ক্ষুদীরাম দাসের ছোট গল্প : অভ্যাস

এক.
সীমান্ত গল্পের বইটা দুই হাতে ধরে মনোযোগ দিয়ে পড়ার মতো ভাব করছে। বোঝার উপায় নেই যে, তার মনের মধ্যে অন্য মতলব রয়েছে। সীমান্ত অপেক্ষা করছে তার বাবার অফিস থেকে ফেরার। কিন্তু অন্যদিনের চেয়ে আজ একটু দেরি করেই যেন অফিস থেকে ফিরছে। মাঝে মাঝে অফিসে কাজের চাপ থাকে, তাই মাঝে মাঝে দেরি করেই বাসায় ফেরে। তবে আজ একটু বেশিই দেরি করে ফেলছে। সীমান্ত মোটেও এই দেরি করাটা সহ্য করতে পারছে না। তার কাছে অসহ্য লাগছে বাবার অফিস থেকে ফেরা দেরি হওয়াটা। তবুও সীমান্ত বেশ সহ্য করেই আছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সুখেন বাবু অফিস থেকে ফিরে আসলেন।

সীমান্ত তার বাবাকে দেখে একটু নড়েচড়ে বসলো। বেশ মনোযোগসহকারে সীমান্তকে বই পড়তে দেখে মনে মনে বেশ খুশি হয়। সুখেন বাবু কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে পোশাক পরিবর্তন করে বার্থরুমে ঢুকে ফ্রেস হওয়ার জন্যে। এদিকে সীমান্তের নজর বাবার প্যান্টের পকেটের দিকে। সীমান্ত মনে মনে চিন্তা করে, আজ যেভাবেই হোক পাঁচশত টাকা চুরি করতেই হবে। যদিও টাকার পরিমাণটা বেশি; কিন্তু এত টাকা পকেট থেকে নিলেও বাবা বুঝতেই পারবে না।

সুখেন বাবু একটি এনজিও’তে চাকুরি করেন। এ চাকুরিতে দুই নাম্বারে টাকা উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন তিনি। অর্থাৎ একশ টাকার জিনিস দেড়শ টাকা করলেও কোনো বিপদের সম্মুখীন হননি কোনোদিন। এভাবে তিনি তার আয়ের পরিমাণটা বাড়াতে পেরেছেন। ফলে কতো টাকা অবৈধ উপার্জন হলো সেটা তার হিসাব থাকতো না। সত্যিই অবৈধ টাকার কোনো হিসাব থাকে না। যারা এভাবে কালো টাকা উপার্জন করেন তাদের হিসাব থাকার কথা নয়। আর তাই সুখেন বাবুর পকেটে কতো টাকা থাকতো সেই হিসাব তার থাকতো না। এ কারণে সীমান্ত বাবার পকেট থেকে হঠাৎ হঠাৎ এভাবে টাকা নিলে টের পেতেন না কোনোভাবেই।

