ওহাবী কারা ও তাদের বিশ্বাস কি? এবং আহলে সুন্নতের আকীদা

ওয়াহাবী আন্দোলন (আরবীঃ وهابية ওয়াহাবিয়াহ) হচ্ছে ধর্মীয় আন্দোলন বা ইসলামের একটি শাখাগোষ্ঠী যা অর্থোডক্স, ধর্মের দিক থেকে অতিচরমপন্থী,” বিশুদ্ধবাদী,” একেশ্বরবাদীর উপাসনার জন্য ইসলামী পূনর্জাগরণ, চরমপন্থী আন্দোলন ইত্যাদি নামে পরিচিত। ইবনে তাইমিয়া এবং আহমাদ ইবনে হানবাল এর শিক্ষায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে এই মতবাদে বিশ্বাসীরা ইসলামের মূলধারা থেকে বিচ্যুতদেরকে কোরআন ও হাদিসের বর্ণিত পথে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়।

বিশ্বের ওয়াহাবী মতবাদে বিশ্বাসীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবে বাস করে। সৌদি আরবের ২২.৯%, কাতারের ৪৬.৮৭%, আমিরাতের ৪৪.৮%, বাহরাইনের ৫.৭%, কুয়েতের ২.১৭% জনগণ ওয়াহাবী পন্থী। সৌদি আরবের ওয়াহাবী পন্থী লোকের বেশীর ভাগ নজদ অঞ্চলে বাস করে। সৌদি আরব, কাতার, শারজাহ এবং রাস আল খাইমাহ তে ইসলামের অফিশিয়াল সংস্করণ হচ্ছে ওয়াহাবী মতবাদ।

নামকরণ
Muhammad ibn ʿAbd al-Wahhab (আরবি: محمد بن عبد الوهاب‎‎;বাংলায়: মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব) (জন্ম ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে, মৃত্যু ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে) একজন ইসলামিক সালাফি পন্ডিত এবং ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।তাঁর জন্ম নজদ প্রদেশে (বর্তমান রিয়াদ)।মূলত তাঁর নামানুসারে এই আন্দোলনের নাম হয়েছে।

সমালোচনা
২০১৮ সালের ২২ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রে সফরে দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া সৌদি প্রিন্স ডিনাইস কুশনার ইজ ইন হিজ পকেট শীর্ষক ৭৫ মিনিটের এক সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ বিন সালমান বলেন, স্নায়ুযুদ্ধের সময় পশ্চিমা দেশগুলোর অনুরোধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবেলায় সৌদি আরব মুসলিম দেশগুলোতে ওয়াহাবি মতবাদ বিস্তারে অর্থায়ন করে।এর লক্ষ্য ছিল, মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে পশ্চিমাদের জয়লাভ করা। রাশিয়াভিত্তিক স্পুটনিক নিউজ, আরটিসহ বিশ্বের আরো কয়েকটি গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হয়। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)

 

কারী মুহাম্মাদ তৈয়্যব সাহেব (রহঃ) মুহতামিম দারূল উলূম দেওবন্দ :

১. ওহাবীদের বিশ্বাস হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসহ সকল নবীগণ বাহ্যিক ইন্তেকালের পর তাদের কবরে জীবিত থাকেন না এবং নবীগণের ইন্তেকালের পর তাদের শরীরের সাথে রুহের কোন সম্পর্কও থাকে না।

পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাতের অনুসারী ওলামায়ে দেওবন্দের আকীদা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসহ সকল নবীগণ বাহ্যিক ইন্তেকালের পরও তাদের কবরে জীবিত থাকেন এবং তাদের শরীরের সাথে রুহের সম্পর্ক পূর্বের ন্যায় বাকী থাকে।

যার প্রমাণ দেখতে চাইলে, (১) আবে হায়াত (২) হাদীয়াতুশ শীয়া (৩) আজবিবা আরবাঈন এর ২য় খন্ড দেখুন।

হযরত মাওলানা কাসেম নানুতভী (রহ.)এর এসব কিতাবে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

২. ওহাবীদের বিশ্বাস হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনা শরীফ গমণ করা অবৈধ।
তারা বলে, শুধু মসজিদে নববীতে নামাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে সেখানে যাওয়া বৈধ তখন জিয়ারতও করা যেতে পারে।
পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাতের অনুসারী ওলামা দেওবন্দের আকীদা হল, শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনা শরীফ গমন করা উত্তম আমল, মুস্তাহাব ও ওয়াজিবের নিকটবর্তী বিষয় এবং হজ্জ ওমরা ছাড়া ও অন্য কোন নিয়্যত ছাড়া শুধু জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনা শরীফে গমন করা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র কবরে ছালাম পেশ করে ধন্য হওয়া হল অতি উত্তম আমল ও ফজিলতের বিষয়।
যার প্রমাণ দেখতে চাইলে কুতুবুল ইরশাদ হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.)এর ‘জুবদাতুল মানাছেক’ কিতাব দেখুন।
তাতে তিনি জিয়ারত যে উত্তম আমল তা হাদীস দ্বারা প্রমাণ করেছেন।

