গন্ধরাজ

যুবক অনার্য :

১০ টার সময় মৌলির সংগে দেখা হবে। আমি বলেছি নীল জামদানি নীল চুড়ি পরে আসতে সংগে নীল টিপ।মৌলি এগুলি আমার উদ্দেশে পরবে – মন থেকে নয়,একান্তই “না” বোলতে পারে নি বোলেই পরা। আমি কিছুটা জোর করেই রাজি করিয়েছিলাম এই বলে যে,আর তো কোনওদিন দেখা হবে না,তাই,অন্তত এটুকু আব্দার তুমি ফিরিয়ে দিওনা।

প্রতিটি মেয়ের মধ্যেই থাকে একটি স্বপ্নপুরুষ। আমি বস্তুত তেমনটি নই বোলেই মৌলি আসলে রাজি নয় -এসব বুঝেও আমি দেখা করার জন্য ছেলেমানুষি টাইপের বায়না ধরেছি- নিজের কাছেই লজ্জা লাগে, তবু্ও শেষবারের মতো দেখবার ইচ্ছেটা এড়িয়ে যেতে পারি নি।যদিও আমি জানি ওর এক কাজিনের সংগে পরিবার থেকেই বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, ছেলেটি পিএইচডি করছে কানাডায়।বিয়ে এবং প্রেমের বাজারে আমি আনফিট পুরোদস্তুর -এটা আমি ভালোই বুঝি। বুঝে মৌলিও।তবু মনের বিরুদ্ধেই আজ ১০ টায় মৌলি দেখা করতে রাজি হয়েছে কেননা দেখা করার সংগে প্রেম বা বিয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।

মৌলি আমাকে বেশ ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছে আমার সংগে প্রেম – বিয়ে কোনোটিই সম্ভব নয়। আমিও বুঝেছি। বুঝেও খুব অনুরোধ করে বলেছি – চলেই তো যাবে, বিয়ের আগে অন্তত একটা দিন সময় দাও, এতে কি খুব সমস্যা হবে বিয়ে ভেঙে যাবে! সে বলেছিল – বিয়ে ভাঙবে না। ওর কাজিন অনেক আধুনিক এবং ওকে বিশ্বাস করে অন্ধভাবে।

আমি বলেছিলাম – তবেতো হলোই তবে আর চিন্তা কিসের! মৌলি বলেছিলো- হলো না কারণ এভাবে একটি এক পাক্ষিক আর অসম ব্যপার আমার ভাল লাগেনা। আমি বলেছিলাম -না হয় আমার কারণে একটু খারাপ লাগলো।লাগুক না, আর তো কয়েকটা দিন, তারপরেই তো উড়োজাহাজে করে উড়ে যাবে।মৌলি আর কিছু বলেনি।মৌলির কাছে ১০ টা মানে ১০ টাই, ১০ টা মানে ১১ টা নয়।

কিন্তু ১১ টা পার হয়ে ১২ টা আর তারপর ঘড়ির কাটা ১টায়, মৌলি এখনও আসছে না -কুয়াইট আননেচারাল -এরকম হতেই পারে না,কিছুতেই না।ফোন দেয়া নিষেধ,তাই ফোন দিচ্ছি না।১ টা পর্যন্ত দেখে আমি চলে এসেছিলাম। সেদিন মৌলি আসেনি। মৌলি আর কোনোদিনই আসেনি।

ঠিক সেইদিনই সে তার প্রেমিক পুরুষের সংগে পালিয়ে গিয়েছিলো।কাজিনের সংগে বিয়ে ঠিক ছিল ফ্যামিলি থেকে কিন্তু কাজিনকে মন থেকে সে মেনে নিতে পারে নি। সে যে অবিনাশ নামে এক ছোকরাকে পছন্দ করে যে ছোকরা আবার কাব্য টাব্য করে বেড়ায়- আমার কাছে মৌলি তা সম্পুর্ণ চেপে গিয়েছিল। কেনো চেপে গিয়েছিলো তা আমার কাছে আজও নারীর মতোই রহস্যময় ।

এইরকম ঘটনা নতুন কিছু নয় – এসব ঘটে চলেছে হরহামেশাই। মৌলি আমাকে মূল বিষয়টা শেয়ার করলে ওর জন্যেই ভাল হতো, আমি ওকে ভাল কোনো পরামর্শ দিতে পারতাম বলেই আমার বিশ্বাস।

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর যেখানে আমাদের দেখা হবার কথা ছিল- টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সামনে আকস্মিকভাবেই একদিন মৌলির সংগে দেখা হয়ে গেলো, সংগে সেই কবি ছোকরা।

দাড়ি গোঁফে একাকার, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা।মৌলি পরিচয় করিয়ে দিলো।কুশল বিনিময়ের পর বলল – দাদা, বাসায় এসো একদিন। বিয়ে থা তো করলে না, এখনও সময় আছে করে ফেলো।বিয়ের প্রসংগ এড়িয়ে আমি বললাম – নিশ্চয়ই যাবো একদিন। দেখা হবে, ভালো থেকো।কবি ছোকরা আর মৌলি খুব দ্রুত লয়ে হেঁটে চলে গেলো যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

