স্মৃতির পাতায় মম : তামীম মোহাম্মদ

মম,আমার স্ত্রী। আজ তার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।

লোক সমাজে আমি একজন আদর্শ স্বামীর দৃষ্টান্ত, যে কিনা তার স্ত্রী মারা যাওয়ার তিন বছর পরেও দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। প্রতি বছর মাদ্রাসায়, এতিমখানায় অনেক খরচ করেন স্ত্রীর নামে, সে আদর্শ না হয়ে পারে বলুন? আমি একজন বাবাও বটে, আমার পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলেও রয়েছে। আমার কলিজার টুকরা সে। আসলে যে যতো যাই বলুক আমার ছেলেকে সৎ মায়ের অত্যাচারিত করার কোনো শখ নেই!! কিন্তু একটি কঠিন সত্য কি জানেন? আমার স্ত্রীর এভাবে চলে যাওয়ার পিছনে সবচেয়ে বেশী দায়ভার আমার।

মমকে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম, আসলে আমার দেখা মম ছিলো জগৎের সেরা মেয়ে, যাকে চোখ বন্ধ করে ভালোবাসা যায়, বিশ্বাস করা যায়। খুব সহজ সরল স্বাভাবিক মায়াবি একটা মেয়ে আমার মম! বিয়ের আগে জমিয়ে প্রেম করেছি, প্রেম করেছি বলা যায় না, প্রতিদিন নতুন করে আমি মমর প্রেমে পড়তাম, এতো হাসিখুশি প্রানবন্ত একজন মানুষ, তার ভুবন ভোলানো হাসি, মায়াবি চোখ আমাকে পাক্কা প্রেমিক বানিয়ে ফেলেছিলো!

আমার মম যখন রাগে অভিমানে কাঁদতো আমারও চোখে পানি চলে আসতো, আমি পাগলের মতো হয়ে যেতাম তার রাগ ভাঙ্গাতে, প্রচন্ড রাগী ছিল মম, তবু আমি কিভাবে যেনো ওকে আমার ঘরে পোষ মানিয়ে ছিলাম, মম রাগী হলেও বাধ্য ছিলো, আমার সব কথা শুনতো। আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমাকে পাগলের মতো ভালো মম ছাড়া আর কেউ বাসতে পারবেনা। আমি স্বার্থপর হই আর যাই হই মমকে আমার চাই ই চাই! আল্লাহ আমার কোনো দোয়া ই আজ পর্যন্ত বৃথা যেতে দেন নি, আমি আমার মমকে আমার করে পেয়েছিলাম কোনো এক বসন্তের দিনে, প্রেমিকা মম থেকে আমার স্ত্রী মম যেনো আরো সুন্দর, আরো মায়াবতী হয়ে গেলো। প্রথম যেদিন স্ত্রী মমকে কাছে পেলাম সেদিন আমি মমকে ডায়েরী গিফট করে বলেছিলাম মম এই ডায়েরীটা তোমার জন্য।
মম লাজুক মুখ করে আমার দিকে পিটপিট করে তাকালো,কিছু বললো না!
আমি একটু হতাশ হয়ে বললাম, জিজ্ঞেস করলেনা এতো কিছু থাকতে ডায়রী কেনো?
মম লজ্জা আর হাসি মিশিয়ে বলল, তুমি তো পাগল, পাগলে কি না গিফট দেয়, বলে হিহি করে হাসতে লাগলো!!

আমি কিছুটা সিরিয়াস মুড নিয়ে বললাম, মম শোনো সংসার জীবনটা অনেক কঠিন, এখানে মনোমালিন্য গুলোকে বেশী প্রশ্রয় দেয়া যাবেনা, দিলেই সংসারে অশান্তি হবে ভালোবাসায় খাদ দেখা দিবে, আর যেহেতু তুমি অনেক রাগি সব কিছু চেপে বসে থাকো তাই একটা সহজ সমাধান আমি বের করেছি! সেটা হলো এই ডায়েরী!!