৩. ওহাবীদের বিশ্বাস হল, নবীগণ ও বুযুর্গগণের ইন্তেকালের পর তাদের ওয়াছিলায় আল্লাহর নিকট কোন দোয়া করা অবৈধ ও হারাম।

পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাতের অনুসারী ওলামায়ে দেওবন্দের আকীদা হল, নবীগণ ও ওলী-মুর্শিদ এবং বুযুর্গগণের ওয়াসিলায় দোয়া করলে সে দোয়া কবুল হওয়ার বেশি আশা করা যায়। যা শুধু বৈধ নয় বরং তাতে দুনিয়া ও আখেরাতে অনেক কল্যাণ ও উপকার বয়ে আনে।

এর প্রমাণ দেখতে হলে, (১) হযরাতে চিশত (রহ.) (২) আদাবে জিয়ারত (৩) আদিয়ায়ে মদিনা মুনাওয়ারা নামক কিতাবসমূহ দেখুন।

আর এ বিষয়ের পক্ষে হযরত কাসেম নানুতভী (রহ.) হযরত গাঙ্গুহী (রহ.) হযরত ইয়াকুব নানুতভী (রহ.) ও হযরত হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) এর লিখিত কিতাবসমূহ দেখুন।

৪. ওহাবীদের বিশ্বাস হল, নবীগণ সমালোচনার উর্ধ্বে নন তাদের সমালোচনা করা যেতে পারে। এমনকি ওয়াহাবিরা নবীগণের দোষ চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে থাকে।

পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাতের অনুসারী ওলামায়ে দেওবন্দের আকীদা হল, নবীগণ নিস্পাপ ও গোনাহ থেকে পূত পবিত্র। তাদের দোষ চর্চা করলে ঈমানহারা হয়ে যেতে হয়।

বরং ওলামায়ে দেওবন্দ নবীগণের প্রতি অধিক সুধারনা পোষণ করার কারণে বাহ্যিক দৃষ্টিধারী অজ্ঞরা মনে করে ওলাম দেওবন্দ এ বিষয়ে অতিরঞ্জন করছেন।

এর প্রমাণ দেখতে হলে, হযরত গাঙ্গুহী (রহ.)এর লিখিত কিতাব ‘জুবদাতুল মানাছেক’ দেখুন এবং হযরত কাসেম নানোতুভী (রহ.)এর কিতাব (১) আবে হায়াত (২) কেবলানুমা (৩) তাহজিরুন নাস (৪) হাদিয়াতুশ শীয়া (৫) আজবিবা আরবাঈন (৬) কাসেমুল উলূম (৭) মুনাজারা আজিবা ইত্যাদি কিতাবসমূহ দেখুন।

৫. ওহাবীদের বিশ্বাস হল, তাসাওউফ, বাইয়াত ও তরীকত তথা পীর-মুরিদী এবং জিকির শোগল, মুরাকাবা ও তাওয়াজ্জুহ, জিকিরের মজলিস ইত্যাদি বেদআত ও হারাম। ওয়াহাবিরা এসব গুরুত্বপূর্ণ আমলের ঘোর বিরোধী।

পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাতের অনুসারী ওলামা দেওবন্দের আকীদা হল, তাসাওউফ, বাইয়াত ও তরীকত তথা পীর-মুরিদী এবং জিকির শোগল, মুরাকাবা ও তাওয়াজ্জুহ, জিকিরের মজলিস ইত্যাদি আমল সমূহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যে কারণে ওলামা দেওবন্দ এসব গুরুত্বপূর্ণ আমল তাদের আমলী জীবনের অংশ বানিয়ে নিয়েছেন।

এর প্রমাণ দেখতে হলে ওলামা দেওবন্দের লিখিত তরীকতের কিতাবসমূহ দেখুন। বিশেষ করে আত্তাকাশশুফ ও আত্তাশাররুফ এবং শরীয়ত ও তরীকত কা তালাজুম দেখুন।


৬. ওহাবীদের বিশ্বাস হল, কোন মুজতাহিদ ইমামের অনুসরণ করা অবৈধ।
ওহাবীদের মধ্য হতে কিছু লোক বুযুর্গদের অনুসরণের বিষয় মুখে মুখে স্বীকার করে কিন্তু বাস্তবে তারা তা মান্য করে না।
পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাতের অনুসারী ওলামা দেওবন্দের আকীদা হল, কোন মুজতাহেদ ইমামের অনুসরণ করা ওয়াজিব এবং যারা কোন ইমামের অনুসরণ করে না তারা কোরআন বিরোধী হওয়ার দ্বারা গোনাহগার হয়ে যায়।
ওলামা দেওবন্দ হযরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)এর অনুসরণ করেন এবং তার পক্ষ হতে বর্ণিত সকল বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আমলকারী হয়ে থাকনে।

