এক.
‘আমাকে ফোনটা দাও বলছি’ রুক্ষভাবে সায়মা ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ফোনটা কেড়ে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলো।
অনুপ বাম হাতে ফোনটা শক্ত করে ধরে হাতটা সরিয়ে নেয়। কোনোভাবেই ফোনটা সায়মার হাতে দেয়া যাবে না এমন একটা শক্তি প্রয়োগ করে।
সায়মার সমস্ত শরীরটা হিম হয়ে আসে। মনে হচ্ছে, চারিদিকের বস্তুগুলো ঘুরছে তো ঘুরছে। সায়মার শরীরটা শক্তিহীন হয়ে আসে। তবুও সে আবার উঠে দাঁড়ায়। অনুপের দিকে এগিয়ে যায়, আর ফোনের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কেড়ে নেয়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে। সায়মা ব্যর্থ হয়। ফোনটা কেড়ে নিতে পারে না। তার চোখ মুখ লাল হয়ে আসে।
সায়মা অনুপের দিকে ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে থাকে, তোমার মতো নীচ আমি আর কোথাও দেখিনি। এটাই তোমার ভালোবাসার প্রতিদান?
অনুপ নির্মমভাবে হাসতে হাসতে বলতে থাকে, এই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হবে।
সায়মা সজোরে একটা চড় বসিয়ে দেয় অনুপের গালে। মনের কষ্টে দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সায়মা বুঝতে পারে না কী করবে, কী করা উচিত এখন! ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়। সায়মা দু’হাতে মুখ ঢেকে রাখে। আর ভাবতে থাকে, কী ভুল করলাম আমি জীবনে! এই ভুলের কোনো সংশোধন হবার নয়। ভালোবাসার মানুষকে বিশ^াস করাটাই কী আমার ভুল হয়েছে? কেনো অনুপ আমার সাথে এমন করলো? সে কোনো সব কিছু ভিডিও করলো? এখন যদি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয় তাহলে আমার কী হবে? আমার মা বাবা কীভাবে মুখ দেখাবে? আমার ছোট ভাইটার কী হবে? সে কীভাবে কলেজে যাবে? বন্ধুদের সাথে কীভাবে আড্ডা দেবে? সবাই তো সবকিছু জেনে যাবে নিমিষেই। এখন আমার মৃত্যু ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।
সায়মা আবার উঠে দাঁড়িয়ে অনুপের পায়ে ধরে অনুনয় বিনয় করে বলতে থাকে, তুমি দয়া করে এমনটি করো না। আমি তো তোমাকে ভালোবেসেছি। তোমাকে আমি বিশ^াস করেছি। তাহলে কেনো তুমি আমার সাথে এমন আচরণ করবে? এটা করা তোমার উচিত হবে না। দয়া করে, আমার সাথে এমন কাজ করো না। যদি আমার সাথে এমন কর, তাহলে আমি আত্মহত্যা করবো। এছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকবে না।
অনুপ হিং¯্র বাঘের মতো হুংকার দিয়ে উঠলো। আর বললো, আমি ইন্টারনেটে ছেড়ে দিবো। এখন তুমি প্রতিদিনই আমার কাছে ছুটে আসতে বাধ্য। যদি তুমি আমার কাছে না আস, তাহলে আমি ইন্টারনেটে ছেড়ে দিলে সবাই তোমাকে দেখবে। তুমি কোথাও মুখ দেখাতে পারবে না। তোমার জীবন এখন আমার হাতে, তোমার সম্মান আমারই হাতে। তোমাকে প্রতিদিনই আমার কাছে আসতে হবে আর আমাকে আনন্দ দিতে হবে।
সায়মা অনেকটা উন্মাদের মতো হয়ে গেলো। একেবারে বাধ্য মেয়ের মতো বলতে লাগলো, তুমি দয়া করে এমনটি করো না। তুমি যখন যা বলবে আমি তাই করবো।
অনুপ হাসতে হাসতে বললো, তুমি এখন আমার খেলার পুতুল। আমার কথায় উঠবে, আর বসবে। তুমি আর আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারবে না।
সায়মা হাতজোড় করে বললো, আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে, কেনো তুমি আমার সাথে এমন আচরণ করছো? তুমি আমার বিশ^াসের সুযোগ নিয়েছো, আমার পবিত্র ভালোবাসা কলঙ্কিত করছো। কী আমার অপরাধ?
অনুপ হুংকার দিয়ে বলে উঠলো, আমাদের ঘরের পেছনের জায়গাটা তোমার বাবা আমাদের কাছে বিক্রি করেনি। তাই তোমার সাথে আজ ভালোবাসার অভিনয় করে তোমার সর্বনাশ করতে বাধ্য হলাম।
সায়মা বললো, ঐ জায়গা তো আমাদের।
অনুপ বললো, সেটা আমাদের পছন্দ। কিন্তু তোমার বাবা আমাদের কাছে বিক্রি করলে আমাদের উপকার হতো। এখন তোমার বাবাকে বুঝিয়ে জায়গাটি আমাদের করে দাও। আর তুমি প্রতিদিন আমার কাছে আসবে। তাহলে তোমার কোনো বদনাম হবে না।
সায়মা নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। এরপর বুকের মধ্যে চাপা কষ্ট নিয়ে, মুখে হাসি ছড়িয়ে সে অনুপের কাছ থেকে চলে গেলো।
দুই.
