নিয়তি : ক্ষুদীরাম দাস

ছোট গল্প
নিয়তি
লেখক :  ক্ষুদীরাম দাস

এক.
তিমন বাজারের থলেটা রান্নাঘরে রেখে বাজার বিছানার কাছে আসলো। তিমনের বাবা গত দশ বছর যাবত শয্যাশায়ী। প্যারালাইড রোগী। এই এক যাতনাময় জীবনযাপন! অন্যের সাহায্য ছাড়া দু’চোখ ভরে বাইরের জগৎ তার দেখা হয় না। চব্বিশ ঘন্টা তার জন্যে একজন থাকতেই হবে। তাছাড়া তার আরো অন্যান্য সমস্যা তো রয়েছেই। প্রতিমাসে অনেক ঔষধ তার প্রয়োজন। অপরদিকে তিমনের মায়েরও শারীরিক সমস্যা। মায়ের চিকিৎসার জন্যেও প্রচুর টাকা প্রতিমাসে তিমনকে খরচ করতে হয়। তিমনের ভাগ্য ভালো যে, একটি সরকারি চাকুরি কপালে জুটেছে। প্রতিমাসের বেতনে অন্তত চিকিৎসার খরচটা চালিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে। চাকুরিটা না থাকলে তিমনের কপালে দুঃখ ছিলো। মা-বাবাকে অনেক আগেই হারাতে হতো। একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে শয্যাশায়ী বাবার বিছানার পাশে গিয়ে বসলো তিমন। তারপর বাবাকে বললো ঃ বাবা, তুমি আমাকে কী জানি বলতে চেয়েছিলে!

একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়লো তিমনের বাবা। তিমন পরিস্কার বুঝতে পেরেছে এই দীর্ঘশ^াস কষ্টের দীর্ঘশ^াস। বাবা দু’টি চোখে তিমনের শরীরের দিকে তাকলো। তারপর দু’চোখে চোখ রেখে করুণার দৃষ্টিতে কিছু সময় তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে। তিমনের বাবা ভাবলো, এমন একটা নির্মম কথা বাবা হয়ে ছেলেকে কীভাবে জানাবে! কিন্তু তাকে তো বলতেই হবে। না বলেও তো উপায় নেই। তিমনের বাবা ইশারায় পানি খেতে চাইলো। তিমন এক গøাস পানি বাবার জন্যে এগিয়ে দেয়। পানি খাওয়ার পর তিমন বললো ঃ তুমি আমাকে কী জানি বলতে চেয়েছিলে! এখন বলতে পারো। তাড়াতাড়ি বলে ফেলো। আমাকে আবার ডিউটিতে যেতে হবে।

বাবা ঃ থাক, তিমন! বাবা, তোমাকে এই কথাটা আরেকদিন বলবো।
তিমন ঃ কোনো সমস্যা নেই। তুমি বলতে পারো।
তিমন মনে করলো, বাবা হয়তো তাকে বিয়ে করার কথা বলবে। কিন্তু বিয়ের বয়স হলেও বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তারপর সে আবার তার বাবাকে বললো ঃ তুমি নিঃসংকোচে আমাকে বলতে পারো।

বাবা ঃ তিমন শুন, আমি তো আর বেশিদিন বাঁচবো না। তুমি আমাকে তোমার পরিশ্রমের টাকায় অনেকদিন চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে রেখেছো। আমার মনে হয়, তোমার আর আমার জন্যে চিন্তা করার দরকার নেই। মানে, আমাকে আর চিকিৎসা করানোর দরকার নেই। তুমি আর টাকা নষ্ট করো না। তাহলে হয়তো তুমি একদিন দেখবে, তোমার জন্যে কিছুই থাকবে না। তুমি নিঃশ^ হয়ে যাবে। আমি বাবা হয়ে তোমার এভাবে কষ্ট দেখতে পারছি না। আমি বুঝতে পারছি যে, আমার আর তোমার মায়ের জন্যে চিকিৎসা করতে করতে তোমার চাকুরির সমস্ত টাকা শেষ হয়ে যায়। তার উপর যে সম্পত্তি ছিলো, তাও বিক্রি করতে হয়েছে চিকিৎসার জন্যে। আর তো কিছুই রইলো না। আমি আর বাঁচতে চাই না। তুমি চিকিৎসা করানো বন্ধ করে দাও।

