ভালোবাসার মৃত্যু

ছোট গল্প
ভালোবাসার মৃত্যু
লিখেছেন : ক্ষুদীরাম দাস

১.
মানুষের মন হঠাৎই পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন সবকিছু পাল্টে যায়। ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে একটুও ভুল করে না। কিন্তু এ কারণে যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়, সেটা মানুষ ভাবে না। সেই ভাবনা তখন মোটেও কাজ করে না। বিবেক তখন অবশ হয়ে যায়। আর বিবেক অবশ হলে যে মানুষের মন ভিন্ন জগতে চলে যায় সেটা আমরা মোটেও চিন্তা করি না। তখন স্বার্থ চিন্তা ছাড়া আর কোনো চিন্তাই মানুষের মনে কাজ করে না। এমন চিন্তা করো কারো হয়ে থাকে।

ইতির একটি খুবই প্রিয় গান ছিলো, ‘—স্বার্থের টানে প্রিয়জন কেন দূরে সরে চলে যায়।’ এই গানটি ইতি খুবই বেশি বেশি শুনতো। এই গানটি এখন তার কাছে খুবই নিষ্ঠুর বলে মনে হচ্ছে। তার কাছে মোটেও ভালো লাগছিলো না। পাশের বাড়ির মহিলাটি জোর আওয়াজে গানটি শুনছে। কিন্তু তাকে এখন বাড়ন করা যাচ্ছে না। এতে হয়তো তার কাছে হিতে বিপরীত হতে পারে।

ইতির সাথে ইমুর জীবনটা তো খুবই আনন্দের চলছিলো। পরিবারে কোনো সমস্যা ছিলো না। সবচেয়ে যে বড় বিষয়টি সেটি হলো, আর্থিক কোনো সমস্যাই ছিলো না। যখন যেটা চেয়েছে সেটাই পেয়েছে। কোনো দিন অভাব বোধ কাজ করেনি। কিন্তু এসব ইতির কাছে এখন ভাবনার বিষয় নয়।

জীবন নিয়ে চিন্তা করতে করতে আজ বিকেলে ইতি মোটেও ঘুমাতে পারেনি। অথচ তার বিকেলে ঘুমানোটা অভ্যাসে ছিলো। মাথার মধ্যে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার বিষয়টা ঘুর ঘুর করছে।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ইতি দরজার দিকে তাকালো। দেখলো, দরজাটা খুলে মোহনা এসে দাঁড়িয়েছে কাছে। মোহনা ইতির দিকে তাকিয়ে রইলো।

তারপর মোহনা বললো ঃ তারপর কী সিদ্ধান্ত নিলি?
ইতি ঃ আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল! আমি এছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না।
মোহনা ঃ তাহলে কি ইমুর সাথে তোমার অন্যায় করা হবে না? তুমি কি সেটা বুঝতে পারছো? দীর্ঘদিন তোমাদের প্রেম ভালোবাসা ছিলো। এটা সবাই জানে। এরপর তোমাদের বিয়ে হয়েছে। সংসার করেছো পাঁচটি বছর পার হলো। এতোদিনের ভালোবাসার কী হবে? জীবনের এই বাস্তবতাগুলোকে তো আর অস্বীকার করা যায় না।
ইতি ঃ তুই বুঝতে পারছিস না কেন? আমারও তো একটা জীবন আছে। আমি তো এভাবে বাঁচতে পারি না। এভাবে কী বাঁচা যায়, তুই বল? আমি আমার জীবনকে সাজাতে চাই। আমি বাঁচার মতো বাঁচতে চাই।

মোহনা ঃ দুর্ঘটনার জন্যে কে দায়ী ছিলো? এটা কার দোষ। ইমু কি সেরকম জীবন চেয়েছিলো? এটা দুর্ঘটনা একটা। এটাতে কারো হাত নেই, ছিলো না। ঘটনা ঘটে গেছে। এখন তোরই তার পাশে দাঁড়ানো উচিত। এখন যদি তুই তার জীবন থেকে এভাবে চলে যাবি, তাহলে সে কতো বড় আঘাত পাবে তুই একবার ভেবে দেখেছিস? সে তো তোকে খুবই ভালোবাসতো, এখনো তোকেই ভালোবাসে।

ইতি ঃ তুই আমাকে এসব কথা বলে আর আঘাত করিস না। আমি আর ভাবতে পারছি না।
মোহনা ঃ তাহলে তুই শেষ পর্যন্ত তাকে ডিভোর্স দিবিই?
ইতি ঃ তাহলে কী করার আছে? আমি কি জীবনের বাকি দিনগুলো এই পঙ্গু মানুষটার সঙ্গে কাটিয়ে দিবি?
মোহনা ঃ তাহলে ভালোবেসে বিয়ে করলি কেনো?
ইতি ঃ তখন তো সে পঙ্গু ছিলো না!

