ক্ষুদীরাম দাস-এর ছোট গল্প : অন্তরা

গ্যাসের চুলোয় রান্না বসাতে গিয়ে অন্তরা দেখলে কৌটাতে মরিচ নেই। কৌটাতে ধুয়ে দিলেও তরকারিতে মরিচের স্বাদ পূরণ হবে না। তাই ভাবলো, পাশের ফ্ল্যাটের ভাবির কাছ থেকে একটু মরিচের গুঁড়ো ধার চাইলে কেমন হবে। কিন্তু এ ধরনের অভ্যাস অন্তরার ছিলো না। এখন হঠাৎ করে ধার চাইতে যাওয়াটা রীতিমতো অভদ্রতার পর্যায়ে পড়ে। তাছাড়া পেস্টেজের বারোটা বেজে যাবে। অপরদিকে রানা ঘরে আসলে বিষয়টাকে মোটেও ভালো চোখে দেখবে না। কিন্তু সেটা না করে যে রান্না করতেও পারবে না।

অন্তরা ভাবলো, থাক, আনবার দরকার নেই। যা আছে তাতেই চলে যাবে। আবার চিন্তা করলো নিয়েই আসি। তাতে আর যাই হোক না কেনো? তাছাড়া একটু আধটু তো ঐ ভাবীর সাথে উঠতে বসতে কথাই হয়ই। সুতরাং নতুন বলে কিছু নেই। অন্তত বলার পদ্ধতিটা যদি একটু কায়দা করে বলা যায়, তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। সব ভাবতে ভাবতে অবশেষে বাধ্য হলো পাশের ফ্ল্যাটের দিকে যাচ্ছিলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে টোকা দিতেই অর্পনা ভাবী দরজা খুলে দিলেন।

অর্পনা দেখেই হতবাক হয়ে গেলো। বললো ঃ আরে, কী আশ্চর্য, হঠাৎ করে কী মনে করে আসলেন?
অন্তরা ঃ কেনো ভাবী। আপনারা আমাদের প্রতিবেশী। আমরা কী আপনাদের কাছে আসতে পারি না?
অর্পনা ঃ কেনো নয়? আসুন, ভেতরে আসুন, বসুন।
দু’জনে সোফায় বসতে বসতে অন্তরা বললো, ভাবী শোনেন, আমি একটু সমস্যায় পরেছি।
অর্পনা ঃ কী ধরনের সমস্যা?
অন্তরা ঃ আমার একটুও মরিচের গুঁড়ো নেই। বাজার থেকে আনতেও ভুলে গেছি।
অর্পনা ঃ ও এই কথা। কোনো সমস্যা নেই। আমার রান্নাঘরে ঢুকে আপনার যা ইচ্ছা নিতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই।
অন্তরা ঃ ঠিক আছে ভাবী, অনেক ধন্যবাদ।
অর্পনা ঃ যেহেতু প্রতিবেশী আমরা, সুতরাং পর মনে করবেন না একটু।
অন্তরা ঃ ধন্যবাদ, আপনার কথা শুনতে ভালোই লাগলো?
অর্পনা ঃ যাবার সমস্যা, মাংসের তরকারি নিয়ে যাবেন। আপনারা দু’জন খেয়ে আমাকে বলবেন, আমার রান্না কেমন হয়েছে।
অন্তরা ঃ আচ্ছা, ঠিক আছে ভাবী।
অন্তরা রান্নাঘরে ঢুকে মরিচের গুঁড়ো আর একটা বাটিতে করে মাংস নিলো।
দুপুরের দিকে রানা এসে ঘরে ঢুকলো। আজ তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে, সেটা তার হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে। অন্তরা এগিয়ে এসে বললো ঃ তুমি মনে হয় ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি গোসল করে খেয়ে নাও। একটু বিশ্রামের দরকার আছে। তারপর রানা গোসল করে, দু’জনে একসাথে খেতে বসলো।
রানা আগবাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো ঃ তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না?
অন্তরা ঃ কেমন কষ্ট?
রানা ঃ এই যে, আমার সংসারে এসে এতো অভাব অনটন?
অন্তরা ঃ মোটেও না।
রানা ঃ তুমি কিন্তু মিথ্যা বলছো।
অন্তরা ঃ মানিয়ে নিয়েছি।
রানা ঃ কী রকম সেটা?
অন্তরা ঃ মেয়েদের সবসময় নতুন পরিবেশে মেনে নিতে হয়। বাবার বাড়িতে এক রকম জীবন। ঠিক একই জীবন স্বামীর বাড়িতে এসে পাওয়া যায় না। নতুন নতুন মানুষ, নতুন মানসিকতার মানুষ। অপরিচিত মানুষরা ধীরে ধীরে কাছের হতে শুরু করে। তাদের সাথে নতুনভাবে চলা শুরু করতে হয়। এটা স্বাভাবিক। হয়তো, আমার বাবার বাড়িতে সামর্থ অনেক ছিলো; কিন্তু সেটা এক জীবন। এখন আমি স্বামীর বাড়িতে এসেছি। এখানে তো আর সে রকম অভ্যাস চলবে না। নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।