তিমন বাবার মুখের এসব কথা স্তব্ধ হয়ে গেলো। সে বাবার চোখের জল মুছতে মুছতে বললো ঃ এভাবে বলতে হয় না বাবা। তোমাদের জন্যে যদি এই টুকু আমি না করতে পারি, তাহলে ছেলে হয়ে আমার কী মূল্য রইলো! তাছাড়া যে ক’টা দিন বেঁচে থাকবে, অন্তত ভালোভাবে তো তোমাদের বাঁচতে হবে। তোমাদের সেবা করার এটাই তো আমার সুযোগ। এই সুযোগ সবাই পায় না। আর টাকা পয়সা হলো, এই টাকা থাকবে; আর এই টাকা থাকবে না। আমার জন্যে তোমাদের ভাবতে হবে না। তাছাড়া তোমাদের জন্যে যদি আমি চিকিৎসা না করি, তাহলে লোকে আমাকে নিন্দা করবে। আত্মীয়স্বজন তো আমাকে ভালো চোখে দেখবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তোমরা আমার মা বাবা। তোমাদের জন্যে আমি সেবা না করলে কে তোমাদের দেখবে?
বাবা ঃ তুমি তোমার কথা বলছো। আমি ভাবছি, তোমার ভবিষ্যতের কথা। আমি তো এভাবে বাঁচতে পারবো না। তোমার মাও জটিল রোগে ভুগছে। সেও বেশি দিন বাঁচবে না। এটা আমাদের জানা হয়ে গেছে। সুতরাং আমাদের চিকিৎসা করানো অযথাই টাকার অপচয় করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

তিমন ঃ এটা তোমাদের মনের ভুল ধারনা।

বাবা ঃ না রে বাবা, এটাই বাস্তব! আমি আর কোনোদিন ঔষধ খাবো না। যে ক’টা দিন এভাবে বাঁচতে পারি সেটাই ভালো। এমনিতে তোমার জন্যে জীবনে কিছু করতে পারিনি। তার উপর তোমার জীবন নষ্ট করা আমাদের অধিকার নেই।

তিমন উঠে দাঁড়ালো। আর বললো ঃ এভাবে কোনো কথা বলো না। আমার শুনতে মোটেও ভালো লাগে না। আমি তোমাদের জন্যে ঔষধ এনেছি, খেয়ে নিও।

দুই.
অনেকদিন পর রেখা তিমনকে কলেজে আসতে বলেছে। আজ রেখা তার মনের চুড়ান্ত কথা জানিয়ে দেবে। এদিকে তিমন মনে মনে খুশিই হলো। যদি রেখা রাজি হয়তো তার জীবনের জন্যে খুবই ভালো হবে। তাছাড়া রাজি না হয়ে যাবে কোথায়, তিমন সরকারি চাকুরি করে, অনেক টাকা বেতন পায়; যদিও বর্তমানে সব টাকা মা বাবার পেছনে চিকিৎসার জন্যে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ভবিষ্যতে তো তার জীবনের জন্যে ভালোই হবে। তিমন রেখাকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে যায়। তিমন বললো ঃ কেমন আছো?

রেখা ঃ এই তো ভালো আছি।
তিমন ঃ তোমার কথাবার্তা কেমন জানি অন্য রকম লাগছে। তুমি কি কোনো বিষয়ে চিন্তিত? নাকি কোনো ঘটনা ঘটেছে।
রেখা ঃ সে রকম কিছুই হয়নি। আমি তোমাকে ডেকেছি একটা কথা বলার জন্যে।
তিমন ঃ কী কথা বলতে পারো।
রেখা ঃ মা-বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন।
তিমন ঃ মানে তুমি এসব কী বলছো?
রেখা ঃ আমি ঠিকই বলছি।
তিমন ঃ তারপর?
রেখা ঃ তারপর আর কী?
তিমন ঃ তুমি কি রাজি হলে?
রেখা ঃ আমি এখনো কিছুই বলিনি।
তিমন ঃ তাহলে কী বলার চিন্তা করলে?

