ক্ষুদীরাম দাসের গল্প : পথের মানুষ

রাজীব হোটেলে ঢুকে সিঙ্গারা পুরি খেয়ে বের হয়ে আসলো। বাইরে সুন্দর বাতাস বইছে দেখে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আনমনে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। পকেটে হাত ঢুকিয়ে অনুভব করতে পারলো একটি চকলেট রয়েছে। সেটি বের করে খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুড়ে দিলো। আপন মনে চুষতে লাগলো। ঠিক ছোটবেলার মতোই। একসময় তার পেছন থেকে কেউ একজন রাজীবের শার্ট ধরে টান দিলো। ঘুরে তাকিয়ে দেখলো আট নয় বছরের একটি মেয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে।
রাজীব অপ্রস্তুতভাবেই জিজ্ঞাসা করলো ঃ কী চাই?

ডান হাতটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি বললো ঃ দশ টাকা দিবেন?
রাজীব ঃ নাম কী তোমার?
মেয়েটি মাথা চুলকাতে চুলকাতে উত্তর দিলো ঃ আমার নাম নিপা!
রাজীব ঃ হুম! তো তোমায় দশ টাকা দিলো তুমি সেই টাকা কী করবা?
নিপা ঃ ভাত কিনে খাবো।
রাজীব ঃ দশ টাকায় তুমি ভাত খাবা কীভাবে? দশ টাকায় তো কিছুই হবে না তোমার।
নিপা ঃ একটু কিনে খাবো। তাতেই চলবে। আজকের দিনটা তো পার করা যাবে।
রাজীব ঃ তোমাকে কত টাকা দিলে তুমি ভালোভাবে খেতে পারবে?
নিপা ঃ গরীব মানুষ অতো টাকা দরকার নাই। দশ টাকা দিলেই হবে!
রাজীব ঃ কিন্তু আমি তোমাকে বেশি টাকা দিতে চাই। আজকে অন্তত তুমি ভালোভাবে যেনো খেতে পারো।
নিপা ঃ একশ টাকা হলেই বেশি ভাত খেতে পারবো। তাতে আমার পেট ভরে যাবে।
রাজীব ঃ তরকারি লাগবে না?
নিপা ঃ একটু ডাল হলেই হবে।
রাজীব ঃ সাথে মাছ অথবা ডিম হলে কেমন হবে?
নিপা ঃ ওরে বাবা এতো ভালো খাবার কোনোদিনই খাইনি। আপনি আমাকে অত টাকা দিতে পারবেন।
রাজীব ঃ অবশ্যই দিতে পারবো। আমার পকেটে অনেক টাকা রয়েছে।
নিপা ঃ আপনি আমাকে এতোগুলো টাকা দিবেন!!

রাজীব তাকিয়ে দেখলো নিপার চোখে মুখে বিস্ময়! হতবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো রাজীবের দিকে। হয়তো ভাবছে, এটা কী করে সম্ভব হবে? সত্যিই কি লোকটা তাকে এতোগুলো টাকা দিবে? নিপার মোটেও বিশ^াসই হচ্ছিলো না। হয়তো নিপার সাথে লোকটি তামাসা করছে। কারণ, প্রতিদিনই এই অবুঝ আট নয় বছরের মেয়েটির সাথে অজানা অপরিচিত কত লোই মজা করে, তামাসা করে। কোনোদিনই এতো টাকা কেউ দেয়নি। সুতরাং এই লোকটিও যে তাকে এতোগুলো টাকা দিবে সেটি মোটেও নিপার বিশ^াসই হচ্ছিলো না।

নিপা কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার অবিশ^াসের ভঙ্গিতে বিস্ময়ে বললো ঃ আপনি আমাকে সত্যিই সত্যিই অনেক টাকা দিবেন?
রাজীব ঃ সত্যি তোমাকে দিবো আমি।
নিপা ঃ তাহলে দাদা, ভাত কিনে দিতে হবে না, একটা অন্য জিনিস কিনে দেবেন?
রাজীব ঃ সেটা কী?

নিপা ঃ আপনি যদি আমাকে ঐ টাকা দিয়ে চাল কিনে দেন তাহলে আমি ঘরে নিয়ে যাবো। ঘরে আমার মা আছে। আমি মায়ের সাথে ভাত রান্না করে খাবো।
রাজীব ঃ ও আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। তোমার বাড়িতে কে কে আছে?

