কুমিল্লা কারাগারে বন্দী নির্যাতন: তিন সদস্যের কমিটির তদন্ত শুরু

কারারক্ষী অতিউৎসাহিত হয়ে একাজটি করেছে- সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান
আদালতের অনুমতি ছাড়া কারাগারে কয়েদীদের শাস্তির বিধান নেই- আইনজীবী

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল, কুমিল্লা ব্যুরো: ০৪ জুলাই ২০২১
কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী নির্যাতনের ঘটনায় অবশেষে তদন্ত শুরু করেছে তিন সদস্যের কমিটি। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কুমিল্লা কেন্দ্রিয় কারাগারের এক ভারতীয় বন্দীকে নির্যাতনের ঘটনায় নড়েচড়ে বসে কারা কর্তৃপক্ষ। কুমিল্লা কেন্দ্রিয় কারাগারের অভ্যন্তরে এই ঘটনাটি গেলো ১২ মে’র হলেও এটি প্রকাশ হয় ৩ জুলাই শনিবার।

৫ মিনিট ৪ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায় কারাগারের ভেতরে শাহজাহান বিলাশ নামের ওই বন্দীকে দুই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হচ্ছে। মেঝেতে ফেলে পেটানোর সময় তাকে ঘিরে রয়েছেন কয়েকজন কারারক্ষী।

এদিকে এ নির্যাতনের ঘটনায় কারারক্ষী দিদারুল আলম এর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ। অন্যদিকে মোবাইল ফোনের কথোপকথনের রেকর্ড সংগ্রহের মাধ্যমে সিটি টিভির ফুটেজ বাইরে পাঠানোর সাথে জড়িত দুজনকে সনাক্ত করেছে কারাগার কর্তৃপক্ষ।

তারা হলেন, কারারক্ষী অনন্ত চন্দ্র দাশ এবং চরণ চন্দ্র পাল। সিটি টিভির ফুটেজ পাচার করে কারাগারের ভেতরের গোপনীয়তা প্রকাশের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এই দুই কারারক্ষীকে। তবে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সহকারী প্রধান কারারক্ষী শাহনেয়াজ আহমেদ, কারারক্ষী দিদারুল আলমসহ অভিযুক্তদের বিষয়ে চুরান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলেও জানান সিনিয়র জেল সুপার। একি সূত্রে জানা যায়, বরখান্তের খবর শুনে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন কারারক্ষী অনন্ত চন্দ্র দাশ। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো: আসাদুর রহমান জানান, কয়েদী শাহজাহান বিলাশ চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল মাসে তিনি ১২ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, এক পুড়িয়া গাঁজা এবং নগদ ৬০০ টাকাসহ কারারক্ষীদের হাতে ধরা পড়েন। পরদিন ১৭ এপ্রিল তাকে আলাদা সেলে পাঠানো হয়।

সেল পরিদর্শনে গেলে শাহজাহান সেলে থাকতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং তাকে অন্য বন্দীদের মতো রাখার দাবি জানান। এরপর ১২ মে তাকে কারা অভ্যন্তরে কেস টেবিলের সামনে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ। কেস টেবিলে আনা হলে সে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে।

জেলার মো: আসাদুর রহমান বলেন, আসলে ওই বন্দিকে বেধড়ক পেটানো হয়নি। সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদেও উপস্থিতিতেই ওই বন্দী লোহার দরজায় নিজের মাথা দিয়ে আঘাত করেতে থাকে। তার উশৃঙ্খল আচরণ থামাতে রক্ষীরা লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। এতে তার কোন সমস্যা হয়নি বলেও দাবি করেন জেলার।

অথচ ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে বন্দী বিলাসের দুই হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে মাটিতে ফেলে তাকে বেধড়ক পেটানো হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই নির্যাতনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে কারা হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

