আমাদের সুপ্ত লজ্জাকে জাগিয়ে তুলতে হবে

প্রকাশিত :
০৭ আগস্ট ২০২০ খ্রিস্টাব্দ
২৩ শ্রাবণ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ
১৬ জিলহজ ১৪৪১ হিজরি
শুক্রবার

সম্পাদকীয়…

লজ্জা মানুষকে উন্নত মানসিকতার মানুষ হিসেবে পরিচিত করে তোলে। লজ্জা হলো মানুষের মনুষ্যত্বের ভূষণ। লজ্জা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে আমাদের কর্মকাণ্ডের মাঝে। লজ্জা থাকে বলেই মানুষ অনেক মন্দতা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। লজ্জাহীন মানুষ মনুষ্যত্বকে বলিদান দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। স্বলজ্জ মানুষ অন্য মানুষ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা প্রকৃতির হয়ে থাকে। লজ্জাহীন মানুষের বিবেক অবশ হয়ে যায়। আর বিবেক অবশ হলেই তো হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মানুষ যে কোনো কাজ করতে দ্বিধা করবে না।

প্রতিটি মানুষেরই লজ্জা থাকে। লজ্জাহীন মানুষ আছে বলে মনে হয় না; তবে সে লজ্জা সুপ্তভাবে মানুষের মধ্যে থাকে। সেই লজ্জাকে জাগিয়ে তুলতে পারলেই তো প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে পারবে। আর এজন্যে দরকার শিক্ষা, প্রকৃত নৈতিক শিক্ষা। যে কাজ মানুষকে দু:খ দেয়, যে কাজে ক্ষতিসাধন হয় সে কাজই তো লজ্জাজনক কাজ। এমনই লজ্জাজনক ঘটনা আমাদের সমাজে এখনোও ঘটে চলেছে।

যৌতুক বিষয়টি আত্মসম্মানের পর্যায়ে পরে না। মানুষের সম্মান নষ্ট করে। আমাদের সমাজে কিছু মানুষ আছে যৌতুক চাইতে একটুও লজ্জাবোধ করে না। উপরন্তু মেয়ের বাবা দিতে অসমর্থ হলেও সেই রাগ গিয়ে পরে মেয়েটির উপর। চলে মেয়েটির উপর অবহেলা, অমানুষিক নির্যাতন। অথচ ধর্মীয় বিধান মতে যৌতুক নেয়া পাপ ও অপরাধ। কিন্তু সেই বিধান জঘন্য সমাজে মানা হয় না। বরং মেয়ের পক্ষ থেকে সরাসরি চাইতেও এতটুকু লজ্জা তাদের থাকে না।

প্রিয় সময়ে প্রকাশিত ‘কচুয়ায় যৌতুকের দাবিতে গৃহবধূকে মারধরের অভিযোগ’ শিরোনামে সংবাদের মাধ্যমে জেনেছি একটি মেয়ের করুণ পরিস্থিতির বিষয়। যৌতুকের টাকা না পেয়ে সেই মেয়েটিকে মারধরের উপভোগ উঠেছে এবং থানায় মামলাও হয়েছে বলে আমরা প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। আমরা আরো জেনেছি যে, উল্লেখিত পিতৃহীন মেয়ে তানজিনা আক্তারের ‘বিয়ের সময় জামাতাকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার দেওয়া হয়। বিয়ের কিছুদিন পর থেকে যৌতুকের জন্য গৃহবধু তানজিনাকে চাপ দিতে থাকেন স্বামী ও তাঁর পরিবারের লোকজন। যৌতুক দিতে অস্বীকৃতি জানালে স্বামী উজ্জল, শ্বাশুড়ি শাহনাজ ও শ্বশুর তোফাজ্জল হোসেন তাকে প্রায়ই মারধর করেন।’ বিয়ের সময় উপহার দেয়াটা একেবারেই নিজস্ব ও সামাজিকতা, যাকে আমরা সৌন্দর্য হিসেবে নিতে পারি। কিন্তু সেটা যদি হয় যৌতুকের পর্যায়ে তাহলে সেটা অসামাজিকই আমরা বলতে পারি। আর এখানে যেহেতু ‘চাপ’ দেয়া ও ‘মারধর’ করাটা কোন পর্যায়ে গেছে সেটা পাঠক মাত্র বুঝতে পেরেছেন।