মোহনা ঃ তখন সে সুস্থ একজন মানুষ ছিলো। এভাবে যদি মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তো বিয়ের আগে শর্ত দেয়া উচিত। আচ্ছা বলতো, প্রকৃত ভালোবাসায় কী শর্ত থাকে? থাকে না। তোদের ভালোবাসায়ও শর্ত ছিলো না। তুই তাকে ডিভোর্স দিয়ে প্রমাণ করলি যে, ভালোবাসায় শর্ত থাকা উচিত, আর বিয়ে করেও শর্ত জুড়ে দেয়া উচিত। এটাকে মোটেও ভালোবাসার জীবন বলে না।
ইতি ঃ সে এখন পঙ্গু। আমি তার সাথে সংসার করতে পারবো না।
মোহনা ঃ তোর ছেলেমেয়েদের কী হবে? ওরা তো ওদের বাবাকে হারাবে!
ইতি ঃ আর আমি যে সুন্দর জীবন হারিয়েছি। আমি সুন্দর জীবন চাই।

মোহনা ঃ ডিভোর্স দিলেই কী সুন্দর জীবন হয়ে যাবে? এটা একটা দুর্ঘটনা। এটা মেনে নিতেই হবে। পঙ্গু ঐ লোকটাকে নিয়েই তোর সুন্দর জীবন গড়তে হবে। তাহলে মানুষ তোকে ভালো বলবে। ভালোবাসার গুরুত্বটা তখন মানুষ বুঝবে। সুন্দর জীবন কাকে বলে সেটা মানুষ খুঁজে পাবে।

মোহনা আর কিছু ভাবতে পারছে না। আর কিছু বলতেও পারছে না। তাই তার রুম থেকে হন হন করে হেঁটে চলে গেলো। এ জাতীয় মানুষকে বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই। মনের মধ্যে যে চিন্তা চলে এসেছে সেখানে এখন আর কোনো নীতি কথা তার কাজ করছে না। বিবেক চক্ষু তার অন্ধ হয়ে গেছে। তাই তার বিবেকে সুন্দর সিদ্ধান্তের কথা আসছে না। হয়তো ডিভোর্স দেয়াই তার জীবনের জন্যে সুন্দর সিদ্ধান্ত। জীবনটা তার, আর সিদ্ধান্তও তার নেয়া উচিত। কিন্তু এখানে ইমুর ভালোবাসাপূর্ণ জীবন জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে আরো দুটি শিশুর। তিন তিনটা মানুষের ভবিষ্যৎ। অন্তত ইতির এটা ভাবা উচিত ছিলো যে, দুটি শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনের কী হবে?

২.
ইমু বুঝতে পারলো, আগের মতো আর ইতির মনে তার জন্যে কোনো ভালোবাসা নেই। কেমন জানি সবকিছু হালকা লাগছে। ইতির নীরবতা, কাছে না আসা, কোনো সহানুভূতি প্রকাশ না করা, স্বেচ্ছায় একগ্লাস জল ঢেলে নিয়ে আসা, আগের মতো চা বানিয়ে আনা, হাসিমুখে দুটো কথা বলা সেসব আর হয় না।

ইমু ভাবে, এতে তার কী দোষ ছিলো। দুর্ঘটনায় তার দু’টো পা হারানো কী সে দায়ী! এটাকে আমার মানতেই হবে। কিন্তু ইতি কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছে না। যার মন একবার ভালোবাসার গণ্ডি পেরিয়ে চলে যায়; তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। সেখানে বাধা দিয়ে কী লাভ হবে? সেই বাধা কোরো কাজে আসবে না। জোর করে রাখা হবে জীবনের দুর্বিষহ বিষয়। হয়ে যাবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বেঁচে থাকা। জীবনের সময়গুলো তখন তিক্ততায় ভরে যাবে। অথচ, আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইতি তাকে ছেড়ে চলে যাবে। এটাও কী তাহলে দুর্ঘটনা? এটাও কি ইমুকে মেনে নিতে হবে স্বাভাবিকভাবে? হয়তো তাই। ইতির চলে যাওয়াতে ‘কেন কেন’ এসব প্রশ্নের কারণ খুঁজতে যাওয়া বৃথাই প্রচেষ্টা।

