বাল্যবয়সে বিয়ের ফল, রক্তক্ষরণে কিশোরী নববধূর মৃত্যু

সম্পাদকীয় …

ঘটনাটা বেশ স্পর্শকাতর। ঘটনায় আমরা উৎকণ্ঠিত। আধুনিক এ সমাজে এসব ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত। যদি বর্তমানে পূর্বের দশ বছরের চেয়ে শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে, কিন্তু এখন অজ্ঞতা ও কুসংস্কারপ্রিয় মানুষের মনোভাব বদলায়নি। মানুষ এখন প্রাচীন মুর্খতার যুগে বসবাস করছে, যা আমাদের অত্যন্ত ব্যাথিত ও মর্মাহত করে।

বাল্যবিয়ের বলি হলো অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নূর নাহার (১৪)। অভাব ঘোচাতে আর কিশোরীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় পড়ার টেবিল থেকে তুলে বসানো হয় বিয়ের পিঁড়িতে। মাসখানেক আগেই লাল শাড়ি আর মেহেদি পরে কনের সাজে শ্বশুরবাড়ি যায় নূর নাহার। কিন্তু মাত্র ৩৪ দিনের মাথায় জীবনের ইতি টানতে হলো তাকে।

জানা যায়, নূর নাহারের বাবা সখীপুর উপজেলার নলুয়া কলাবাগান গ্রামের বাসিন্দা। তিনি পেশায় রিকশাচালক। মা গার্মেন্টকর্মী। অভাবের সংসারে তার দিনমজুর নানা উপজেলার কাউলজানী ইউনিয়নের কলিয়া গ্রামের বাসিন্দা লাল খান চার বছর বয়সে নূর নাহারকে নিজের বাড়ি নিয়ে আসেন। এরপর তাকে স্কুলে ভর্তি করান। নূর নাহার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।

গত ২০ সেপ্টেম্বর উপজেলার ফুলকি পশ্চিমপাড়া গ্রামের আব্দুর রশিদের ৩৪ বছর বয়সী ছেলে প্রবাস ফেরত রাজিব খানের সঙ্গে বিয়ে হয় নূর নাহারের। বিয়ের সময় নানা লাল খানের প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। এই টাকার জোগান দেন তার আত্মীয়স্বজনরা।

মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায় তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি হয়নি। অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হওয়ায় শারীরিক সম্পর্কের পরই নূর নাহারের রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে নূর নাহার ও রাজিবের পরিবারে আলোচনা হয়।

পরে রাজিবের পরিবারের পক্ষ থেকে গ্রাম্য কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। এতেও ফল না পাওয়ায় গত ২২ অক্টোবর নূর নাহারকে ভর্তি করা হয় টাঙ্গাইলের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে।

ওই ক্লিনিকে নূর নাহারকে তার পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে স্বামী রাজিব ও তার পরিবার কৌশলে কেটে পড়ে। পরে অবস্থার অবনতি হলে নূর নাহারের পরিবার তাকে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি করেন।

এ সময় মেয়েটির চিকিৎসা করানোর মতো টাকাও ছিল না গরিব পরিবারটির হাতে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় গ্রামবাসী প্রায় ৬০ হাজার টাকা তুলে দিলে উন্নত চিকিৎসার জন্য নূর নাহারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে তার পরিবার।

কিশোরী নববধূর এমন দুঃসময়েও শ্বশুরবাড়ির কোনো লোকই ছিল না পাশে। অবশেষে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার (২৪ অক্টোবর) রাতে মৃত্যু হয় তার। পরদিন রোববার (২৫ অক্টোবর) ময়নাতদন্ত শেষে তাকে তার নানার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

নূর নাহারের নানা লাল খান বলেন, মেয়েজামাইয়ের অভাবের কারণে নাতনি নূর নাহারকে ছোটকালেই আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। দিনমজুরি করেও তাকে লেখাপড়া করাচ্ছিলাম। ছেলে প্রবাসী ও ধনী হওয়ায় মেয়েটির সুখের কথা ভেবে আমরা নূর নাহারকে বিয়ে দিই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে আর বাঁচাতেই পারলাম না।

মৃত্যুর পর নূর নাহারের স্বামী রাজিব তার লাশটি পর্যন্ত দেখতে আসেননি। মূলত স্বামীর কারণেই আমার নাতনির মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

অন্যদিকে নূর নাহারের স্বামী রাজিব খান, শ্বশুর ও শাশুড়িসহ বাড়ির লোকদের দাবি, ‘আগে থেকেই মেয়েটির জরায়ুতে টিউমার ছিল। মেয়ের অসুস্থতা গোপন করে বিয়ে দিয়েছেন তার নানা। তার পরও আমরা চিকিৎসায় কোনো কৃপণতা করিনি।’

জানা গেছে, নূর নাহার মেধাবী ছাত্রী ছিল। অষ্টম শ্রেণিতে তার রোল নম্বর ছিল ২। তার মৃত্যু সংবাদ খুবই কষ্টদায়ক। কোনো নূর নাহার যেন বাল্যবিয়ের বলি না হয়। কারণ, বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে একটি সম্ভাবনাময় কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। শুধু আইন দিয়ে নয়, আমাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা দিয়ে সামাজিকভাবে বাল্যবিয়ে নির্মূল করতে হবে।

নিহত নূর নাহারের স্বামীর বাড়ির পক্ষ থেকে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসার প্রস্তাব দেয়া হলেও আইনি প্রক্রিয়ায় এর বিচার না হলে বাল্যবিয়ের বলি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নূর নাহারের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে না বলে দাবি সচেতন মহলের। তাই আমরা আশা করছি, আমাদের ছেলেমেয়েদের অভিভাবকগণ এ ব্যাপারে সচেতন হবেন, বাল্য বয়সে দিয়ে দিয়ে আপনার নাড়ি ছেড়া ধনকে অকালে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবেন না।

আমরা খবরের বস্তুনিষ্ঠতায় বিশ্বাসী, সঠিক সংবাদ পরিবেশনই আমাদের বৈশিষ্ট্য

০১ নভেম্বর ২০২০ খ্রি. ১৬ কার্তিক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪২ হিজরি, রোববার