নারায়ণগঞ্জ হারাচ্ছে তার সোনালী অতীত

নিউজ ডেস্ক :

বাংলাদেশের অর্থকারী ফসল সোনালী আঁশ পাটকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে ‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’ হিসেবে পরিচিত ছিল নারায়ণগঞ্জ। কিন্তু সেই প্রাচ্যের ড্যান্ডিতে এখন আর পাটের দেখা মেলে না। একসময় শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর ঘেঁষে বিশ্বের সবথেকে উন্নতমানের পাটের চাষ হলেও সেটা এখন কল্পনাতীত।

শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর সেই তীর ঘেঁষে এখন গড়ে উঠেছে অসংখ্য কারখানা। ফলে আবাদি জমিগুলো এখন পরিণত হয়েছে অনবাদিতে। কালের বিবর্তনে নারায়ণগঞ্জ হারাচ্ছে তার সোনালী অতীত। তবে বরাবরই আশার বাণী শুনিয়ে আসছেন পাট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কৃষকদের পাটচাষে ফেরাতে তারা তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন।

নারায়ণগঞ্জ যেভাবে প্রাচ্যের ড্যান্ডি

পাট সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেপোলিয়নের সময়কার যুদ্ধের পর রাশিয়া থেকে লিনেন ও শনের আমদানি বন্ধ হওয়ার পর ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ড্যান্ডির উৎপাদকরা পাটের আঁশ থেকে সুতা পাকাতে বাধ্য হন। তখন পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশের ওপর কাঁচা পাট সংগ্রহের ভার পড়ে। সেই থেকে পাট ও পাটশিল্পের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জড়িয়ে পড়ে।

তখন নারায়ণগঞ্জে বিদেশি বণিক এবং এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাটের মহাজন ও ফড়িয়াদের আনাগোনাও বেড়ে যায়। এ জনপদ তখন পাট ব্যবসার কারণে মুখরিত হয় ওঠে। তখন নারায়ণগঞ্জের খ্যাতি ও গুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশের পাটের বাজারজাতকরণ কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এখানকার কাঁচা পাটের ওপর নির্ভর করে ইংল্যান্ডে এক নতুন শিল্পজগৎ গড়ে ওঠে।

পাট ব্যবসার সুখ্যাতির জন্য স্কটল্যান্ডের পাট ও লিনেন শিল্পের সুবিখ্যাত ড্যান্ডি শহরের সঙ্গে তুলনা করে তখন নারায়ণগঞ্জকে ‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি শহর’ বলা হতো।

পাট ছিল নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্য

পাট অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জের মূখ্য পরিদর্শক মো. এনায়েত হোসেন বলেন, আমি কৃষকের ছেলে। সারা বছর পাটশাক দিয়েই ভাত খেতাম। এখন তো প্রশ্নই আসে না। মাঝে মাঝে বাজারে পাটের শাক পাওয়া গেলেও সেগুলোর অনেক দাম। আমার একটি ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সে পাটগাছ দেখেইনি। এটা খুবই দুঃখজনক। পাট আমাদের ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে সব আবাদি জমিগুলো এখন অনাবাদি হয়ে গেছে। কিছু কিছু এলাকায় পাটের চাষ হলেও তা তুলনামূলক অনেক কম। পাটচাষ এখন একেবারেই কম।

দেখা মিলছে না পাটের

প্রাচ্যের ড্যান্ডির সূত্র ধরে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর ঘেঁষে ফতুল্লা, বন্দর, সোনারগাঁ, আড়াইহাজার ও রূপগঞ্জ এলাকায় বিভিন্ন রকমের পাটের চাষ হতো। কিন্তু বর্তমানে সেসকল এলাকায় পাটের চাষ একেবারেই নেই। নারায়ণগঞ্জ চলে গেছে এখন শিল্প এলাকার আওতায়।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জের কৃষি প্রকৌশলী মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, নারায়ণগঞ্জ এখন শিল্প এলাকা। এখনে পাটের চাষ এখন খুবই কম হয়। বক্তাবলী এলাকার একটি জায়গায় অল্প কিছু পাটের চাষ হয়। সে ধরনের কোনো পাটের চাষ এখন আর নেই। কিছু কিছু এলাকায় পাটের চাষ হলেও সেগুলো উল্লেখযোগ্য না।