দীর্ঘসময় অনুপ হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে রয়েছে। তার দু’পা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। দুই হাত পেছনে বাঁধা। পেটসহ পুরো শরীরর চেয়ারের সাথে কয়েক প্যাটে ঘুরিয়ে বাঁধা রয়েছে। মুখ গামছা দিয়ে শক্তভাবে বেঁধে দেয়া হয়েছে। অনুপের জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে আবিষ্কার করলো, তাকে এখানে অজ্ঞান করে নিয়ে আসা হয়েছে। ওরা ঠিক পেছন থেকে ছুটে এসে নাকের মধ্যে রুমাল দিয়ে সজোরে ধরেছে, আর একটু পর অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর আর কিছুই জানে না অনুপ।
অনুপকে এমনভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে যে, কোনোভাবেই নড়াচড়া করার উপায় নেই। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে ঘাড়ের পেছনে ব্যাথা অনুভব করছে, এরপর দুই পায়ে ভীষণ ব্যথা শুরু হয়েছে। হাত দু’টো টনটন করছে। কালো কাপড়ে অনুপের দু’চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না, কিছু বোঝাও যাচ্ছে না যে এখন সে কোথায় আছে। তার প্যান্টের পকেটেই মোবাইলটা ছিলো। সে বুঝতে পারলো, পকেটে তার মোবাইল নেই। যদি থাকতো, তাহলে এতক্ষণে কেউ না কেউ ফোন করতো।
এমন একটা ঘরের মধ্যে অনুপকে এনে রাখা হয়েছে, যেখানে কোনো মানুষজন থাকে না। পরিত্যক্ত একটি ঘর। বাইরের কিছু পাখি আর ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যায়, আর বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজই কানে ভেসে আসে। অনুপ নড়াচড়া করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
বেশ কিছু সময় পর কয়েক মানুষের হাঁটার শব্দ শোনা যায়। তারা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কী সব বলাবলি করছে। এতোটাই অস্পষ্ট যে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বেশ কিছু সময় পর দরজা খোলার শব্দ পায়। ওরা দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। দৃঢ় পদক্ষেপে অনুপের দিকে এগিয়ে আসে। ওরা একসাথে কতোজন সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
‘লাঠিটা নিয়ে আয় তো, তাড়াতাড়ি বেটাকে মেরে ফেলি’ কথাটা অনুপের কানে ভেসে এলো। এতে বোঝা যাচ্ছে, ওদের সবার মুখে কাপড় বাঁধা।
কেউ একজন মোটা লাঠিটা পায়ের কাছে ফেলে দিলো। অনুপ বুঝতে পারলো, এবার আরো মার খেতে হবে।
একজন সজোরে ঘুষি মেরে বললো, সায়মা মেয়েটি অত্যন্ত সহজ সরল, সে তোকে ভালোবেসে ছিলো। আর তুই তাকে ভালোবাসার বদলে কী দিলি। তার ভালোবাসাকে অপবিত্র করলি। তার বিশ^াসকে নষ্ট করলি। আজ তোকে মরতেই হবে। তোর বাঁচার কোনো উপায় নেই।
‘ধাঁরালো ছুরিটা নিয়ে আয়তো’ এই বলে অনুপের গলার কাছে হাত রেখে আবার বললো, ঠিক এই জায়গায় ছুরিটা বসিয়ে কাটতে হবে। তাহলে গলাটা বেশ ভালোভাবেই কাটবে। কামারকে দিয়ে ছুরিটা ধার করিয়ে এনেছি। কোনো কষ্ট হবে না।
অনুপ একটু একটু নড়তে পারে। সে তার ভাবে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করছে যে, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি যা’ করেছি অন্যায় করেছি। এসবার বলার মতো পরিস্থিতিও তার নেই। কেননা তার মুখ বাঁধা রয়েছে।
‘আমার বুকে বেশি জ¦ালা। আমি তাকে মেরে ফেলবো। আমি আর এক মুহূর্ত তাকে বেঁচে থাকা দেখতে পারছি না। আমার পরিবারের মান সম্মান নিয়ে সে ছিনিমিনি খেলেছে। আমি তাকে শেষ করে দেবো। ছুরিটা আমার হাতেই দাও। আমি তাকে কোপ বসিয়ে দিই।’-এসব বলতে বলতে সে কাঁদতে লাগলো।