এসব রুচিশীল মানুষ মোটেও পছন্দ করেন না। অসামাজিক বা রুচিহীন মানুষ পরিবারের একজন হতে পারে; শিক্ষার অভাবের কারণে। কিন্তু পরিবারের সকলেই যখন অসামাজিক বা রুচিহীন নির্লজ্জ হয়ে যায় সেখানে কী সমাধান আসতে পারে। তখন মেয়েটির উপর কী নেমে আসতে পারে এবং তা কতোটা মর্মান্তিক বিষয়। প্রকাশিত সংবাদে আমরা জেনেছি, অত্যাচার থেকে নিজেকে রক্ষার জন্যে ‘ কয়েক বছর পূর্বে তানজিনার কাছে তার বাবার বাড়ির সম্পত্তি ও কিছু টাকা যৌতুক দাবি করে উজ্জল। তখন বাবার বাড়ি থেকে ৫০ হাজার টাকা এনে স্বামীকে দেয় গৃহবধু তানজিনা।’ প্রতিবেশী কিম্বা সমাজের লোকজন কি (মেয়েটির উপর অত্যাচার ও যৌতুক দাবি) এসব বিষয় কি একটুও জানতো না? অন্তত মেয়েটিকে রক্ষার জন্যে সমাজ এগিয়ে আসতে পারতো না? তাহলে সমাজের লোকজনও কি বিষয়টিকে একেবারে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে? এগুলো শুধুই প্রশ্ন! তবে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জেনেছি যে, সমাজ এগিয়ে এসেছিলো, তবে তা’ সন্তোষজনক ফলপ্রসূ হয়নি। পরবর্তী ঘটনা আরো মর্মান্তিক পর্যায়ে চলে গেছে।

আমাদের অবস্থাটা এমন একটা পর্যায়ে চলে এসেছে যে যৌতুক দিতেই হবে। আর এটা একেবারেই স্বাভাবিক একটি বিষয়। এটা একটা দাবি। এতে লজ্জার কোনো বিষয় নয়, এটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। ভাত খেলে যেমন আমাদের পেট ভরে, তেমনি যৌতুকের দাবি পূরণ হলে আমাদের সমাজের কিছু নির্লজ্জ মানুষের মন ভরে, প্রশান্তি লাগে।

যৌতুক বিষয়টি কবে যে ছি! ছি! ছি! পর্যায়ে আসবে এবং এটাকে মানুষ ঘৃণার চোখে দেখবে-সেটা একটা বড় প্রশ্ন। তবে আধুনিক শিক্ষার উন্নতির ফলে যৌতুক বিষয়টিকে অনেক লজ্জাজনক বলে মনে করা হয়। কোনো কোনো সমাজে বা জায়গায় যৌতুক বন্ধ হয়েছে আমরা বলতে পারি, তবে পুরোপুরি নয় হয়তো। কেননা যৌতুকের এখনো অনেক সংসার ভেঙ্গে যায়, মেয়েরা বাপের বাড়িতে দিনের পর দিন পড়ে আছে, কেউ কেউ আবার বিষ খেয়ে আত্মহত্যাও করেছে, কোনো কোনো মেয়ে আবার অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে হলেও স্বামীর বাড়িতে পড়ে আছে।

আমাদের বক্তব্য হলো, আইন রয়েছে এবং সেই আইনের বাস্তবায়ন অবশ্যই থাকতে হবে। তাহলে সমাজ থেকে যৌতুক নামক অভিশাপ দূর হবে। দূর হবে গৃহবধূর প্রতি অত্যাচার ও নির্যাতন। আর এজন্যে প্রতিটি স্তর থেকেই আমাদের সুপ্ত লজ্জাকে জাগিয়ে তুলতে হবে।