রেখা ঃ যেহেতু মা বাবা বিয়ে ঠিক করেছেন, তাদের মনে তো আর আমি কষ্ট দিতে পারি না। ভাবছি, রাজি হয়ে যাবো।
তিমন ঃ এসব তুমি কী বলছো? আমার তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?
রেখা ঃ আমি মোটেও মজা করছি না। আমি যা সত্যি তাই বলছি।
তিমন ঃ তাহলে তুমি কেনো আমাদের সম্পর্কের কথা বলনি?
রেখা ঃ বললে কী হতো?
তিমন ঃ কী হতো মানে?
রেখা ঃ তারা কী রাজি হতো তোমার কাছে আমাকে বিয়ে দিতে?
তিমন ঃ কেন রাজি হবে না?
রেখা ঃ তুমি কি আসলেই কিছুই বুঝনা।
তিমন ঃ আমি তো এখন কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমাকে আমি কী বলবো?
রেখা ঃ আমার বলার কিছুই ছিলো না।
তিমন ঃ তাহলে আমাদের দীর্ঘদিনের প্রেম-ভালোবাসার কী হবে? সেসব কী সবই মিথ্যে হয়ে যাবে? ভালোবাসার কী কোনো মূল্য নেই।

রেখা ঃ ভালোবাসার মূল্য আছে।
তিমন ঃ তাহলে তুমি মূল্য দিলে কোথায়?
রেখা ঃ বাড়িতে তোমার সমস্যা আছে।
তিমন ঃ কী সমস্যা?
রেখা ঃ তোমার মা বাবা দু’জনই তো–

তিমন ঃ বুঝতে পেরেছি। সেজন্যে তুমি ভালোবাসার জোর নিয়ে তোমার মনের কথা বলতে পারোনি। এখানেই ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে। এ রকম ঘটনাতো তোমার পরিবারেও হতে পারতো। মানুষের কী রোগ হয় না? মানুষ কী অসুস্থ হয় না। চিরদিন মানুষের তো এক রকম যায় না। তাহলে তুমি আমার মা-বাবার অসুস্থতার কারণে ভালোবাসাকে জলাঞ্জলি দিলে। তারা অসুস্থ বলে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো?
রেখা ঃ তাহলে আমার কী করার ছিলো?

তিমন ঃ বুঝতে পেরেছি। একদিকে দক্ষিণা হাওয়া, অন্যদিকে জোয়ার। সুতরাং নৌকা তোমার সমানতালে চলছে তোমার ইচ্ছামতো। এখানে তোমার বাধা দেয়ার কিছুই নেই। তীরে আমি দাঁড়িয়ে আছি। সেদিকে তোমার খেয়াল নেই। দোষ দিচ্ছ জোয়ার, আর বাতাসের। বলছো এখন, তোমার কিছুই করার নেই।
রেখা ঃ আমার কিছুই করার নেই। আমার তো একটা জীবন আছে। তাছাড়া আমি এটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছি যে, আমার মা-বাবা কেনোভাবেই রাজি হবে না।
তিমন ঃ তাহলে আমি কি তাদের সাথে কথা বলবো।
রেখা ঃ পাগল নাকি?
তিমন ঃ আরে-তুমিই তো আমাকে পাগল করে দিয়েছো।
রেখা ঃ এটা আমার জীবন। আমার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে।
তিমন ঃ একমাত্র স্বার্থপরের এভাবে বলতে পারে।
রেখা ঃ আমি স্বার্থপর নই। আমি বাস্তববাদী। তুমি যদি তোমার মা বাবাকে ছেড়ে দিতে পারো, তাহলে আমি তোমাকে—
তিমন ঃ বিয়ে করতে পারবে-এই তো। বেশ ভালোই বলেছো। কিন্তু আমি আমার মা-বাবাকে কোনো মতেই অস্বীকার করতে পারবো না। আমার মা-বাবা সবার উপরে। তোমার মতো মেয়েকে আমি বিসর্জন দিতে পারি। কিন্তু আমার মা বাবাকে আমি ছাড়তে পারবো না।
রেখা ঃ ঠিক তেমনি আমিও সে রকম ভাবেই চিন্তা করি।
তিমন ঃ ভাবছিলাম তোমাদের বাড়িতে যাবো এবং তোমার মা-বাবার সাথে কথা বলবো–
রেখা ঃ যাওয়ার দরকার নেই। কথা বলার দরকার নেই আমার মা-বাবার সাথে।
তিমন ঃ আসলে তোমারই ইচ্ছে নেই।
রেখা ঃ এটা তো পরিস্কার তোমার বোঝা উচিত।
তিমন ঃ এখন বুঝতে পারছি! যাও তুমি!