সীমান্ত যখন দেখলে তার বাবা বাথরুমে ঢুকেছে, বের হতে আধা ঘন্টারও বেশি সময় লাগতে পারে; এই ফাঁকে প্যান্টের পকেট থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে নিজের পকেটে রেখে দিলো। তারপর আবার আগের মতো বই পড়ার ভাব ধরে বসে রইলো। বেশ কিছুসময় পর তার বাবা বাথরুম থেকে বের হলেন। বের হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, কী বই পড়ছো?
সীমান্ত ঃ ডেল কার্নেগীর বই পড়ছি।
সুখেন বাবু ঃ বাহ্! খুবই ভালো বই তো। এই লেখকের বই খুবই ভালো। খুব ভালো জ্ঞান অর্জন হয়। পড় পড়, খুব মনোযোগ দিয়ে পড়।
সীমান্ত ঃ তুমি কি পড়েছো বাবা।
সুখেন বাবু ঃ ছোট বেলা থেকেই আমি এই লেখকের ভক্ত। তার লেখা বইগুলো আমার খুবই ভালো লাগে।
সীমান্ত ঃ আমারও বাবা খুবই ভালো লাগে।
সুখেন বাবু ঃ বই পড়ে কেউ কোনোদিন দেউলিয়া হয় না। বইপড়ার অভ্যাস আমাদের তৈরি হওয়া উচিত। বইপড়লে যে জ্ঞান হবে, তা আর অন্য কিছুতে হবে না।
সীমান্ত ঃ হুম, বাবা তুমি ঠিকই বলেছো!
সুখেন বাবু ঃ হুম!
সীমান্ত ঃ বাবা, একটা কথা বলবো?
সুখেন বাবু ঃ হুম, বলে ফেলো।
সীমান্ত ঃ আজ বিকেলে আমি আমার এক বন্ধুর বাসায় যাবো।
সুখেন বাবু ঃ কেনো?
সীমান্ত ঃ আমার বন্ধুর জন্মদিন, তাই।
সুখেন বাবু ঃ ঠিক আছে, বন্ধুর জন্মদিনে তো উপহার দিতে হবে তাই না?
সীমান্ত ঃ হুম!
সুখেন বাবু ঃ আমার পকেট থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে যাও।
সীমান্ত ঃ ঠিক আছে বাবা, আমি নিচ্ছি।
সুখেন বাবু অনুমতি দিয়েই ভেতরে চলে গেলেন। এদিকে সীমান্ত পাঁচশ টাকার পরিবর্তে একহাজার টাকা পকেট থেকে নিয়ে নিলো। তারপর বিকেলে বন্ধুদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। বন্ধুদের সাথে নিষিদ্ধ নেশায় মত্ত হয়ে বাবার সমস্ত টাকা উড়িয়ে দিলো। বন্ধুরাও এজন্যে সীমান্তকে খুবই ভালো বাসতো। কেননা সীমান্ত প্রায় সময়ই বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে আসে এবং বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ করে। বন্ধুরাও সীমান্তকে কাছে টেনে নেয়; এমন সঙ্গী কেউ দূরে রাখতে পারে না।
সুখেন বাবুর পরিবারটি বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই চলছিলো। সীমান্তের মতো সুখের বাবুর মেয়েটিও বেপরোয়া জীবনযাপন করতে লাগলো। সেও গোপনে গোপনে বাবার পকেট থেকে টাকা নিয়ে ইচ্ছামতো খরচ করতে লাগলো। এছাড়াও সুখেন বাবু নিজেও তাদেরকে অনেক টাকা দিতেন।
যে পরিমাণ বেতন সুখেন বাবু বেতন পেতেন, তার চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতেন। এটা আশপাশের মানুষরাও বুঝতে পারতেন। বিষয়টি নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামাতো না, কিন্তু মানুষের সমালোচনা থেমে থাকে না এসব বিষয়ে। তারা সমালোচনা করতেই থাকে। প্রতিটি মানুষের জীবনেই তাদের সমালোচনা করার মতো মানুষের জন্ম হয়। তার সম্মুখে অথবা পেছনে সমালোচনা করতে থাকে। আর এভাবে সকলেই তিলকে জানতে গিয়ে তালও মানুষ জেনে যায়। সুখেন বাবুর চাকুরিতে দুই নাম্বারে উপার্জন করার সুযোগ থাকতো বলে সেই সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতেন না। এভাবেই তার সংসার বেশ ভালোভাবেই চলে যাচ্ছিলো। পরিবারে কোনো অভাব বলে কিছুই ছিলো না। খাবার দাবার, ছেলেমেদের সার্বিক চাহিদা, স্ত্রীর সমস্ত আবদার সবই তিনি পূরণ করতেন। ফলে পরিবারের সকলেই সুখেন বাবুর উপর খুশি, মহাখুশি।

