“তুমি রবে নীরবে”

দুলাল পোদ্দার :

আজ ২২ শ্রাবণ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ (২০২২) বিশ্বকবি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮১তম প্রয়াণ দিবস। কবিগুরুর প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ মানুষের সামনে তুলে ধরা আমাদের আজ অবশ্য কর্তব্য হয়ে দ্বাঁড়িয়েছে। মানুষ চিরদিনই চায় আনন্দময়, প্রেমময়, দুর্ভাবনামুক্ত একটি সরল সুন্দর জীবন। আর এজন্যই রবীন্দ্রনাথ আমাদের সর্বকালেই বড় বেশি প্রয়োজন। কাল বিচার করলে বর্তমান সময়ে তো আরো বেশি প্রয়োজন।

বিশ্বপ্রেম ও শান্তির উদ্যোক্তা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মানবতাবাদী একটি অসাম্প্রদায়িক পৃথিবীর প্রত্যশা ছিল তাঁর। অথচ পৃথিবী আজ হিংসায় উন্মত্ত। ক্ষমতাধর দেশগুলো আজ যুদ্ধে লিপ্ত। সারা বিশ্বে আজ অশান্তি। ঠিক এই সময়ে আমাদের একমাত্র আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ। বাংলাদেশ, বঙ্গালি সমাজ জীবন ও বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাতের আবির্ভাব এক বিস্ময়কর ব্যাপার। শুধু বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি নয়, পৃথিবীর ভাব ও অনুভূতির ক্ষেত্রেও তাঁর অভিজ্ঞতা ও দর্শন উজ্জ্বল হয়ে আছে। পৃথিবী আজ রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ভীষণভাবে আলোড়িত ও আন্দোলিত। এমন সময়ে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যকর্মের আলোচনায় সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা বাঙালি সমাজের জন্য যেন পথ নির্দেশনা। এই দু:সময়ে আমাদের একমাত্র অবলম্বন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই বলছি-“তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম নিবিড় নিভৃত পুর্ণিম নিশিথীনী সম”। কল্পনার অধীশ্বর রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন, “গানের সুরে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেম। আর সব জিনিসের মূল্য যেন এক মূহুর্তে বদলে গেল। যা অকিঞ্চিতকর ছিল তাও অপরূপ হয়ে উঠলো। প্রভাত সঙ্গীত থেকে শেষ লেখা পর্যন্ত তাঁর সব কাব্যেই মানুষের কথা। কবির দেশপ্রেম। মানবতাবাদী চিন্তাধারা আজকের সমাজে খুবই প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথে হৈমন্তী, দেনা-পাওনার সমাজ প্রতিবেশ থেকে এখনো আমাদের সমাজ মুক্ত হতে পারে নি। হৈমন্তী, মনোরক্ষার মত যৌতুক প্রথার বিষময় পরিণীত এখনো আমাদের সমাজের মেয়েদের জীবনে ঘটে চলেছে। এই একুশ শতকেও যৌতুকের কারণে প্রাণ দিতে হচ্ছে নারীদের।

রবীন্দ্রনাথ জাতির উন্নয়নে শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কেননা শিক্ষার জোরেই পশ্চিমের মানুষেরা পৃথিবীকে জয় এবং ভোগ করার অধিকার পেয়েছে। তাঁর শিক্ষা ভাবনার মূল বিষয় হলো নান্দনিকতা, মানবিকতা আর আনন্দের সাথে শিক্ষা লাভ। শিক্ষা বলতে তিনি বুঝিয়েছেন মানুষের হৃদয়ের বিকাশ। শিক্ষা সম্পর্কে তিনি যে চিন্তা করেছিলেন তা আজো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রাসঙ্গিক।

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে শিক্ষার্থীদের সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। তাই তিনি শিক্ষাক্রমের ভেতর ভাষা সাহিত্য দর্শণ, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সংগীত, নৃত্য ও পল্লী উন্নয়নের মত সামাজিক কাজকে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এ সব যুক্ত করা আজ খুবই প্রয়োজন যুব সমাজকে বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করার জন্য। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থায় সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেননি। তাঁর মতে শিক্ষার মূল লক্ষ্য সত্য অর্জন। তাতে আতœার মুক্তি ঘটে। শিক্ষার ভেতর দিয়ে আজকে যুবসমাজ সত্য অর্জন করতে পারছে না বলে সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হতে পারছে না। এতে সভ্যতা বিপর্যস্ত হচ্ছে। যুক্তি তর্ক জ্ঞান বুদ্ধি বিবর্জিত শিক্ষার মানবিক গুণের বিকাশ হয় না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এসবের বিকাশ ঘটলে মানুষের মন সংস্কার মুক্ত হবে, মনের অন্ধত্ব ঘুচবে। তাই শিক্ষ্রাগন্থ রচনার সময় তিনি আনন্দকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এজন্য রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনাকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে।

আমরা বুঝলাম-নতুন যুগের ভোর এনে দিতে পারে-একমাত্র শিক্ষা ব্যবস্থা। বর্তমানে আমাদের সমাজে শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্বলতা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ একশ বছরেরও বেশি আগে যা লিখেছেন আজও সমাজ তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্তার দুর্বলতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন,-“আমাদের শিক্ষকরা শুধু পাঠদান করেন, প্রাণদান করেন না।”

