চাঁদ দেখি, পূর্ণিমার চাঁদ!

অশোক কুমার রায় :

দো‘চালা টিন দিয়ে কোন ভাবে বেড়িবাঁধের পাশে খাশ জমিতে একটা ঘর বেধেঁছে। কয়েকটি টিন কাঠের সাথে লাগিয়ে দ‘ুটি চালা তৈরী করে সেটা উঠিয়েছে বটে কিন্তু অন্য দ‘ুপাশ ফাঁকা আর আটকাতে পারেনি মজিদ।পারবে কিভাবে দিনব্যাপী নৌকায় জাল ফেলে যে টাকা রোজগার করে তার বেশির ভাগই দাদনের টাকা পরিশোধ করতেই যায় আর অল্প কিছু টাকা দিয়ে ছয় সদস্য বিশিস্ট পরিবারের সংসার আর চলে না। সেখানে ঘরের অন্য দু‘পাশ বন্ধ হবে কি দিয়ে। ঐ দু‘পাশ ফাঁকা থাকায় অবশ্য একটা সুবিধা রয়েছে বটে সেটা হলো চাঁদনী রাতে চাঁদের সবটুকু আলো এসে ঘরের মধ্যে পড়ে এক অন্যরকম দৃশ্যের সৃস্টি করে । মজিদের কাছে তখন ঘর কে আর ঘর মনে হয় না, মনে হয় জান্নাত! ঐ ফাঁক ভেদ করে যখন জোসনার আলো ঘুমন্ত বৌয়ের মুখের উপর পড়ে তখন নিজের বৌকে হুর পরী মনে হয়!

মজিদের পূর্নিমার রাতে কেন যেন ঘুম মোটেই আসতে চায় না । আজ ঘুমের মধ্যে হঠাৎ গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মজিদ উঠে বসে পিছনের বেড়ার সাথে পিঠ বাধিয়ে হেলান দিয়ে বসে ফাঁকা চালা দিয়ে চাঁদ দেখচ্ছে। পূর্ণিমার চাঁদের নিচ দিয়ে সাদা মেঘ, কালো মেঘ ভেসে ভেসে যাচ্ছে আপন খেয়ালে আর সেজন্য মাঝে মাঝে আলো আধাঁরি খেলা চলছে আকাশে। মজিদের খুব ভালো লাগছে বলে চাঁদের সাথে মেঘের লুকোচুরি খেলা রাত জেগে দেখে মনে করছে এ জগতে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য যেন আর নেই।

অন্যদিকে চাঁদের আলো এসে রেবেকার মুখের উপর পড়ে রেবেকাকে অন্যরকম সুন্দরী মনে হচ্ছে। রেবেকা মজিদের বৌ। রেবেকার দিন ভরে খাটুনির শরীর । যেকারণে বেঘোরে ঘুমায় রাতে, ওর ঘুম সহজে ভাঙ্গে না। মজিদ আজ নিজের বৌয়ের মুখের দিকে চেয়ে দেখে মনে করে এ এক অপ্সরী শুয়ে আছে।

দুপুরে কাজ হতে ফিরে রেবেকাকে এ রকম কোন দিন দেখেনি। কাজের খাটুনি খেটে খেটে নিজের শরীরের যতেœর চিন্তা কখনও কারো করার চিন্তা মনে হয়ি যেখানে। সেখানে দেখা তো দুরের কথা তবুও মধ্য দুপুরে রেবাকার দিকে তাকালেই ওর ঝুলে পড়া বুক, গায়ের তামাটে রং আর খোলামেলা অগোছাল শরীর দেখে তাকাতে ইচ্ছা হয় না। কাছে গেলে ঘার্মাত শরীর থেকে গন্ধ আসে। সে কারণে মনে কখনও ভালবাসা তো দূরের কথা মনে ভালই লাগে না।

কিন্তু আজ মাছঘাটে শহরের এক নার কে ভাল করে দেখেছে। কিযে সু-ন্দ-রী! লম্বাটে মুখ মেদহীন শরীর হালকা উচুঁ বুক, কোমর পর্যন্ত যেন খাঁজকাটা দীঘল কালো চুল । চুল গুলো হালকা বাতাসে উড়ছে, নিটল লম্বা নাক যেন টিয়া পাখির ঠোঁট। একটু হালকা হাসিতে মাছঘাট যেন রিনঝিন শব্দে সকলের মন ভরিয়ে দিয়েছে। কোন এক শহরের মেয়ে না বৌ ঠিক ঠাহর করতে পারেনি মজিদ তবে এত সুন্দরী কোন নারীর দেখা এ জীবনে তার ঘটেনি।