মম এবার একটু আগ্রহ নিয়ে বলল, তাই নাকি? বলো দেখি তোমার কেমন সমাধান!
আমি এবার বিজ্ঞের মতো বললাম, আমি একজন আদর্শ স্বামী হতে চাই, আর এই জন্য অবশ্যই তোমার সাহায্য প্রয়োজন।
মম এবার খিকখিক করে হাসতে শুরু করলো, হাসি যেনো থামেই না!!

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম উফ্ আমার কথা শুনবে তো আগে নাকি? শুনো এই ডায়েরীতে তুমি প্রতিদিন আমার সম্পর্কে কিছুনা কিছু লিখবে? আমার দোষ গুন যা ইচ্ছা!
আমি প্রতিদিন রাতে সেটা পড়বো! এবং নিজেকে সংশোধন করবো! মনে থাকবে?

মমর আনন্দে ঝলমল করতে করতে বললো, ফ্যান্টাসটিক আইডিয়া, তুমি তো অনেক জোস হাজবেন্ড! তুমি আদর্শ স্বামীর প্রথম ধাপ পার করে ফেলেছো! প্রথম দিনেই বউকে ইমপ্রেস করে ফেলছো।
আমি কিন্তু আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব পালন করা শুরু করে দিয়েছিলাম, দুই তিন দিন পর পর ডায়েরী পরতাম। গালভরা একগাদা প্রশংসা লিখে রাখতো মম।

কিন্তু জীবনের রং গুলো মনে হয় সব জায়গায় একরকম ভাবে ছড়ানো থাকেনা, সাদাকালো অংশ ও থাকে! আমার জীবনটাও একসময় সাদামাটা হতে লাগলো!
কাজের অনেক ব্যাস্ততা, বড় সন্তান হিসাবে পরিবারের দায়িত্ব সব কিছু মিলিয়ে আমি আসতে আসতে রোবট হয়ে গেলাম!
মমর প্রতি কেয়ার কমে শূন্যের কোঠায় নেমে আসলো!
সত্যি বলতে কি আমার কোনো কিছুই আর ভালো লাগতোনা, মমর রাগ অভিমান উটকো ঝামেলা মনে হতে লাগলো!
বাসায় আসলেই মমর গোমরা মুখ আমার দেখতে ভালো লাগতোনা! আমি চাইতাম মম হাসি মুখে কথা বলুক কিন্তু না সে সব সময় মুড অফ করে রাখতো! প্রথম দিকে রাগারাগি করতো আসতে আসতে রাগ করাও ছেড়ে দিলো! বিয়ের প্রথম দিকে মম খুব ঘুরতে যেতে চাইতো, আমি তখন নিয়ে যেতে পারিনি, আসলে আর্থিক দিক থেকে অতোটা স্বচ্ছল ছিলাম না। মমকে নিয়ে অবশ্য পরে একবার কক্সবাজার ঘুরে এসেছিলাম।

আমি মমকে প্রায়ই বিমর্ষ হয়ে জানালার গ্রীল ধরে দাড়িয়ে থাকতে দেখতাম, কিন্তু কেনো যেনো জানতে চাইতাম না মন খারাপের কারন! মম চাপা স্বভাবের, কারন বের করাও কঠিন কাজ ছিলো, তাই আর আগবাড়িয়ে ঝামেলায় পড়তে চাইতাম না!

তবে এতো না বলার মধ্যে মমর কয়েকটা আবদার খুব মনে পড়ে, আমাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষীকি তে মম বলেছিলো তামীম আসার সময় আমার জন্য বেলী ফুলের গাজরা আনতে পারবে? আজকে আমি তোমার পছন্দের নীল শাড়িটা পড়বো!

আমি সেদিন রাতে খালি হাতে গিয়েছিলাম, আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম! লজ্জায় আর মমর সাথে কথা বলিনি, মম খুব সুন্দর করে সাজগোজ করে আমার জন্য অপেক্ষা করেছিলো, সেদিন হয়তো ওকে ভালোবেসে বুকে টেনে নিতে পারতাম, কিন্তু আমি সাহস পাইনি, আর বেচারি রাগে অভিমানে ক্ষোভে ওপাশ ফিরে সারারাত কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে! সবকিছু বুঝেও আমি নিশ্চুপ ছিলাম! কেনো ছিলাম জানিনা!