নিপা ঃ আমার মা আছে। আমার দাদা আছে। আর আমার একটা বড় বোন আছে। আমার মা হাঁটাচলা করতে পারে না। আমার বড় বোন মানুষের বাড়িতে কাজ করে। আমার দাদা মানুষের চা দোকানে কাজ করে। সে পেট ভরে খেতে পারে। আমার বোনও পেট ভরে খেতে পারে। আর আমি মানুষের কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে খাই। বাড়ি মা বিছানায় শুয়ে শুয়ে থাকে। আমি কারো কাছ থেকে কিছু চেয়ে নিতে পারলে মা খায়। অথবা আমার বোন যদি কারো কাছ থেকে কিছু চেয়ে আনে তাহলে মা খেতে পারে। আর সেটা না হলে না খেয়ে মা থাকে।
রাজীব ঃ আর তোমার বাবার কথা বললে না তো!
নিপা ঃ ঠাডা পইরা মইরা গেছে!
রাজীব ঃ মানে? কবে মারা গেছে?

নিপা ঃ থাকতো দাদা। ঐ লোকটার কথা আর বইলেন না। মনে করতে চাই না।
রাজীব ঃ কেনো মনে করতে চাও না। তোমার বাবার কথা মনে করলে সমস্যা কী? ে
নিপা ঃ খারাপ লাগে। আমাদের ছেড়ে চলে গেছে অনেক আগেই। আরেকটা বিয়ে করছে। লোকটার কথা মনে নাই।
রাজীব ঃ তো তুমি যে বললা, তোমার বাবা ঠাডা পইরা মাইরা গেছে!
নিপা ঃ তাহলে কী বলবো? যে বাবা আমাগো রে দুঃখ দিয়া চইলা গেছে, সে তো ঠাডা পইরাই মরে গেছে। তার মধ্যে তো দয়ামায়া নাই। এমন মানুষ নিয়ে কী বলা যায়?
রাজীব ঃ বুঝতে পারছি তোমার মনে অনেক কষ্ট আছে।
নিপা ঃ খুব কষ্ট!
রাজীব ঃ হুম। তো তোমার পড়াশোনা করতে মন চায় না।

নিপা ঃ পড়াশোনা করতে চাইলে কি আর পারা যায়? যদি পড়াশোনা করি তাহলে খাওন দিবো কে? পেট তো সারাদিনই কান্দে! আমাগো মতো গরীবের লেখাপড়া করতে হয় না।
রাজীব মেয়েটিকে নিয়ে একটি দোকানে গেলো। তারপর দুই কেজি চাল। আর দুই হালি ডিম, পরিমাণ মতো পিয়াজ মরিচ, মসলাসহ কিনে বিদায় নিলো রাজীব। অন্তত চার জনের সংসারে কিছুটা হলেও চলে যাবে। রাজীব বুঝতে পারলো না, কেনো এই মেয়েটিকে এতোটা দয়া করলো। হঠাৎ করে তার মনে কেনই বা এমন চিন্তা হলো। তবে আর যাই হোক, মেয়েটিকে একটু সাহায্য করতে পেরে রাজীবের মনে খুবই আনন্দ লাগলো। এই আনন্দ অন্যরকম আনন্দ। যা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। অবশ্য এভাবে যারা মানুষের একটু একটু উপকার করে তারা এ রকম অন্যরকম আনন্দ উপভোগ করতে পারে। যা রাজীব আজ করতে পারছে।