আশ্চর্য বা কাকতালীয় যে, সেদিন মৌলির পরনে ছিল নীল জামদানি নীল টিপ নীল চুড়ি। দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম – মৌলি ভালো নেই।আমি তবু মনে মনে বললাম -কানাডায় আলিশান জীবনে ভালো থাকার চেয়ে একজন কবি পুরুষের সংগে মন্দ থাকাও অনেক ভালো। এইরকম একটি অদ্ভুত বাক্য আমি কেনো আউড়ালাম- নিজেই জানি না।কিন্তু আমার ভালোর সংগে মৌলির কনসেপ্ট তো নাও মিলতে পারে।আমি সমীকরণটি একটু ভেবে দেখতে চাইলাম- আমি ভালবাসতাম মৌলিকে, মৌলি অবিনাশকে, মৌলির বিয়ে ঠিক ছিলো কাজিনের সংগে কিন্তু হয় নি।বিয়ে হলো কবির সংগে।মৌলি এখন ভালো নেই।ওর চোখের তারায় স্পষ্ট দারিদ্রের ছাপ।

তবু শেষ পর্যন্ত আমার একটা কথা ভেবে খুব ভালো লাগলো যে, কানাডার বিরুদ্ধে কবি কিংবা অবিনাশ অর্থাৎ কবির জয় হলো যদিও এটা স্বাভবিক ভাবেই স্বাভাবিক নয়।স্বাভাবিক তো এটাই ছিল যে অবিনাশ হেরে যেতো, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতো কবিতা আর মৌলি সাঁই সাঁই করে উড়ে গিয়ে পড়তো কানাডায়, কিন্তু সেটা না হয়ে কবির জয় হলো এটা খুবই রেয়ার কেস। আমি মনে মনে অবিনাশকে বললাম – সাব্বাস বাপ কা বেটা!

অবিনাশের জয়কে আমার মনে হলো বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে শোষিত শ্রেণির জয়।কিন্তু এটি একটি বিছিন্ন ঘটনা। বুর্জোয়া শ্রেণির সংগে শোষিত শ্রেণির জয় — সে অনেক দীর্ঘ সংগ্রাম আর বিপ্লবের পথ।অবিনাশ আর মৌলির বিষয়টা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এটাকে কোনো স্ট্যান্ডার্ড ধরা যুক্তিসম্মত নয়। এই ঘটনা কবিদের সামগ্রিক জয়ের মাইলফলকও নয়।

নাইবা হল কিন্তু আমি জানি যেদিন সামগ্রিকভাবে কবিতা জয়ী হবে একমাত্র সেদিনই জয়ী হবে মানবতা সেদিনই জয়ী হবে শোষিত শ্রেণি সেদিনই পৃথিবীতে ফুটে উঠবে একটি সত্যিকারের গন্ধরাজ ফুল যার সুবাস বন্টন হবে সমভাবে সবার উদ্দেশে।সেই দিনটা কবে আসবে ঠিক জানি না কিংবা এরকম কোনো দিন আদৌ আসবে কিনা সেটাও আমার জানা নেই কিন্তু আজ মৌলি আর অবিনাশকে এক সংগে দেখে আমি সামান্য হলেও সেই গন্ধরাজটির ঘ্রাণ পেলাম -এটা কি আমি মনস্তাত্ত্বিক ভাবে পেলাম নাকি সত্যি সত্যি পেলাম এ ব্যপারে আমি কনফিউজড!

তবে সেই গন্ধরাজটি ফুটার জন্য যে বিপ্লবের কোনো বিকল্প নেই সে ব্যপারে আমি মোটেই কনফিউজড নই।সেই বিপ্লবকে সংক্ষিপ্তভাবে আমি বলবো- প্লাস্টিকের গন্ধরাজের বিরুদ্ধে একটি প্রাকৃতিক গন্ধরাজের বিপ্লব যা আজ আমি হয়তো মিথ্যে করে হলেও পেয়েছিলাম মৌলি আর অবিনাশ চলে যাবার পর। ওরা চলে যাবার পর পেছন দিক থেকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল -ওরা যেনো সেই প্রাকৃতিক গন্ধরাজের দিকেই যাত্রা করেছে।

মৌলি কোনোদিন আমার হবে না -এর চাইতেও প্রাকৃতিক সেই গন্ধরাজটির প্রয়োজন অনেক বেশি – কবি না হলেও এ কথা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি অনায়াসে।বুঝতে পারি কারণ একদা কবিতা লিখতে গিয়ে আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিলাম।অবিনাশ ফেরেনি।অবিনাশরা ফেরে না বোলেই আমি এখনও স্বপ্ন দেখতে পারি প্রাকৃতিক সেই গন্ধরাজের যা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের উদ্দেশে প্রস্তুত -ছড়িয়ে দিতে চায় উজাড় করা সৌরভ তার!