এই বলে তিমন রেখার কাছ থেকে চলে গেলো। সে সিদ্ধান্ত নিলো, আর কোনোদিন রেখার সাথে দেখা করবে না। এমনকি তার সাথে কথাও বলবে না। ফিরেও তাকাবে না। এমন স্বার্থপর মানুষদের সাথে কথা না বলাই ভালো। এ ধরনের স্বার্থপরের রং বদলায় সময়ের প্রয়োজনে। তিমন হেঁটে চলে বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রতিটা নিঃশ^াস তার কাছে অসহ্য লাগছে। প্রতিটি পদক্ষেপ তার কাছে কষ্টের। তিনি ভাবে, মানুষ কেনো এতো খারাপ হতে পারে?

তিন.
তিমনের বস তিমনকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসে। কারণ, সে কাজে যথেষ্ট ভালো ছিলো। তিমনের মন খারাপ দেখে বললো ঃ তোমাকে আজ জানি, কেমন কেমন লাগছে। তোমার কী মন খারাপ?
তিমন ঃ তেমন কিছু নয়।
বস ঃ বাড়িতে তোমার মা বাবা এখন কেমন আছেন?
তিমন ঃ আগের মতোই। মোটেও উন্নতি নেই। উন্নতি হবার কথাও নয়। এভাবেই আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।
বস ঃ আমার মনে হয় তোমার এখন একটা বিয়ে করা দরকার।
তিমন ঃ আমিও ভাবছি তাই।
বস ঃ তাহলে বিয়ে করছো না কেনো?
তিমন ঃ আমি তো বিয়ে করতেই চাই। অন্তত মা বাবাকে দেখবে সে রকমই কোনো মেয়ে চাইছি।
বস ঃ তোমার তো এক মেয়ের সাথে রিলেসন আছেই। তার কি এখনো বিয়ের বয়স হয়নি?
তিমন ঃ ঐ মেয়ে বিয়ের জন্যে রাজি নয়।
বস ঃ কেনো?
তিমন ঃ আমার মা বাবার জন্যে।

বস ঃ ও বুঝতে পেরেছি। এটা কী ধরনের চিন্তা! দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? মানুষ মানুষকে এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে পারে? তাও আবার ভালোবাসা বলে কথা। প্রতিটা মা বাবাই প্রত্যাশা করে তাদের ছেলেমেয়েকে বিয়ে দিয়ে সুখী হতে। কিন্তু তোমার মা বাবা সেই সুখটা পেলো না। বড় হতাশার বিষয়!

ঠিক সেই মুহূর্তে অনিল বাবু অফিসের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বস, ইশারায় তাকে ভেতরে আসতে অনুমতি দিলেন। ইশারা দিলেন যেন অনিল বাবু সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসেন। এরপর বস ইশারা দিয়ে তিমনকে দেখালেন। তাকে বোঝালেন যে, আমি যে ছেলেটির কথা বলেছি, সেই ছেলেটিই। এরপর তারা দু’জন অফিস থেকে বের হয়ে আসলেন, বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন বলে।
অনিল বাবু আগবাড়িয়ে বললেন ঃ দাদা, আমার ভাইয়ের বেটি, একেবারে সহজ সরল মেয়েটি। কিন্তু ছেলেটি তো দেখতে ভালোই। আমার কিন্তু পছন্দ হয়েছে।
বস ঃ তাহলে তো ভালো কথা। তবে দাদা—
অনিল বাবু ঃ তবে কী দাদা!
বস ঃ আপনাকে কিছু কথা জানিয়ে রাখা ভালো।

অনিল বাবু ঃ কী কথা আমাকে বলবেন। আমাকে কোনো কথাই বলতে হবে না। ছেলেটি আপনার অফিসে দীর্ঘদিন কাজ করছে। আপনি তাকে ভালো করেই চিনেন, জানেন। সুতরাং আপনার উপর আমি কোনো কিছুই বলতে চাই না। কারণ, আমি আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করি ও মান্য করি। আপনি যা’ বলবেন তাই হবে।
বস ঃ আমি বলছি অন্য কথা!

অনিল বাবু ঃ কী কথা?
বস ঃ যা আপনার শোনা দরকার। এরপর আপনি বিবেচনা করে দেখবেন। আপনার যদি মন চায় তাহলে আমি ছেলেটির সাথে আপনার ভাইয়ের বেটির বিয়ে দিতে পারেন। তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার কথাগুলো আপনার শোনা দরকার।
অনিল বাবু ঃ ছেলেটি সম্পর্কে?
বস ঃ হ্যাঁ!
অনিল বাবু ঃ ছেলের কোনো দোষ আছে?
বস ঃ সে রকম কিছুই নয়। ছেলেটি অন্তত ভালো। তার কোনো সমস্যা নেই। আপনি একটা ছেলে পাবেন। তবে আপনি পরিবার পাবেন না।
অনিল বাবু ঃ তার মানে–?