রাতে মজিদ দুপুরের কথা ভাবে আর রেবেকার মুখের দিকে চেয়ে ওদের বিয়ের সময়কার কথা মনে করে। রেবেকা এমনি ছিল বিয়ের সময় চঞ্চলতায় এ কুড়ে ঘর দুলে উঠত। অল্প বয়স ষোড়সী কন্যা দেখে টাসকী খাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল যখন বাবার সাথে এ কন্যা দেখতে পাশের গায়ে গিয়েছিল মজিদ। বাবা মেয়ে দেখে বলেছিল কি মিয়া কন্যা পছন্দ হয়েছে? মজিদ লজ্জায় কিছু বলতে পারেনি সেদিন কিন্তু বাপজান বুঝেছিল পছন্দ হয়েছে। তাই ঐ দিনই বিয়ে। শুক্রবার ছিল প্রস্তুত ছাড়া বিয়ে হয়ে গেল এবং বৌ নিয়ে মজিদরা বাড়ী চলে এলো।

বৌয়ের যৌবন তখন উছলিয়ে উঠছে। মেদহীন শরীর,গায়ের রং দুধে আলতা ,ডাগর ডাগর চোখ আবার ঐ চোখে কাজল পরেছে, পায়ে আলতা, কপালে দিয়েছে লাল টিপ। বাসর রাতের হালকা সৌর আলোয় ঠিক অপ্সরীর মতো লাগছিল অথচ এই বৌটাকে অভাবের সংসারে এনে আজ তামা বানিয়ে ফেলেছি। ঠিক মতো না খেয়ে পেরে শরীর ভিষণভাবে নস্ট হয়েছে।

তাছাড়া বছর বছর এক একটা করে সন্তান পয়দা করতে গিয়ে বৌটা শেষ! বছর বিকানো বৌ হয়ে গেছে। এতে করে কি আর শরীর থাকে।কি আর করা আল্লা সন্তান দেয় তা না নিলে কি আর হয়! সন্তানতো আল্লার নিয়ামত এভেবেই বছর বছর ফি বছর করে রেবেকার কোলে চার চারটি কন্যা সন্তান এখন।

অভাবের সংসারে মজিদ কন্যাদের ভাল করে খাওন দিতে পারেনা, ভাল কাপড় তো দূরের কথা কাপড় দিতে পারে না প্রয়োজনীয়। কোন ভাবে চলছে ওদের জীবন।সেখানে আলাদা করে বৌকে সোহাগ করার জো কোথায়! তবুও আজ কেন যেন এ পূর্ণিমায় মজিদের বৌয়ের জন্য কেমন মায়া হলো।

এ ভেবে আবারও মজিদ রেবেকার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে। আর বৌকে ভাল করে নতুন রুপে নতুন ভাবে ভেবে ভরা যৌবন উপভোগ করছে।ন কত সময় ধরে এভাবে তাকিয়ে আছে খেয়াল করেনি। হঠাৎই রেবেকা জেগে উঠে বলে কি গো কি দেখ? মজিদ বলে চাঁদ দেখি, পূর্ণিমার চাঁদ!

রেবেকা মজিদকে বলে রাত দুপুরে ঢং করো না ঘুমাতে দাও। আজ সারাদিন বড়ই খাটুনি গেছে। এখন ঘুমাতে দাও বলে পাশ ফিরে ঘুমায়। মজিদের যেন স্বপ্নভঙ্গ হয়। এখন রেবেকাকে কাছে পেতে মন চায় কিন্তু রেবেকার ভাব ভঙ্গি দেখে কিছুটা হতচকিত হয়ে আবারও ভাঙ্গা চালা দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে আর রেবেকার গায়ে হাত দিয়ে ডাকে বলে রেবেকা শুনছো, দেখ কত সুন্দর চাঁদ! রেবেকা কোন সাড়া নেই। অসাড় শরীরে বেঘোরে ঘুমায়। অভাবের সংসারে প্রেম-প্রীতি, ভালবাসার কোন দাম নেই।


শারীরিক সর্ম্পকটা যেখানে একটা আর্ট সেখানে মজিদ ও রেবেকার জীবনে এটা একটা জৈবিক চাহিদা মাত্র এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। মজিদ যেকারেণে নিজের জগতে ফিরে এসে জোসনার আলোয় রেবেকার উপর ঝাপিয়ে পড়ে নিজের ইচ্ছা দমন করতে। এটাকো মজিদরা তাদের পৌরষত্ব বলে মনে করে। ক্ষণিকের চিন্তায় পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও রেবেকার মুখটা আরো সুন্দর ভাবনাটা উবে গিয়ে জৈবিক চাহিদাই বড় হয়ে ওঠে। সেখানে নেই ভালবাসা নেই প্রেম হয়তো আগামী বছর পঞ্চম সন্তানের মা হয়ে যাওয়াটাও বিচিত্র নয় রেবেকার। এটাই ওদের জীবন!!