ইমু এখন ভাবছে, তাহলে সেদিন মরে গেলেই তো ভালো হতো ইতির জন্যে। হয়তো কিছুদিন কান্নাকাটি করতো। তারপর একসময় সব ঠিক হয়ে যেতো।

ইমু উদ্দেশ্যহীন পিছন ফিরে তাকালো। দেখলো, ইতি তাকিয়ে আছে তার দিকে। হয়তো সে কিছু বলতে চায়, তাই তার দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে রইলো ইমু মনোযোগসহকারে। কিন্তু ইতি কোনো কিছুই বললো না। ইমু আশ্চর্য হয়ে গেলো। মুহূর্তে ইমু মাথা নিচু করে নিজের দুই পায়ের দিকে তাকালো। বুক ফেঁটে কান্না আসছিলো তার। কিন্তু চোখে জল আসলো না। তারপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জানালার দিকে গাছের ডালে বসে থাকা পাখিগুলোর দিকে। হালকা বাতাস বইছে। গাছের ডাল দুলছে, পাতাগুলোও নড়ছে। কিন্তু পাখিগুলো উড়ে যাচ্ছে না। কারণ, ওরা জানে এটা স্বাভাবিক। একটু পর আরেকটা পাখি আসলো, তারপর আরেকটা পাখি, তারপর আরেকটা পাখি। এরপর গাছের মরাডালটি আর সইতে পারলো না। মরাডালটি মট করে ভেঙ্গে গেলো। সব পাখি একসাথে এদিক সেদিক উড়ে গেলো। এতো পাখি কোনদিকে গেলো সেটা ইমু দেখতে পেলো না। কিন্তু ঐ দুটো পাখি একটু পর আবারও পাশের ডালে এসে বসলো। দুটো পাখি দুদিকে উড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু গেলো না। কারণ, ওরা একসাথে থাকতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। একটু পর ওরা একসাথেই উড়ে চলে গেলো।

একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে ইমু আবার ফিরে তাকালো ইতির দিকে। মনে হবে শক্ত ও কঠিন নীরবতা। অথচ ইমুর সরল চাহনি। চোখের ভাষায় বোঝাতে চাইলো জীবনের অনেক কিছু। এই দৃষ্টিতে রয়েছে অনুরোধ, প্লিজ তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। আমার দুটি সন্তান তুমি কেড়ে নিও না। ওরা তো ওদের বাবাকে হারাবে। আর আমি হারাবো তোমাকে, আমার ভালোবাসাকে। কেন তুমি এমন করছো? কেনো তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ? কী আমার অপরাধ? কী তোমার স্বার্থ! তুমি তো আমাকে খুবই ভালোবাস, সেই ভালোবাসা আমি তোমার কাছ থেকে পেয়েছি। এমন তো হবার কথা ছিলো না। আর আমিও তো তোমাকে প্রচÐ ভালোবাসতাম। তাহলে কেন তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ? ইমুর দৃষ্টিতে নীরবতা! ছলছল অশ্রæ গড়িয়ে পড়ছে, আর বুকফেটে কান্না। এই কান্নার শব্দ কেউ শুনতে পায়নি। শুধু দেখেছে ইতি।

‘চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিঁড়ে কাদিস কেন মন—’এসব গান এখন ইমুর কাছে ভালো লাগে না। জীবনটা কি তাহলে এমনই হয়। হয় না, শুধু স্বার্থপরতা যখন বাসা বাঁধে তখনই এমন হতে পারে।

পরদিন ইতি জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগ হাতে করে বেড়িয়ে যাচ্ছে। দরজার কাছে আসতেই ইমুর মা বাবা এগিয়ে এলো। কিছু বলার আগেই ইমু হাত উঁচু করে নিষেধ করলো, যেন ইতিকে কোনো কথা না বলা হয়। ইমুর মা বাবা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মুখে কোনো কথাই বললো না। আর ইমু দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বললো, এভাবে আমাদের ভালোবাসাকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়ে তুমি চলে যাচ্ছ? তোমার অনেক অভিযোগ, তোমার অনেক অজুহাত, তোমার অনেক নালিশ। আজ তোমার চলে যাওয়া সেগুলো মোটেও কোনো কারণ নয়। অথচ, সেটাকেই সমাজের কাছে কারণ দেখিয়ে চলে যাচ্ছ! আজ থেকে তোমার কাছে আমাদের ভালোবাসার মৃত্যু হলো। তোমাকে অভিশাপ দিতে পারি না। কারণ, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
–সমাপ্ত-