অচলায়তনে কবিগুরু দেখিয়েছেন-যে শিক্ষায় জীবনের প্রাণস্পন্দন হয় না সে শিক্ষা অচল, আর সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই- অচলায়তন। “রথের রশি” নাটকে দেখালে-পুরোহিততন্ত্র, রাজতন্ত্র, বনতন্ত্রের হাতে যখন সমাজ চালানোর ভার থাকে তথন সমাজের রথ চলে না। সমাজের সব মানুষ যখন রথের রশি ধরে তখন রথ সচল হয়। সব মানুষের ঐক্য-শক্তিতেই সমাজ ও রাষ্ট্রের জয়। তিনি দেখিয়েছেন জবাবদিহিতা ছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্র অচল। আধুনিক রাষ্ট্রবিদদের মত তিনি গণতন্ত্রের চর্চার ওপর রাষ্ট্রের কল্যাণ দেখেছেন। তাই আমাদের সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য চাই মিলন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,- এখন আর দেরি নয়, র্ধ গো তোরা হাতে হাতের র্ধ গো। আজ আপন পথে ফিরতে হবে সামনে মিলন স্বর্গ। রবিন্দ্র সঙ্গীতের বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য হলো, কবিতার মতোই এ বাণী প্রধান। তাঁর গান কেবল শোনার জন্য নয়। কবিতার মত পাঠযোগ্য ও বটে। রবীন্দ্রনাথ প্রথম বাঙালি হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯১৩ সালে। এ পুরস্কার প্রাপ্তি ঘটেছিল তাঁর গীত প্রধান কাব্য সংকলন গীতাঞ্জলির জন্য। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ১০৪ বছর পর ২০১৭ সালে আমেরিকার জনপ্রিয় সঙ্গীত রচিয়তা ও শিল্পী বব ডিলানকেও এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তার বনী প্রধান সঙ্গীতের জন্য। বিশ্বের দু’জন ব্যক্তিই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন বাণী প্রধান সঙ্গীতের জন্য।

তাসের দেশ নাটকের রাজপুত্র বলেছেন, “বেড়ার নিয়ম ভাঙলেই পথের নিয়ম আপনিই বেরিয়ে পড়ে, নইলে এগোবে কী করে।” সমাজের কালো অধ্যায় থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। তা হলে দেশ অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা ক্ষেত্রে এগিয়ে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হবে। তাসের দেশ নাটকে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছন-কোন নিয়মনীতির শাসনে বহমান মানব জীবন ও সমাজকে বন্দী করা যায় না।

রবীন্দ্রনাথ গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধে নারী মুক্তির কথা বলেছেন। বর্তমান সমাজে নারীর অবমূল্যায়নে এখনো রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্কি। “নারী” প্রবন্ধে লিখেছেন- “নির্বিচারে অন্ধ রক্ষণশীলতা সৃষ্টিহীনতার বিরোধী, অজ্ঞানের জড়তা এবং কাল্পনিক ও বাস্তবিক ভয়ের জগৎ থেকে উঠে এসে নারীকে নিজের অধিকার লাভ করতে হবে”। আধুনিক কালে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারীকে ঘরে রেখে, তার ওপর ধর্ষনের নিষ্ঠুরতা আর যৌতুকের ভার চাপিয়ে দেশের উন্নয় করা যাবে না। সামান্য ক্ষতি কবিতার রাজা গরীবের ঘর জ্বালিয়ে আগুন পোহানোর দায়ে রানীকে বাসা থেকে বের করে দেন। দুই বিঘা জমির আতœসাৎ কারীকে রবিন্দ্রনাথের কাছে ঘৃণিত হয়েছিলেন।

আজকের ভূমিদূস্যদের নদী খাল ভরাট আর অপরিকল্পিত স্থাপনার জন্য লোকালয়ে যে অসহনীয় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে জন জীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে। তার কোন প্রতিকার নেই। কাজেই আমাদের আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা ও জাতীয় জীবনে রবীন্দ্রথের ভাবনাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮১তম প্রয়ান দিবসে আমাদের অন্তরে বেজে চলছে মুধর স্বরে সেই রবীন্দ্রনাথের বীনার সুর। প্রতিটি সচেতন বাঙালির মনে প্রশ্ন জাগে- বাজিল কাহার বীনা মধুর স্বরে আমার নিভৃত নব জীবনে পরে।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আন্তরিক ভাবেই খুঁজে বেড়িয়েছেন মিলন স্বর্গ। সন্ধ্যান করেছেন মানবমুক্তির পথ। একান্ত চিত্তেই গেয়ে উঠেছেন জীবনের জয়গান এবং সবাইকে সাথে নিয়ে পৌছতে চেয়েছেন জগতের আনন্দ যজ্ঞে। হয়তো তাই পালতোলাা বোটে চড়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন নদীতে অনেকবার। সৃজন করেছেন অনেক গল্প, কবিতা গান। যার প্রমাণ মেলে ছিন্নপত্র গ্রন্থে।

বিশ্বায়নের এই যুগে রবীন্দ্রনাথ আমাদের উন্নয়ন ভাবনার অনুপ্রেরণার উৎস। মানুষ তাই বারবার রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যায়। বাঙালি জাতি সুখে দু:খে আনন্দে উৎসবে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে ফেরে। এই রবীন্দ্রনাথকে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পৌছে দিতে হবে-তবেই দেশ ও জাতি আলোর পথ খুঁজে পাবে। আজ প্রয়াণ দিবসে তাঁকে প্রাণভরে শ্রদ্ধা জানিয়ে, সকলের মঙ্গল কামনা করে ইতি টানছি।