রানা ঃ হুম! তুমি বেশ গুছিয়ে কথা বলেছো। তবুও আমার কষ্ট হয় তোমার জন্যে। তুমি তোমার বাবার বাড়িতে যেভাবে আরামে ছিলে সেভাবে আমি কিন্তু তোমাকে রাখতে পারছি না। তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, সেটা আমি বুঝতে পারছি। তোমার হাতে কোনো টাকা পয়সা দিতে পারি না। সেই ক্ষমতা আমার নেই।

অন্তরা ঃ এসব কথা থাক। আমি সবকিছু সইয়ে নিয়েছে। শুধু তোমার জন্যে, কারণ তুমি তো ভালো মানুষ। জীবনের জন্যে টাকা পয়সা দরকার আছে, সেটাকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তুমি সৎভাবে জীবনযাপন করছো, সেটা আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।

রানা ঃ অভাব যদি আরো বেড়ে যায় তখন জানালা দিয়ে ভালোবাসা পালাবে নাতো?
অন্তরা ঃ আমি তো জানালা বন্ধ করেই রেখেছি। সুতরাং ভালোবাসা পালাবে কোথায়?

এভাবে এক বছর পার হয়ে গেলো।

রানা অনেকটা ভেবে চিন্তে অন্তরাকে বললো ঃ তোমাকে একটা কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
অন্তরা ঃ বল তুমি।
রানা ঃ আমাদের এতো অভাব। আমরা তো নিজেরাই ভালোভাবে চলতে পারছি না। সেখানে আমরা কীভাবে আরেকজনকে আশা করতে পারি?
অন্তরা ঃ তোমার কথার কোনো অর্থ বুঝতে পারছিই না।
রানা ঃ বলছি, আমাদের অভাবের কথা। আমরা তো নিজেরাই বাঁচতে পারছি না। ভালো শাড়ি কাপড় তোমাকে দিতে পারছি না। আর আমি নিজেও কোনো ভালো শার্ট প্যান্ট পরতে পারি না। সেখানে তৃতীয় ব্যক্তিকে আমরা কীভাবে রাখবো?
অন্তরা ঃ ও বুঝতে পেরেছি। সন্তানের কথা চিন্তা করছো তো! সেটা আমিও চিন্তা করছিলাম। অবশ্য আমাদের আর দেরি করা উচিত নয়। কিন্তু আমাদের অভাব আমাদের তাড়িত করছে। তাই আপাতত দারিদ্রের কথা ভেবে ঐ চিন্তা আমরা মোটেও করতে পারছি না। সংসারের অভাবের কথা নিকট আত্মীয় ছাড়া কাউকে বলা উচিত নয়। তাই কাউকে বলতেও পারছি না। আমাদের সাহায্য করবে সে রকম কোনো মানুষই আমি দেখছি না।
রানা ঃ তুমি আমার জন্যে, আর আমি তোমার জন্যে আছি। সাহায্য করবার জন্যে আর কাকেই আমরা আশা করতে পারি। তবে আমাদের প্রতিবেশীরাই আমাদের আপনজন। তাদের সুসম্পর্ক রাখাই যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশি কিছু আমাদের চিন্তা করার দরকার নেই।
অন্তরা ঃ তুমি ঠিকই বলেছো।
রানা ঃ দেখছো, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।