রাজীব হেঁটে চলে বাড়ির দিকে, আর ভাবতে থাকে ওদের জীবন নিয়ে। সত্যিই খুব অদ্ভুতভাবেই বেড়ে ওঠে এসব শিশুরা। দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত অবুঝ জীবনগুলো কঠিন বাস্তবতায় চলতে চলতে হৃদয়ের যাতনায় জ¦লতে জ¦লতে মনটাও ওদের পাথরের মতো হয়ে যায়। জীবনকে বেশ কঠোরভাবে বুঝতে শেখে। খুব অল্প বয়সেই জীবনকে কঠোরতার মধ্য দিয়ে বুঝে নিতে শেখে। ওদেরকে শেখাতে হয় না কোন বিপদের সময় কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে হয়। ওদের শেখাতে হয় না কখন কোন কথা বলতে হয়। হয়তো প্রতিটি পরিস্থিতিতেই লড়াই লড়াই করতে করতে শিখে নেয় কৌশলগুলো। রাজীব হয়তো নয় বছর বয়সে ক্লাস ফোরে পড়েছে। সকাল হলেই ছবি আঁকতে বসতো। আর বিকেলে খেলাধুলা। এভাবেই তার জীবন চলতো। ছবি আঁকাটা তার দারুণ শখ ছিলো। মাথায় কোনো চিন্তাই ছিলো না। নিশ্চিন্তে পড়তে বসতো, নিশ্চিন্তে ছবি আঁকতে বসতো, নিশ্চিন্তে খেলাধুলা করতো। কখন খেতে হবে, খাবার জুটবে কোথা থেকে, এসব চিন্তাই করতে হতো না। পড়াশোনা করে সময় ব্যয় করলে খাবার আসবে কোথা থেকে-এ ধরনের চিন্তাও মাথায় আসতো না। এসব তো ভাবার জন্যে মা বাবাই ছিলো। দশ টাকা দিয়ে রাজীব তো চিপফ কিনে খেয়েছে কতো। এই তো এক বসাতে হোটেলে ঢুকে সিঙ্গারা পুড়িসহ বিশ টাকা খেয়ে নিলো। আর অথচ সেই মেয়েটি দশ টাকা চাইলো ভাত খাবে বলে। এটা মেয়েটির বেঁচে থাকার উপকরণ। অথচ কতো টাকা এদিক সেদিক রাজীব খরচ করে ফেলে।

রাজীব ভাবে, রাস্তাঘাটে রেল স্টেশনে বেড়ে উঠা মানুষগুলো পথের ধুলোয় অদ্ভুতভাবে বেড়ে ওঠে। তবুও তাদের বিবেকবোধ সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি ঘৃণাও এই শিশুর মনের মধ্যে জেগে উঠেছে। নিজের দুষ্টু বাবার প্রতিটি প্রচÐ রকমের ঘৃণা! সেই ঘৃণা থেকে বেড়িয়ে আসতেই পারছে না শিশুটি। তো, ওরা তো পথের মানুষ! তারপর রাজীব একটা দীর্ঘশ^াস ছাড়ে! টাকা দিয়ে হোটেল থেকে কিনে খাওয়ার চেয়ে বাড়িতে মায়ের কথা চিন্তা করে, বোনের কথা চিন্তা করে তৃপ্তিদায়ক ভাবনার বোধটাও এই আট নয় বছরের মেয়েটির হৃদয়ে তৈরি হয়েছে। অথচ এই বয়সেই আমি ভাবতাম প্রতিটি সকালে স্কুলে গিয়ে টিফিন ছুটি কী খেলবো, কার পাশে বসলে ভালো লাগবে, ম্যাডামদের কোনো বাড়ির কাজ আছে কিনা? অথচ এই ছোট মেয়েটি ভাবে প্রতিটি সকালে কোন দিকে গেলে একটু ভাত পাওয়া যাবে। আমাদের পঞ্চাশ টাকায় একদিনে মোবাইলেই হয়তো খরচ হয়ে যায়; অথচ ওদের সকলে মিলে একবেলা নুন ভাত খাওয়ার কথা চিন্তা করতে করতেই তাদের দিন শেষ হয়। কী বাস্তবতা! একই ¯্রষ্টার সৃষ্টি দু’জন আমরা। আমরা একইভাবে দু’জনই দু’জনের বাবা-মায়ের সন্তান। সৃষ্টিকর্তা চাইলে তো আমাদের অবস্থানটাও উল্টো হতে পারতো। অর্থাৎ আমার জায়গায় সে; আর আমি তার জায়গায়। অবশ্য এভাবে আমরা উল্টো করে কেউ চিন্তাও করি না। সেই কারণে আমরা বুঝি না অন্যের অবস্থান সম্পর্কে। আমাদের কারো কারো অনেক বেশি অহঙ্কার। আমরা গরীব অসহায়দের মানুষই ভাবি না। কখনো কখনো তাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আমরা যে অমানুষ সেটির প্রমাণ দিই। তাদের গায়ে হাত তুলে নিজেকে ছোট করি। ওদের দেখলে আমরা রুমাল নাকে দিই। ওদের সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত নয়। ওরা তো মানুষ! সৃষ্টিকর্তা ওদের সৃষ্টি করেছেন; আবার আমাদেরও সৃষ্টি করেছেন। পার্থক্য শুধু একটাই হতে পারে যে, ওরা পথে পথে ঘুরে বেড়ায়; আর আমি ধনী। অথচ সময়ের টাকা যে কোনো মুহূর্তে ঘুরে পরিবর্তন হতেই পারে। কাউকে নিজের আসনে বসালেই অপরকে স্পষ্ট বোঝা যায়।