দুই.
আজ সূর্যের তেজ তেমন একটা নেই। সকাল থেকেই মেঘলা মেঘলা করছিলো। দুপুরের দিকে তুমুল বৃষ্টিতে পৃথিবীর বায়ুমÐলকে শীতল করে দিয়েছে। ফলে সূর্যটা নিজের গতিতে ত্যাজ নিক্ষিপ্ত করলেও শীতলতা চারিদিকে। তাই দিনটা অন্যরকম লাগছে। প্রতিবেশী সকলের কাছেই সুন্দর ও শীতলতা উপভোগ্য হলেও সুখেন বাবুর কাছে সেই উপভোগটা নিজের মতো করে লাগছে না। ‘ক্ষুধার রাজ্যে পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ তেমনি সুখেন বাবুর কাছেও কোনো সৌন্দর্যই ভালো লাগে না। হঠাৎই যেন তার মাথায় বাজ পড়লো অফিসের বসের নতুন ঘোষণায়। অবশ্য এই ঘোষণায় অফিসের বসও দুঃখার্ত ও মর্মাহত। ‘আগামী তিন মাসের মধ্যে তাদের এনজিও বন্ধ হতে চলেছে’ কথাটা অফিসের সকলের মনের মধ্যে তীরের মতো বিঁধে গেছে। সকলেই শোকার্ত এমন একটি খবরে।
তিন মাস পরে চাকুরি থাকবে না এই খবরে পরিাবারের সদস্যদের তেমন একটা প্রভাব পড়লো না। সুখের বাবুর স্ত্রী কিছুটা অনুভব করতে পারছিলেন। বয়সের ভারে বুদ্ধিটা বেড়েছে বলেই সুখেন বাবুর মনের কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারলেন। ছেলে সীমান্ত ও মেয়ে ইভার মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না।
এদিকে সুখেন বাবু বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে লোন করেছিলেন মোটা অঙ্কের। ভেবেছিলেন, যেভাবে আয় হচ্ছে, তাতে সেই লোনের টাকা পরিশোধ করা মোটেও সমস্যা হবে না। অনায়াসেই সেই টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠলো না। একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে চেয়ারের উপরে বসে পড়লেন সুখেন বাবু। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন টেরও পেলেন না।
তিন মাস পরে সুখেন বাবুর চাকুরি চলে গেলো। আগের মতো আর আয়রোজগার নেই। শুরুতেই কিছু জমানো টাকা ছিলা বলে সংসারটা ঠিক আগের অভ্যাসেই চলছিলো। ধীরে ধীরে ভাটা পড়তে লাগলো। যে অভ্যাসে সংসার চলছিলো সেই অভ্যাসে চলাটা আর সম্ভব হচ্ছিলো না। চাইলেই কিছু করতে পারছে না, চাইলেই কিছু পাচ্ছে না, চাইলেই কোথাও যেতে পারছে না, চাইলেই মার্কেট করে নতুন নতুন জামা কাপড় পড়তে পারছে না। আগে যেখানে পরিবারের সকলের জৌলস ছিলো, সেখানে সবকিছু ধীরে ধীরে পুরোনো হতে শুরু করলো। ছেলেমেয়েদের, স্ত্রীর চলাফেরা ও খরচে আভিজাত্যে চলাচলের অভ্যাসটি পরিবর্তন হতে কষ্ট হচ্ছিলো। তবুও সবকিছু হারিয়ে গেলেও, অভাব শুরু হলেও অভ্যাস বদলে যেতে সময় লাগছিলো।
শুরু হলো পরিবারে অশান্তি। অভাবের তাড়নায় পূর্বের অভ্যাস দ্রæত পাল্টাতে লাগলো। সুখের বাবু বারান্দায় বসতে বসতে স্ত্রীকে বললেন, ঘরে তো কেউ নেই, তাই লাইট ফ্যান বন্ধ করে দাও।
স্ত্রী ঃ কোনোদিন তোমার মুখে এমন কথা শুনিনি।
সুখেন বাবু ঃ আমরা খরচ কমালে অন্যেরা বিদ্যুৎ পাবে, তাই তোমাকে কথাটি বললাম।
স্ত্রী ঃ এমন কথা, আর যুক্তি তোমার মুখে কোনোদিন শুনিনি।
সুখেন বাবু ঃ সময়তে যুক্তি মাথায় এমনিতেই চলে আসে। আর তখন অভ্যাসও পাল্টানো যায়।
সুখেন বাবুর স্ত্রী দীর্ঘশ^াস ছেড়ে লাইট ফ্যান বন্ধ করে দিলেন। সীমান্ত আর ইভা পরস্পরের দিকে তাকায়। কিন্তু লাইট ফ্যান ওন করার কথা কেউ কাউকে বলছে না। ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এলো, যদি প্রকৃতির বাতাস তাদের গায়ে লাগে।
——————– সমাপ্ত —————