শিশু নির্যাতন অমানবিক

সম্পাদকীয়

কখনো কখনো সন্দেহ মারাত্মক বিষয়। আবার সন্দেহ হওয়াটাও কখনো কখনো একেবারেই স্বাভাবিক। তবে সন্দেহ হলেই সত্যের উদ্ঘাটন দরকার আছে। যে কারণে সন্দেহ করা হচ্ছে, সেটা খতিয়ে দেখে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। এটা বুদ্ধিমানের কাজ, নীতিগতভাবে শিক্ষারও একটা বিষয়। অন্যথায় বিরাট ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। যে ভুলের জন্যে অন্যের ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি নিজের বিবেককেও দংশন করা হয়। কিন্তু এমন কিছু মানুষ থাকে, যাদের বিবেক এতো অবশ থাকে যে, তারা এসব বিষয় নিয়ে মোটেও ভাবে না। ভাবার দরকারও মনে করে না। অবশ বিবেকের মায়ামমতা থাকে না বললেই চলে। আর এ ধরনের মানুষের কারণে সমাজে দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়।

প্রিয় সময়ে ‘চোর সন্দেহে দুই কিশোরকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটি সচেতন পাঠকের দৃষ্টিতে পড়েছে। এটি লোমহর্ষক একটি ঘটনা। অপরদিকে আমাদের সমাজে শিশুদের প্রতি অমানবিক নির্যাতনের ঘটনা একটার পর একটা ঘটেই চলেছে। আমাদের সমাজকে কিছু মানুষরূপী পশু কলুষিত করে চলেছে, মানবতাকে ভুলুণ্ঠিত করে হিং¯্রতার পরিচয় দিয়ে চলেছে দিনের পর দিন।

প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে আমরা জেনেছি যে, ‘মোবাইল চোর সন্দেহে দুই কিশোরকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পেটানোর ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর ভবানিপুর এলাকায়।’ আমরা জেনেছি যে, কথিত স্থানীয় প্রভাবশালী গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে চলেছিলো অমানবিক এ নির্যাতন। শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখবো যে, অত্যাচারীরা কোনো না কোনোভাবেই প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তিলকে তাল বানিয়ে তারা অমানুষের মতো শিশুদের প্রতি নির্যাতন করে থাকে। অর্থাৎ তাদের সাহসটা বেড়ে যায়, প্রভাবশালী হওয়ার কারণে। কেননা তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না, পারে না কেউ প্রতিবাদ করতে। অথবা যে কোনোভাবেই হোক তারা সমাজের মধ্যে নির্দোষ হিসেবে পরিগণিত হয়। আর সমাজও চুপটি করে তাদের নির্যাতন সহ্য করে যায়। যা আমরা এই অসহায় দুই শিশুর নির্যাতনের ঘটনা থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারছি।

একজন প্রভাবশালীর দামী মোবাইল থাকতেই পারে। আর আমরা প্রকাশিত সংবাদে দেখেছি, চোর সন্দেহে মোবাইল চুরি হওয়ার পরের দিনই ভোরবেলা জোর করে ধরে নিয়ে আসে পার্শ্ববর্তী চর গোবিন্দপুর গ্রামের দোলোয়ার হোসেনের ছেলে রাকিব (১২) ও একই গ্রামের জাহির মিয়ার ছেলে ফয়সালকে (১৭)। এরপর তাদের বেঁধে চালানো হয় অমানসিক নির্যাতন। আমাদের মতে এভাবে নির্যাতন করা মোটেও উচিত হয়নি। যদি তাদেরকে সন্দেহ করা হয়, তাহলে বিষয়টির তদন্ত করা উচিত ছিলো। অথবা পুলিশের সহযোগিতা নেয়া যেতো। তাহলে সুন্দর একটি সমাধানে আসা যেতো। এলাকার একজন প্রভাবশালী বলে এভাবে অন্যায় করবে এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়ার কথা নয়। আমরা প্রকাশিত সংবাদে দেখেছি, ‘নির্যাতনের সময় স্থানীয় অনেকে উপস্থিত থাকলেও প্রতিবাদ করেননি কেউ।’ এটাও খুবই দুঃখজনক একটি বিষয়। তারা চোখের সামনে দেখছে একটি অমানবিক আচরণ হচ্ছে।

প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে আমরা জেনেছি যে, যারা নির্যাতন করেছে তারা বয়সে ৪৫/৫০ বছরের। সুতরাং এ জাতীয় বয়স্ক ব্যক্তিদের অবশ্যই সংযত হওয়া দরকার ছিলো। তাদের নৈতিক শিক্ষার দারুণ অভাব ছিলো বলেই তারা এমন অমানবিক আচরণ করতে পেরেছে। তাদের এটা ভাবা উচিত ছিলো যে, তাদেরও পরিবারে এই বয়সী শিশু রয়েছে। সুতরাং সেদিকটা চিন্তা করে তাদের বিচার করা দরকার ছিলো। তাদের ভাবা উচিত ছিলো, আদৌ ঐ শিশুরা চুরি করেছে কিনা। যদি চুরি করেই থাকে, তাহলে ঐ শিশুদের পুলিশের হেফাজতে রাখা যেতো এবং শিশু আইনের আওতায় নিয়ে শিশু সংশোধনাগারে রেখে দেয়া যেতো। কিন্তু তারা এই হীন কাজ করে মানুষের চোখে নিজেদের ছোট করেছে।

আমরা প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে আরো জেনেছি যে, গভীররাতে নির্যাতনকারী চর ভবানীপুর এলাকার গোলাম মোস্তফা (৪৫) ও সফির উদ্দিন (৫০) দুইজনকে আটক করেছে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। তাদেরকে আটক করা যথার্থ হয়েছে। আমরা চাই এর একটা সুষ্ঠু বিচার হোক। আমরা প্রকাশিত সংবাদে ফয়সালেল মায়ের আর্তনাদের কথা জানতে পেরেছি। তার ছেলে চুরি করেনি বলে তিনি দাবি করেছেন। এরপরও তার ছেলেকে রশি দিয়ে বেঁধে বাঁশ দিয়ে পিটিয়েছে। তিনি এই অমানবিক আচরণের বিচার চেয়েছেন। সুতরাং ঐ নির্যাতনকারী প্রভাবশালী অমানবিক আচরণকারী ভদ্রলোকদের শিশু নির্যাতনের আওতায় এনে কঠির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। যেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

নির্যাতিত কিশোর ফয়সালের দাদি কমলা খাতুন বলেন, চোখের সামনে আমার নাতিকে মারধর করেছে। আমি তাদের পায়ে ধরেছি তবুও তারা মানেনি। আমার নাতি কোনো অপরাধ করলে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার কথা বলেছি। মানুষকে এমনভাবে কেউ মারে না। কষ্টে আমার বুকটা ফেটে গেছে, আমি অজ্ঞান হয়ে গেছি।

মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি ফৌজদারি অপরাধ করে তবে দেশে প্রচলিত আইনে তার বিচার হবে। কেউ যদি আইন নিজের হাতে তুলে নেয় তবে সেটিও অপরাধ। চুরির অপবাদে কিশোর নির্যাতন সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। নিশ্চই নির্যাতনকারীদের বিচার হবে।