সেদিনের পর মম আমার কাছে কিচ্ছু চায়নি! একদম কিচ্ছুনা! একদিন মম আমার হাত ধরে বলেছিলো তামীম একটা কথা রাখবে?
আমি গম্ভীর মুখে বলেছিলাম হু বলো…
মম কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, আমার খুব অস্থির লাগতেছে এই কয়টা দিন তুমি প্লিজ আমার কাছে থাকো, অফিস থেকে ছুটি নিলে হয় না?

আমার কেনো যেনো ন্যাকামি লাগলো, এসব আহ্লাদি কথাবার্তা বিয়ের আগেই ভালোলাগতো এখন লাগেনা!তবুও নিজেকে শান্তরেখে বললাম, মম তুমি তো শিক্ষিত মেয়ে, কাজের জায়গায় কোনো কম্প্রোমাইজ চলেনা এটা কি তুমি বুঝোনা।

মমর ছলছল চোখে আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো প্লিজ তামীম প্লিজ! আমার তোমাকে খুব পাশে পেতে ইচ্ছা হয়, প্লিজ জাস্ট কয়েকটা দিন!
আমি অনিচ্ছা সত্বেও বললাম ঠিক আছে আমি চেষ্টা করবো….
সত্যি বলতে আমি কোনো চেষ্টা ই করিনাই, আমার কেনো যেনো বাসায় আসতে ভালো লাগতোনা! এমন না আমি মমকে ভালোবাসতাম না, অথবা পরনারী আশক্তি!তবু কেনো যেনো সংসারটা আমার ভালো লাগতোনা!

হঠাৎ একদিন আমার ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিয়ে আমার মম চলে গেলো না ফেরার দেশে।

আসতে আসতে মমর শূন্যতা টের পাওয়া শুরু করলাম। আমার আর মমর ঘরে ঢুকলাম! খাটে মমর ওড়না পড়ে ছিলো, বুকের ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠলো! আমার এমন লাগলো কেনো, আমি তো সংসার থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম! নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে শুয়ে পড়লাম! কিন্তু বিছানায় মমর বালিশ কোলবালিশ পড়ে আছে আমার মম তো নাই!
আমার বুকের ভেতর হুহু করে উঠলো! আমি সেদিন প্রথম কাঁদলাম, হাউমাউ করে কাঁদলাম, মমর কাপড় চোপড় জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম!! আমি কি হারিয়েছি।আমার সব দুঃখ কষ্ট তো মমর সাথে শেয়ার করতাম এখন এই কষ্ট আমি কাকে বলবো? একা ঘরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসলো!! আমি তো সংসার থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম, মমর কাছ থেকে তো চাই নি, তবে কেনো মম চলে গেলো!

আমি পাগলের মতো মমর ড্রয়ারের কাপড় গুলো একটা একটা করে বের করতে লাগলাম, সব কাপড়ে মমর শরীরের গন্ধ মিশে আছে! তারপর ই হঠাৎ চোখে পড়লো সেই ডায়েরীটা যেটা বিগত কয়েক বছর পড়া হয়নি!
আমি পড়তে লাগলাম, আর শিহরিত হলাম।
আমি কতটা নিষ্ঠুর, আমি কতটা পাষান!

মম আমাকে বিশ্বাস করেছিলো, ভেবেছিলো আমি তার অভিযোগ গুলো পড়বো, শুধরাবো কিন্তু আমি দিনের পর দিন তাকে অবহেলা করেছি, আমার প্রতিটা অবহেলার গল্পশেষে মম গোটা গোটা করে লিখেছে, যত যাই হোক আমার তামীম পৃথিবীর সেরা স্বামী! এটা লিখার কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না, হয়তো সে নিজেকে শান্তনা দিতো, আর মনে প্রানে চাইতো আমি সত্যিই আদর্শ স্বামী হই!

মমর কিছু লেখা লেখা আমার মনে দাগ কেটে গেছে, যার জন্য আমি নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবোনা….