পাট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, নারায়ণগঞ্জে নদীর পাড় ঘেঁষে অনেক গোডাউন ছিল। একসময় পাটের জমজমাট ব্যবসা ছিল এখানে। বিভিন্ন দেশ থেকে নদীপথে পাট কেনাবেচা হতো। সেটা এখন আর দেখা মেলে না। আড়াইহাজার সোনারগাঁ এলাকায় কিছু পাটের চাষ হলেও শহর বন্দরে নেই। রূপগঞ্জ হাউজিংয়ে চলে গেছে।

সেই সঙ্গে পাটের অনেক প্রতিকূলতা রয়েছে। ন্যায্য দাম না পাওয়া, সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় পাট পচানোর জন্য পানি পাওয়া যায় না। অনেক দূরে নিয়ে পাট পচাতে হয়। ফলে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আবার পাট পচানোর জায়গার অভাবে অনিহা চলে আসছে কৃষকদের মাঝে। কৃষকরা অন্যদিকে ঝুঁকছেন।

তবে পাট একেবারে নেই তা বলতে নারাজ পাট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন পাটের রেশিওটা অনেক কমে গেছে।

পাটের শত্রু পলিথিন

পাট অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জের মূখ্য পরিদর্শক মো. এনায়েত হোসেন বলেন, আসলে আমরা সাময়িক লাভবান হওয়াটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কিন্তু পরবর্তীতে কী হতে পারে তা আমরা চিন্তা করি না। আমরা এখন পলিথিনের দিকে ঝুঁকছি। যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আর এই পলিথিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাটচাষ কমে যাওয়ার একটা কারণ। পাটের মার্কেট দখলে নিয়েছে পলিথিন।

পাট ব্যবসায়ীদের হাহাকার ও সম্ভাবনা

পাটের এই দুর্দিনেও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসায়ী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা ধরে রাখার। তবে তারা শঙ্কায় রয়েছেন পাটের ভবিষ্যৎ নিয়ে। পাটের ব্যবসা সাধারণত বাকিতে হয়ে থাকে। তবে ব্যবসা চালু থাকলে তারা সেটা পুষিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু সেটা বন্ধ হয়ে গেলে তারা বিপদে পড়ে যান। ফলে অনেক ব্যবসায়ী নিজেদের গুটিয়ে নেন।

বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) সহকারী সচিব তারা শংকর রায় বলেন, সারা বাংলাদেশে প্রায় দেড় হাজার কাঁচাপাট ব্যবসায়ী ছিলেন। এর মধ্যে প্রায় ৩ শতাধিকই নারায়ণগঞ্জের। সেই সংখ্যাটা কমে আসতে আসতে এখন ২৫ থেকে ৩০ জনে নেমে এসেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারের ভ্রান্তনীতি ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পাট ব্যবসা থেকে তারা ছিটকে পড়েছেন। তবে তাদের সুযোগ সুবিধা দিলে পুনরায় পাট ব্যবসায় ফিরে আসার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছেন। বর্তমান সরকার সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

বর্তমান সরকার অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বে পাট ব্যবসার সম্প্রসারণসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খুবই আন্তরিক। এই আন্তরিকতার ভিত্তিতেই জাতীয় পাট দিবস ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) সিনিয়র সহসভাপতি আরজু রহমান ভূইয়া বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও ৭২ থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত পাটের সোনালী অধ্যায় ছিল। তৎকালীন সময়ে সারাবিশ্বে পাটের ব্যবহার ছিল। সুতার ব্যবহার ছিল। প্রাকৃতিক প্যাকেজিং ব্যবহারে আগ্রহী ছিল। কিন্তু ৯০ এর দশকের পরে পলিথিন ব্যবহারের কারণে বিশ্ববাজারে পাটের ব্যবহার কমে যায়। ফলে পাটের সোনালী দিন ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।

