখন করোনা নিয়ে ব্যস্ত তখন মৌলভীবাজারের বড়লেখা-জুড়ি সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে প্রতিনিয়ত আসছে ভারতীয় গরু-মহিষ। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে মহিষগুলো এনে দেশের অন্যান্য জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।

এছাড়া মোটরসাইকেল, মদ, ইয়াবা, হরলিকস, সিগারেটসহ বিভিন্ন পণ্যের চোরাচালান তো রয়েছেই। মাঝে মধ্যে কিছু ধরা পড়ে। আবার নানা কায়দায় বেশিরভাগই বাজারজাত হয়। এই সীমান্ত দিয়ে মহিষ-গরু আনতে গিয়ে গত এক বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন আহত হয়েছেন। মাঝে মাঝে নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।

গত ১ জুন আসাম রাজ্যের পাথারকান্দি থানার পুতনিছড়া চা-বাগান এলাকায় গরুচোর সন্দেহে কয়েকজনকে পিটুনি দেয় স্থানীয় বাসিন্দারা। এতে রণজিৎ নামের একজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

গত বছর আব্দুর রউপ নামে একজন বড়লেখা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহতও হয়েছেন। চোরাচালান নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে প্রশাসনের স্থানীয় সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানানোও হয়েছিল। কিন্তু তারপরও থেমে নেই চোরাচালান।

বিশেষ করে করোনার এই সংক্রমণের সময় দুই দেশের চোরাকারবারীরা কৌশলে যাওয়া-আসা করছেন। এতে করে সংক্রমণেরও ঝুঁকি বাড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) বড়লেখা উপজেলার সদর ইউনিয়নের গঙ্গারজল এলাকা থেকে চোরাই পথে আসা ৩০টি ভারতীয় মহিষ আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ সময় বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে চোরাকারবারী দল পালিয়ে যায়।

বিয়ানীবাজার বিজিবি (৫২ ব্যাটালিয়ন) ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিজিবি সদস্যের একটি টহলদল উপজেলার গঙ্গারজল এলাকায় অবস্থান নেয়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাকারবারীরা বড়লেখা শহরের দিকে মহিষ নিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে চোরাকারবারীরা মহিষ রেখে পালিয়ে যায়। পরে বিজিবি টহলদল মালিকবিহীন অবস্থায় ৩০টি ভারতীয় মহিষ জব্দ করে। গঙ্গারজল এলাকাটি ভারত সীমান্তের ১৩৮২/৪- এস পিলার হতে ৭ কিলোমিটার অভ্যন্তরে। অভিযানে বিজিবির জুড়ি কোম্পানির টহল কমান্ডার জেসিও-৭১০০ সুবেদার মো. ইমাম হোসেনের নেতৃত্বে বিওসিটিলা, লাতু এবং বোবারথল বিওপি’র বিজিবি সদস্যরা অংশ নেন। এসব মহিষের আনুমানিক সিজার মূল্য ১৮ লাখ ২০ হাজার হাজার টাকা। আটককৃত মহিষগুলো জুড়ি কাস্টমস হাউজে জমা দেয়া হয়। নিলামে পরে মহিষ ব্যবসায়ীরা এগুলো কিনে নেন বলে জানা গেছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার বিজিবির হাতে আটক হওয়া মহিষগুলো ছাদ উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ীর বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। তবে প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে রাজি নয়।

তবে চোরাচালানের যারা মুখ্য ভূমিকা রাখে তারা থাকে ভাড়া করা মানুষ। তাদের কাজ শুধু মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সীমান্ত পার করে দেয়া।

উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর, সদর ও উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা দিয়ে মহিষ, গরু, মোটরসাইকেল, মদ, ইয়াবা, হরলিকস, সিগারেটসহ বিভিন্ন ভারতীয় পণ্য চোরাই পথে আসার খবর স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়।

মাঝে মধ্যে অভিযানে মহিষসহ পণ্য উদ্ধার হয়। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত প্রকৃত মালিক ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়।

সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতে যারা পণ্য আনতে ঢোকেন, তাদের স্থানীয় ভাষায় দৌড়াল (সোর্স) বলে। এরা টাকার বিনিময়ে জীবনের ঝুঁকি নেয়। এদের কেউ কেউ ধরা পড়ে আহত হন। কেউ গুলিতে মারা যান। কিন্তু যারা এর পেছনে অর্থ বিনিয়োগ করেন তারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।

রাত ১২টা থেকে ভোরের মধ্যে চোরাই পথে এসব মালামাল আনা হয়। প্রতি রাতে ওপারের ব্যবসায়ীর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীর মোবাইল ফোনে আলোচনার মাধ্যমে শুরু হয় মালামাল আনার প্রক্রিয়া। এরপর পণ্য আনার জন্য ব্যবসায়ীর বিশ্বস্ত দৌড়াল লোকজন জোগাড় করে সীমান্তের দিকে রওনা দেন। পণ্য আনা-নেয়াকে কেন্দ্র করে আবার দৌড়াল বা সোর্সদের মাঝে প্রায়ই মারামারির ঘটনা ঘটে।

এ বিষয়ে বিয়ানীবাজার বিজিবি ৫২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল গাজী শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা আমাদের টহল কার্যক্রম এবং গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছি। আরও বৃদ্ধি করব। নজরদারি থাকায় বৃহস্পতিবার বড় একটি চালান আটক করা হয়েছে।’