অন্তরা ঃ চলতো আমরা দু’জন গিয়ে ভিজি। আমার খুব ইচ্ছা করছে বৃষ্টিতে ভিজতে।
ওরা দু’জনে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে এক ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে পাশাপাশি দু’জন হাঁটতে থাকে। রানা ছাতাটা বাম হাতে মেলে ধরে। মাঝে মাঝে হালকা বাতাসে ছাতাটা হেলে পরতে চায়। রানা একটু শক্ত করে সেটাকে ম্যানেজ করে। ছাতার সামনের দিকে একটু ফুটা রয়েছে। সেই ফুটা দিয়ে একটু একটু বৃষ্টির পানি পরে। বৃষ্টির পানি পরা দেখে পরস্পরের দিকে তাকায়। রানা ছাতাটা ঘুরিয়ে ফুটাটা পেছনের দিকে দেয়। তাতে বৃষ্টির পানি পেছনে গিয়ে পড়ে। তাদের গায়ে আর পরে না। অন্তরা ডান হাতে রানার বাম হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে।
অর্পনা ভাবি দূর থেকে দেখে চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে ঃ আমাদের একটা ছাতা নিলেই তো সমাধান হয়ে যায়।
রানা দূর থেকে চিৎকার করে উত্তর দেয় ঃ ধন্যবাদ। সেটার দরকার হবে না। আমরা ম্যানেজ করে নেবো।
অন্তরা ঃ আমাদের সংসারটা এভাবেই আমরা চালিয়ে নিতে পারি না।
রানা ঃ অবশ্যই। বাতাস আসলে ছাতাটা যেমন একটু শক্ত করে ধরে ম্যানেজ করবো; তেমনি সংসারে বাতাস আসলেও একটু শক্ত করে সমাধান করবো। ছাতার সামনের ফুটা দিয়ে পাািন পরলে যেমন ছাতাকে ঘুরিয়ে পেছনে ফুটা দিলাম; তেমনি ছোট ছোট দুঃখ আর ঝামেলাগুলোকে পেছনে ঘুরিয়ে দেবো।
অন্তরা ঃ আর আমি তোমার হাতটা যেভাবে ধরেছি–
রানা ঃ হুম! ঠিক সেভাবে তুমি আমার হাতটা শক্ত করে ধরবে। তাতে আমিও শক্তি পাবো, আর–
অন্তরা ঃ আর আমিও তোমার ভরসায়, নির্ভরতায়, সাহাসে এগিয়ে যাবো।
রানা ঃ আর কেউ দূর থেকে চিৎকার দিয়ে কিছু —-
অন্তরা ঃ যদি সে রকম হয়, তাহলে নিজের যা আছে তাতেই আমরা নির্ভর করে সমঝোতায় নিজের যা আছে, তাতে সন্তোষ্ট থেকে আনন্দে দু’জন সংসারটা চালিয়ে নেবো।

রানা অন্তরার কথায় সাহস খুঁজে পায়। অন্তরা একটি গাছের ডালের দিকে তাকিয়ে দেখে, সেখানে দু’টি পাখি এতো বৃষ্টির মধ্যেও চুপচাপ জড়োসড়ো হয়ে পাশাপাশি বসে আছে। অন্তরা বাম হাতটা উঁচু করে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে রানাকে বলে উঠে ঃ ঐ দেখো পাখি দু’টোর মতো আমাদের সংসার–
রানা অন্তরার কথা শুনে মনে মনে খুশি হয়।
—————– সমাপ্ত————-