বস ঃ যদিও সে একমাত্র ছেলে। তার কোনো ভাই-বোন নেই, তবুও সে পরিবারগতভাবে সুখী নয়। তার মা বাবা দু’জনই অসুস্থ। ছেলের বেতনের সমস্ত টাকা মা বাবার পেছনেই খরচ করে। কোনো টাকা তার কাছে থাকে না। এতো টাকা বেতন পায়, তবুও দারিদ্রতা তার পেছনে লেগেই আছে। অভাব তার পেছনেই আছে। আমি গত বেশ কয়েক বছর ধরে তার অবস্থা জানি। তার মা বাবা দু’জনেই বয়স্ক। জটিল রোগে আক্রান্ত। তবে বেশিদিন বাঁচবে বলে মনে হয় না ছেলেটির বাবা। কিন্তু সেটা বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হলো-তার মা বাবাকে দেখার মতো একটা মানুষ দরকার। সেই কারণ তার মা বাবাও চাইছে যেন তিমন বিয়ে করে। কিন্তু সে রকম কোনো মেয়েকেই সে পাচ্ছে না। আর ছেলেটির একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কও ছিলো দীর্ঘদিনের। মেয়েটিও তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলো। এতে ছেলেটি খুবই দুঃখ পেয়েছে। মনে বড় আঘাত পেয়েছে। সে আমাকে জানিয়েছে, আর নাকি বিয়েও করবে না। মা বাবার জন্যে জীবন উৎসর্গ করবে। তবে আমি মনে করি, এটা হয়তো তার রাগের কথা। বিয়ে হলে হয়তো সবই ঠিক হয়ে যাবে।

অনিল বাবু ঃ তাহলে আপনার এই কথাগুলো আমার পরিবারের সাথে শেয়ার করে দেখি। তারা একটু চিন্তা করুক। কারণ, আমার একার বিষয়তো নয়। অন্তত বিয়ে বলে কথা, চিরজীবনের কথা।
বস ঃ আপনি অবশ্য ঠিকই বলেছেন। চলুন, অফিসে গিয়ে বসি।

চার.
তিমনের দিনগুলো এভাবেই কেটে গেলো, কেটে গেলো কয়েকটি মাস। একদিন তিমন অফিস থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। অন্যান্য দিনের মতো তার মনটা আজও খুবই খারাপ। দুঃখের কাহিনী যদি কারো জীবনে ছায়ার মতো লেগে থাকে, তার মুখে হাসি দেখা যাবে কীভাবে? তিমনের জীবনটা কি সে রকম নয়? তিমন যখন একা একা থাকে, তখন তার কাছে চারিদিক শূন্য মনে হয়। মনে হয় সাগরের মাঝখানে সে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। আর বাঁচার জন্যে মনটা প্রতিনিয়ত ছটফট করছে। কোনো কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। এক টুকরো কাঠও নেই যে, সেটি ধরে অন্তত বেঁচে থাকবে। পেছন থেকে সাইকেলের ক্রিং ক্রিয় আওয়াজ শুনে সাইকেলকে সাইড দিতে রাস্তার পাশ দিয়ে তিমন হাঁটছে। সাইকেল থেকে নেমে তিমনের এক বন্ধু সামনে এসে দাঁড়ালো। আর অতি উৎসাহের সাথে বললো ঃ কেমন আছিস্ বন্ধু?

তিমন ঃ এই তো যেমন থাকার কথা। সৃষ্টিকর্তা যেমন রেখেছেন।
বন্ধু ঃ তোকে দুঃসংবাদ দিতে ইচ্ছে করে না। তবুও তোকে দিতে হচ্ছে।
তিমন ঃ চিরজীবন তো দুঃসংবাদই পেয়ে আসছি। সুসংবাদ পাওয়ার মতো সুযোগ আমার কপালে নেই। দুঃখের সাগরে ভেসে চলা আমি, কোনোদিনই সুখের দেখা পাবো কি না জানি না।
বন্ধু ঃ এতোদিনের ভালোবাসা সেই রেখার আজ গায়ে হলুদ।


কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিমনের মনটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। দু’পা যেন সামনের দিকে এগুতেই চাইছে না। তিমনের মুখ দিয়ে আর কোনো কথাই বের হচ্ছে না। ভেতরটা ফেঁটে খান খান হয়ে যাচ্ছে। তবুও দীর্ঘশ^াস ছেড়ে তিমন মুখে হাসি দিয়ে বললো ঃ আমার কোনো সমস্যা নেই। সে যেরকম ভাবে থাকতে চায়, সে তো তাই করবেই। হয়তো অনেক মানুষই তাই করে। সবার যুক্তি এক রকম হয় না।

সে হয়তো তার যুক্তিতে ঠিক; আর সে আমাকে ছেড়ে সুখে হতে পারবে বলেই আমাকে ত্যাগ করেছে। সময়ের প্রয়োজনে মানুষকে কি মানুষকে ছেড়ে দেয় না? বিবাহিত জীবনও তো নষ্ট হয়ে যায়। স্ত্রী তার স্বামীকে ছেড়ে, নিজের বুকের ধন সন্তানকে ছেড়ে অন্যের হাত ধরেও তো সে চলে যায়। আবার অনেক ভালো স্বামীরাও তাই করে। সবই সময়ের প্রয়োজনে। স্বার্থের কারণে হতে পারে, যে কোনো সমস্যার কারণেও হতে পারে। তবে আমি চাই, সে ভালো থাকু। আমি এই প্রত্যাশাই করি।

বন্ধু ঃ তোর জীবনে এ রকম হতে পারে, আমি ভাবতেও পারি না।
তিমন ঃ সে যদি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে, তাহলে আমি কেন তাকে ভুলে থাকতে পারবো না?
বন্ধু ঃ এটা তোমার মনের কথা নয়।
তিমন আর কোনো কথাই বললো না। নিজেকে বড় অদ্ভুত লাগছে। কীভাবে অনায়াসে বন্ধুকে এভাবে মিথ্যা কথা বলতে পারলো। অথচ তার হৃদয়টা পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে। চোখের জল আর ধরে রাখতে পারছিলো না যেন। চোখে মুখে তার স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, ভেতরে তার আগুন জ¦লছে। তিমন বন্ধুকে বললো ঃ চল, আমাদের বাড়িতে চল।
বন্ধু ঃ চল, অনেকদিন হয় তোদের বাড়িতে যাই না। আংকেল আর আন্টিকেও দেখিনি অনেকদিন হয়েছে।

ওরা দু’জন একসাথে হেঁটে চলেছে। দূর থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, দূরে তিমনদের বাড়ির দিক থেকে হৈ চৈ শব্দ। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, কিছু লোক ছোটাছুটি করছে। কিন্তু কী কারণে ছোটাছুটি করছে সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তিমন তার বন্ধুকে নিয়ে আরো জোরে হেঁটে চলেছে। কয়েকজন যুবক দৌঁড়ে তিমনের দিকেই আসছে। তিমনও বাড়ির দিকে দৌঁড় দিলো। ওরা কাছে এস হাঁফাতে হাঁফাতে বললো ঃ তিমন ভাই, তোমার বাবার অবস্থা মোটেও ভালো নয়। মনে হয়–

তিমন তার কথা শোনার আগেই আরো জোরে দৌঁড় দিলো বাড়ির দিকে। কিছু লোক তিমনের বাবাকে ভেনগাড়িতে উঠালো। আর তিমনের বাবা বলতে লাগলো ঃ আমি বাঁচতে চাই না, তোমরা আমাকে হাসপাতালে নিও না।

কিন্তু তবুও লোকজন তাকে ভেনগাড়িতে উঠালো। আর তিমন ও তার বন্ধু তাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হলো। যাওয়ার পথে রেখাদের বাড়ির পাশ দিয়েই তিমনদের যেতে হলো। তাদের বাড়ি থেকে কিছু লোকও ভেনগাড়ি দেখে ছুটে এলো। তারাও তিমনের সাথে তার বাবাকে বাঁচানোর জন্যে হাসপাতালে যাওয়ার জন্যে আসলো।

তিমন শুনতে পেলো রেখার গায়ে হলুদে, তাদের বাড়ির লোকজন অনেক আনন্দ করছে। আর তিমন তার বাবাকে বাঁচাতে কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালের দিকে ছুটলো। নিয়তি বড়ই অসহায় করে দিলো তিমনকে! ভেনগাড়ি ছুটে চলেছে হাসপাতালের দিকে।

————— সমাপ্ত ——-