পরবর্তী পর্যায়ে শেখ হাসিনার সরকারের নেতৃত্বে আবার পাট পুনরায় ফিরতে শুরু করলো। কৃষকরা পাটের ন্যায্যমূল্য পাওয়া শুরু করে। পাট নিয়ে যে একটা হাহাকার ছিল সেখান থেকে পাটকে লাভজনক অবস্থানে নিয়ে আসা হয়। কৃষকদের কাছে পাট এখন লাভজনক ফসল।

কিন্তু পাকিস্তানের রেখে যাওয়া বড় জুটমিলগুলো পরিচালনায় ও বয়সের ভারে যন্ত্রপাতি পুরাতন হয়ে যাওয়ায় লোকসানে পরিণত হয়। শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধি পায়। পাট রপ্তানির জন্য পাট বাধাইয়ের ২৪ ফ্রেশ হাউজের মধ্যে বর্তমানে ৪টি চলছে বাকি ২০টি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বাধ্যতামূলক মোড়ক আইন চালু হওয়ায় পাটের বাজার এখন ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের উপপরিচালক ড. নুর জাহান বলেন, আমাদের অঞ্চলে পাট খুব কম পরিমাণ চাষ হয়। আসলে এখন কৃষকরা পাটচাষে আগ্রহী না। তবে ইদানিং কিছুটা বেড়েছে। আমাদের প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে। আশা করি সামনে আরও বাড়বে।

পাটচাষের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। দিন দিন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে ৩১২ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হচ্ছে। সেইসঙ্গে এ সকল জমিতে পাট উৎপাদন হচ্ছে ৭৬৫ মেট্টিক টন।

পাটের সম্ভাবনার কথা জানান দিয়ে পাট অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের মূখ্য পরিদর্শক মো. এনায়েত হোসেন বলেন, এখন পাটের দাম বেড়েছে। যার কারণে কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ বাড়তে শুরু করছে। এটার মূল ভূমিকায় রয়েছে কৃষক। কৃষকরা যদি লাভবান হয় তাহলে অটোমেটিক বেড়ে যাবে। কৃষকদের সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য ৫ বছর মেয়াদী ‘উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর পাট ও পাটবীজ উৎপাদন এবং সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সেই প্রকল্পের কার্যক্রম বর্তমানে ৪৬টি জেলার ২৩০টি উপজেলায় বিস্তৃত করা হয়েছে।

সেইসঙ্গে পরিবেশ রক্ষা ও পাটপণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন করা হয়েছে। এই আইনের অধীনে তফসিলভুক্ত ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, আটা, ময়দা, তুষ-খুদ-কুড়া, পোল্ট্রি ফিড ও ফিস ফিডসহ ১৯টি পণ্য মোড়কীকরণে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই আইন কার্যকর করা হলে পাটের চাহিদা বাড়বে। পাটের দামও বাড়বে। ফলে কৃষকদের মধ্যে পাটের আবাদও বাড়বে।

তিনি আরও বলেন, আশা করি আরও পণ্য বাড়বে। পাট দিয়ে অনেক আকর্ষণীয় পণ্য তৈরি হয়। পণ্য বাড়লে পাটের সুদিন ফিরে আসবে। প্রায় আড়াইশত রকমের পণ্য তৈরি হয় পাট থেকে। যা কল্পনাও করা যায় না। এসব পণ্যের ব্যবহার বাড়লে আশা করা যায় পাটের সুদিন ফিরে আসবে। তবে এসকল পণ্যের প্রচারণার প্রয়োজন। প্রচারণা করতে পারলে মানুষের মধ্যে এমনিতেই আগ্রহ বাড়বে।