> তামীম তুমি তো জানতে আমার খুব জ্বর, আমার অসুখ করলে একা থাকতে ভালো লাগেনা, খেতে ভালো লাগেনা, কি হতো যদি বাসায় ফিরে আমার কপালে হাত রেখে জ্বর মাপতে, একটু আদর করতে!!
তুমি এতো মন ভোলা কেনো তামীম? আমাকেও ভুলে যাবা? অবশ্য চেষ্টা করে লাভ নাই আমি তোমাকে কোনোদিন ভুলতে দিবো না আমার আদর্শ স্বামী!

> তামীম তুমি বকলে আমার খুব কষ্ট হয়, আমার কষ্টগুলো আর আগের মতো কেনো বুঝনা? আমাকে আর ভালো লাগেনা? আমার সাথে আর খারাপ ব্যবহার করোনা প্লিজ!

> নিজেকে খুব একা লাগে ইদানিং, আমি সম্ভবত স্ত্রী হিসেবে আদর্শ নই, আমারও উচিত ছিলো তামীমকে ডায়েরী দেয়া, আদর্শ স্ত্রীর গুন গুলো জানা যেতো তাহোলে! যদিও জানি তামীম আর ডায়েরী পড়েনা, আমার জন্য ওর এতো সময় কই!

> আমার কাঁটা হাতটা তামীম নিজ হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো ঠিকি,কিন্তু একটা বার জিজ্ঞেস করলোনা, মম ডান হাত কেটেছে, ভাত খাবে কিভাবে? আমি হেল্প করবো? তামীম তুমি কি জানোনা আমার তোমার হাতে খেতে ভালো লাগে! আজ না খেয়ে থাকবো, কি হবে খাবো না ভাত।

> খুব বাজে স্বপ্ন দেখি আজকাল। তামীমের সাথে আরেকজনের বিয়ে!! আল্লাহ তুমি আমার তামীমকে আমার সাথে জান্নাত দিয়ো আর কিছু চাই না! আমার সেরা স্বামী যেনো শুধু আমারই থাকে…

এটাই ছিলো মমর শেষ লেখা, আমার সাথে জান্নাত!!আমি কি করে পারবো আরেকজনের সাথে সংসার বাধতে! আমি তো মমকে অবহেলায় ছুড়ে ফেলে রেখে হত্যা করেছি! আমি যদি আমার স্ত্রীর খেয়াল রাখতাম তবে সে এতো ডিপ্রেশনে ভুগতোনা!

আমার দেয়া প্রতিটি উপহার যত্নে আগলে রেখেছিলো মম। মরা গোলাপ, বেলীতে ভরপুর ব্যাগ! কবেনা কবে দিয়েছি সব রেখে দিয়েছে!
অথচ আমি তাকেই ফেলে দিয়েছি! প্রচ্ন্ড রাগ অভিমান বুক ভরা কষ্ট নিয়ে আমার মম চলে গেছে আমাকে ছেড়ে! দিয়ে গেছে উপহার হিসেবে আমার ছেলেকে!
আমার ছেলেটা দেখতে অবিকল মমর মতো হয়েছে। মমর মতো রাগ ও হয়েছে। মমর শরীরের গন্ধ আমার ছেলের শরীরেও! যে কিনা সকাল বিকাল রাতে মমর স্মৃতি বহন করে!

আচ্ছা মানুষের কি আরেকটা জনম হয়? আরেকবার পৃথিবীতে আসা যাবে! যদি পারতাম তবে আমি সত্যি সত্যি আমার স্ত্রীর সেরা স্বামী হয়ে থাকতাম, ইশ যদি পারতাম একবার নিজেকে শুধরাতাম…..

মম জানো, আমার এখন খুব ইচ্ছে হয় এই পৃথিবীর সব ছেড়ে তোমার কাছে চলে যেতে। কিন্তু তোমার উপহারটার জন্য পারিনা। তোমাকে ছাড়া থাকাটা আমার জন্য অনেক কষ্টদায়ক। আবার তোমার দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহারটার দিকে তাকালে সকল কষ্ট সহ্য করে থাকতে হয়।

আমি হয়তো আদর্শ স্বামী হতে পারিনি কিন্তু যদি বেঁচে থাকি আদর্শ বাবা হবো, দেখে নিও…

ভালো থেকো আমার মায়াবতী আর আমাকে ক্ষমা করো।