এদিকে, রোববার বিকেলে কুমিল্লা কেন্দ্রিয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ এর সাথে মোবাইল ফোনে কথা হয়। বন্দী নির্যাতনের বিষয়টি কারা আইনের পরিপন্থী কি না প্রতিবেদকের এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদিও আমাদের কারারক্ষী (দিদারুল আলম) একটু অতি উৎসাহিত হয়ে এ কাজটি করে ফেলেছে। ওরাতো ইমোশনাল থাকে, আমি নিষেধ করার পরও সে কয়েকটি বারি (আঘাত) দিয়ে ফেলেছে। ওই লোকটিও (কয়েদী) নিজে থেকেই এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলো। তবে, জেল কোডের বিধান অনুযায়ী যখন কোনো বন্দী কারাগারে অস্বাভাবিক আচরণ করে কিংবা কোনো বন্দী যদি নিজেই নিজের মাথা ফাটিয়ে ফেলতে চায় তখন তাকে নিবৃত্ত করতে, কিংবা কারাগারে বড় ধরণের দূর্ঘটনা এড়াতে কয়েদীদের উপর লঘু শাস্তি দেয়া যায়।

তিনি আরও বলেন, ওই কারারক্ষীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে।

ফুটেজ পাচারকারী দুই কারারক্ষীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও নির্যাতনকারী কারারক্ষীকে কেন সাময়িক বরখাস্ত করা হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ঘটনাটি এতোবড় মোড় নেবে তখনতো আমরা বুঝতে পারিনি। ঐসময়তো তার বিরুদ্ধে সাধারণ ঘটনা হিসেবে একটা বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম। সুতরাং এখন তদন্ত ছাড়া নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারিনা। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তীতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কুমিল্লা দায়রা জজ আদালতের এসিসটেন্ট পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) সৈয়দ তানভীর আহমেদ ফয়সাল বলেন, আমরা জেনেছি মাদক রাখার অভিযোগে ওই বন্দীকে নির্যাতন করা হয়েছে। কেননা কারাগারের ভেতরে কাদের হাত হয়ে একজন বন্দীর হাত পর্যন্ত মাদক দ্রব্য পৌছায় আগে তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। তা না করে বন্দীকে শাস্তি প্রদানের বিষয়টি হাস্যকর।

তিনি বলেন, তার পরও যদি কারা কর্তৃপক্ষ মনে করেন যে, কারাগারে কোনো কোনো বন্দীর আচরণ শাস্তিযোগ্য তাহলে যথাযথ আদালতের মাধ্যমে কিংবা জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বাধীন কারা পরিদর্শন কমিটিকে অবহিত করার মাধ্যমেই ওই বন্দীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

কুমিল্লা কেন্দ্রিয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ জানান, এ নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগ এবং কারা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নজরে এলে ঘটনার তদন্তে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খানকে প্রধান করে তিন সদস্যের এতদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির অন্য দুজন হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারের জেল সুপার ইকবাল হোসেন ও ফেনী জেলা কারাগারের জেলার শাহাদত হোসেন মিঠু।

এ ঘটনায় তিন সদস্যের কমিটি তদন্ত শুরু করেছে বলেও জানান সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ।

ঘটনার তদন্তে রোববার সকাল থেকেই কমিটির সদস্যরা কুমিল্লা কেন্দ্রিয় কারাগারে আসেন এবং এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত রোববার বিকেলেও কমিটির সদস্যরা কুমিল্লা কেন্দ্রিয় কারাগারে তদন্ত কাজ পরিচালনা করছিলেন।

উল্লেখ্য যে, ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরা রাজ্যের দুর্গাপুর গ্রামের আবদু মিয়ার ছেলে শাহজাহান বিলাশ (কয়েদি নম্বর-৭১৫১/এ) ডাকাতি ও হত্যা মামলার ৫৮ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কুমিল্লা কেন্দ্রিয় কারাগারে কয়েদী হিসেবে বন্দী রয়েছেন বিগত ২৬ বছর ধরে।