৭. ওহাবীদের বিশ্বাস হল,
যারা তরীকতের ইমাম, যেমন
(১) হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহ.)
(২) হযরত ছিররী সাকতী (রহ.)
(৩) হযরত ইবরাহিম আদহাম (রহ.)
(৪) হযরত শিবলী (রহ.)
(৫) হযরত আব্দুল ওয়াহিদ বিন জায়েদ (রহ.)
(৬) হযরত বাহা-উদ্দিন নকশ্বন্দী (রহ.)
(৭) হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.)
(৮) হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)
(৯) হযরত শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ারদী (রহ.)
(১০) হযরত শায়েখ আব্দুল ওয়াহহাব শারানী (রহ.) সকলে গোমরাহ এবং এসব বুযুর্গগণের ব্যাপারে ওহাবীরা অত্যন্ত অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে থাকে।


পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাতের অনুসারী ওলামা দেওবন্দের আকীদা হল, উল্লেখিত ১০ জন বুযুর্গ কোরআন ও হাদীসের আলেম এবং আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত নেক বান্দা। যাদের দ্বারা বিশ্ববাসী ঈমান-ইসলাম পেয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে ধন্য হয়েছেন।

সুতরাং ওলামায়ে দেওবন্দ এসব বুযুর্গগণকে অত্যন্ত সম্মান ও মহব্বত করেন, তাদের ওয়াসিলায় দোয়া করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া সহজ হয় একথা বিশ্বাস করেন এবং দ্বীন ও ঈমানী বরকত হয় যা জরুরী বিষয়।

৮. ওহাবীদের বিশ্বাস হল,
মুসলমানদের সামান্য সামান্য ভুলের কারণে তাদেরকে কাফের ও মুশরিক বলা যায় এবং তখন মুসলমানদেরকে হত্যা করা ও তাদের ধন- সম্পদ লুন্ঠন করা বৈধ হয়ে যায়। যার প্রমাণ দেখতে হলে রদ্দুল মুহতার বা ফতোয়া শামী দেখুন।

পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাতের অনুসারী ওলামা দেওবন্দের আকীদা হল, কোন মুসলমানের আকীদা অথবা কোন কথার মধ্যে যদি ১০০টি ব্যাখ্যার অবকাশ থাকে এবং ৯৯টি কুফরী হয় আর একটি মাত্র ঈমানের পক্ষে হয় তাহলে তাকে কাফের বলা যাবে না ও তাকে হত্যা করা যাবে না এবং তার ধন-সম্পদ লুন্ঠন করা বৈধ হবে না।

বরং ওলামা দেওবন্দের মুরব্বী কুতুবুল ইরশাদ হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) আপন কিতাব ‘আনওয়ারুল কুলুবে’ বর্ণনা করেছেন, ফোকাহা কেরামের উপরোক্ত যেবাণীতে ১০০টি ব্যাখ্যার কথা বলা হয়েছে তা মূলত শুধু মাত্র ১০০টির মধ্যে সীমিত নয়। বরং যদি ১০০০ হাজার ব্যাখ্যার মধ্য হতে একটিও ঈমানের স্বপক্ষে থাকে তাহলে তাকে কাফের বলা যাবে না।

মোটকথা হল, ওয়াহাবীদের পক্ষ হতে আহলে সুন্নতের অনুসারী ওলামা দেওবন্দ ও তাবলিগী জামাতকে কাফের ফতোয়া দেওয়া হয়েছে এবং ওহাবীরা নিজেদের দোষ গোপন করার লক্ষে ওলামা দেওবন্দের বুযুর্গগণকে ওয়াহাবী বলে আখ্যায়িত করেছে।

সুতরাং এর উদাহরণ এমন হল, যেমন ময়লাকারীকে সাবান বলা হচ্ছে এবং দিন কে রাত বলা হচ্ছে। এসব ষড়যন্ত্রের মূল কারণ হল তৎকালীন ভারতবর্ষে ইংরেজ বৃটিশদের ও অন্যান্য কাফেরদের ঈমান- ইসলাম বিধ্বংসী আক্রমনকে শক্তিশালী করার জন্য মুসলমানদের মাঝে ফাটল ধরানো এবং বিভিন্ন জামাতে বিভক্ত করা ও মুসলিম একতার শক্তিকে দুর্বল করে দেওয়া
যা ছিল ইংরেজ কাফেরদের মূল উদ্দেশ্য।

(নকশে হায়াত ১২২-১২৬ পৃষ্ঠা)।

হে রাব্বে কারীম!! সকল কে হেদায়তের সঠিক পথের পথেয় করে দিন।