অনুপ বুঝতে পারলো, এটা সায়মার ছোট ভাই নিশ্চয়।
‘না ভাই, আমরা তাকে মারবো না। বরং আমরা তাকে পুলিশের হাতে দিয়ে দিই।’
‘না, না, না, কোনো দরকার নেই। ঐ ভুল করা যাবে না। থানা পুলিশ করে কোনো লাভ নেই। অপরাধ প্রমাণিত হতে হতে দীর্ঘদিন লেগে যাবে। তারপর একসময় সে ছাড়া পেয়ে যাবে। তাছাড়া ওর বাবার অনেক টাকা-পয়সা। কোনো অভাব নেই। সুতরাং দাপট আছে। আর এই অন্যায় কাজ থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে। এই অমানুষের কোনো বিচারই হবে না। সব অন্যায়ের বিচার সঠিকভাবে হয়নি কোনোদিন, হবেও না। যুক্তিতর্কে ছাড়া পেয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমরাই তাকে মেরে ফেলবো। আমরাই তার বিচার করবো।’
‘আইন হাতে তুলে নেয়া অন্যায়-।’
‘সঠিক বিচার করতে পারলে আইনই হাতে তুলে নেয়া ন্যায়। তাহলে উচিত বিচার করা যায়। এতে কোনো দীর্ঘসময় লাগে না, থানা পুলিশের ঝামেলা নাই, উকিলের টাকা লাগে না, সময় নষ্ট হয় না, টাকা পয়সা খরচ হয় না, কোনো ঝামেলা হয় না।’
ঘরে থাকা ফাঁটা একটা বাঁশ দিয়ে ঠাস করে এক বাড়ি দিয়ে বাম হাতটা ভেঙ্গে দিলো। ভীষণ ব্যথা করছিলো অনুপের। শুধু গোঙানির একটা শব্দ করতে পারলো মাত্র। প্রচÐ ব্যথায় একসময় অনুপের বাম হাতটা অবশ হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারলো, আজ আর তাকে বেঁচে ফিরতে হবে না। ওরা তাকে মেরেই ফেলবে।
একজন রড দিয়ে সজোরে মাথায় বাড়ি দিয়ে মাথাটা ফাঁটিয়ে দিলো অনুপের। ‘তোর মতো অমানুষের কোনো ক্ষমা নেই। তোকে ছেড়ে দিলে বড় অন্যায় হবে। তোর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আজ তোকে মরতেই হবে।’
তারপর একজন চেয়ার থেকে সমস্ত বাঁধন খুলে দিলো। আর ছুরি দিয়ে গলা কেটে দেহ থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করলো। আর লাল রক্তে ভেসে গেলো মেঝে। মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে অমানুষের দেহটা পরিত্যক্ত ঘরের মধ্যে গর্ত করে পুতে দিলো।
‘এই পরিত্যক্ত ঘরটি নির্মাণাধীন কোনো ধনী ব্যক্তির অট্রালিকা। কিছুদিন কাজ করার পর অজ্ঞাত কারণেই কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। ধনীদের কোনো কোনো কাজ অজ্ঞাতই থাকে। কেননা টাকার জোরে মনমর্জি মতো যখন যা খুশি তাই করতে মন চায়। যেমন টয়লেটে যদি ফ্যান থাকে তাহলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।’
‘তুই তো বেশ মজা করেই কথা বলছিস।’
‘হ্যাঁ, আমার বেশ মজাই লাগছে।’
‘আমাদেরও লাগছে। কেননা আমরা একজন বোনের সম্মান রক্ষা করতে পেরেছি। সমস্ত প্রমাণ ধ্বংস করতে পেরেছি।’
‘পুলিশ যদি জানতে পারে?’
‘না, কোনোভাবেই জানতেই পারবে না।’
‘কীভাবে?’
‘কিছুদিন পর এই ভাবনের কাজ শুরু হবে। তখন ট্রাক ভরে ভরে এখানে বালি ফেলা হবে। আরো উঁচু করা হবে। আর এই অট্রালিকা কোনোদিন ভাঙ্গা হবে না। সুতরাং প্রমাণও থাকবে না।’
‘সমাজের খারাপ মানুষদের এভাবেই নাই করে ফেলা উচিত।’
ভাইকে দেখে সায়মা কেঁদে দিলো। ‘আর কোনো ভয় নেই’ বোনের কানে কানে ফিস ফিস করে বলতে বলতে সায়মাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো। তবুও সায়মার মনে ক্ষত থেকেই যায়।
কয়েকদিন পর এলাকায় গুঞ্জন শোনা যায়, অনুপকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা সবাই রাস্তার পাশে চা দোকানে আড্ডায় জমে আছে। এমন সময় পুলিশের কয়েকজন লোক এসে চা দোকানের দিকে আসতে থাকে। ওরা স্বাভাবিকভাবে পুলিশের দিকে তাকায়। বাতাস না থাকলে যেমন গাছের পাতা নড়ে না, তেমনি প্রমাণ না পেলে পুলিশও তাদের ধরবে না।
–সমাপ্ত-