ক্ষুদীরাম দাসের গল্প : সেক্রিফাইস

বারো বছর আগের কথা।
তপু অনেক ভেবেচিন্তে ঘরে ঢুকে মাকে বলেছিলো, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
সেদিন তপুকে অন্য রকম দেখা যাচ্ছিলো। দেখেই মনে হচ্ছে, সে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলবে। তাই সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। তারপর তপু মাকে বললো, মা, বাবা মারা গেছে। সংসারের আয় তো কমে গেছে, এখন ছোট ভাই-বোনদের কথা চিন্তা করে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি পড়াশোনা বন্ধ করে দেই। আমি কোনো কাজ করি। তা না হলে পেট চলবে না। তাছাড়া ওদের পড়াশোনাও তো করতে হবে। এখন আমিও যদি বড় ভাই হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাই, তাহলে কীভাবে জীবন চলবে?
মা হয়ে ছেলের মুখে এসব শুনে প্রতিউত্তরে কোনো কিছু বলতে পারছিলো না। বড় হিসেবে তপুকেই সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে। সুতরাং মায়ের মনে যতই দুঃখ হোক না কেনো, তবুও মা হয়েও ছেলেকে এই অনুমতি দিতে বাধ্য হলো।

সেই থেকে শুরু হয়ে গেলো সংসারের ঘানি টানা। সমবয়সীরা তপুর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তার জীবনের অবস্থা দেখে। তারা শুধু আপসোসই করতে লাগলো; কিন্তু কোনো গতি তপুর জন্যে করতে পারলো না। দিন রাত পরিশ্রম করেই গেলো। খেয়ে না খেয়ে চা দোকান হতে শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান সেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেই গেলো। আর সংসারকে টাকা দিয়েই গেলো। সেই সাথে ভাই বোনকে উৎসাহিত করেই গেলো যেন তারা ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারে, সুশিক্ষা যেন তারা পেতে পারে।
আর আজ বারো বছর পর দুঃখে দীর্ঘশ^াস ছেড়ে মনে মনে বলে, কী পেলাম ভাই বোনদের কাছে মূল্য। এতো পরিশ্রম, এতো খাটুনি খেটেই গেলাম; নিজের জন্যে কোনো টাকা পয়সা রাখলাম না, তাদের জন্যে দিয়েই গেলাম। অথচ ওরা সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। এসব চিন্তা করতে করতে ঘাড় থেকে গামছা নামিয়ে মুখমÐল মুছতে থাকে। লবণাক্ত ঘাম জিভে লেগে যায়। জিভ দিয়ে ভালোভাবে স্বাদ গ্রহণ করে সান্ত¡না খুঁজে পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। ঘামের ম্পর্শে চোখ দুটি জ¦ালাপোড়া করছে। এদিকে ওদিক তাকিয়ে দেখে ছোট চায়ের দোকানের সামনে একটি চাপকল রয়েছে। রাস্তা পার হয়ে গিয়ে চোখে ঠাÐা জলের ঝাপটা দিয়ে কিছুটা ফ্যেস হওয়ার চেষ্টা করলো। চা দোকানীকে এক কাপ চা দিতে বলে আবার নিষেধ করে দিলো। পাঁচ টাকা খরচ করতে রাজি হয় না। অন্তত চা না খেয়ে পাঁচ টাকা বাঁচাতে পারলে ঐ টাকায় ধনে পাতা কিনে ভর্তা খাওয়া খেয়ে একবেলা পার করা যাবে।

দুঃখের দিনে ছোট ভাইটিও তপুর খোঁজ রাখে না। এক মাসে অসুস্থতায় কয়েকদিন কাটিয়ে দিলো, তবুও ভাই তার কোনো খোঁজ খবর নিলো না। নিজের মানুষ এমন করলে বড় কষ্ট লাগে। কিন্তু এসব দুঃখের কথা কাউকে বলতে যায় না তপু। শুধু নিঃশব্দে রোদন করেই চলে। মাঝে মাঝে তপুর মাও দীর্ঘশ^াস ছাড়ে; কিন্তু তপুকে সান্ত¡না দেয়ার মতো কোনো ভাষা খোঁজে পায় না।
বারান্দায় বসে তপু চা খাচ্ছে বসে। এমন সময় বয়স্ক একজন ব্যক্তি বাড়িতে ঢুকে তপুকে খোঁজ করছিলো। তপু অপরিচিত লোকটিকে ভালোভাবে দেখছিলো। চেনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। মাথায় সাদা চুল। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি রয়েছে। ডান বগলে একটি ছাতা রয়েছে। বাম হাতে একটি চটের ব্যাগ। তপু এগিয়ে যায় লোকটির কাছে।
লোকটি হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে, তোমার নাম তপু তাই না? আমি সুরেন্দ্র। তোমার বাবার বন্ধু। ছোট বেলায় তোমাকে দেখেছি, তখন তুমি অনেক ছোট ছিলে।

তপু ঃ আমি আপনাকে মোটেও চিনতে পারছি না।
সুরেন্দ্র ঃ তোমার চিনবার কথা নয়। তুমি আমাকে ছোট বেলায় দেখেছো। তোমার মা আমাকে চিনতে পারবে।
তপু ঃ আপনি ভেতরে আসুন। আমার মা কোথাও গিয়েছেন।
সুরেন্দ্র ঃ ঠিক আছে। তোমার মা আসলে আমার পরিচয়টা ভালোভাবে জানতে পারবে।
তপু ঃ তবুও আপনি বসুন।
লোকটি নিঃসংকোচে ঘরে ঢুকে গেলো এবং বারান্দায় তপুর পাশের চেয়ারটিতে বসলেন। লোকটির ভেতরে ঢোকা ও নির্ভরতায় স্পষ্ট যে তিনি বাবার বন্ধুই বটে।
লোকটি কাশতে কাশতে বললেন ঃ তোমার বাবার মৃত্যুর খবর আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও তখন আমি আসতে পারিনি। সেই দুঃখটা আমাকে আজো কষ্ট দেয়। আমরা দু’জন একসাথে ব্যবসা করতাম। আমার একটা ছোট দোকান ছিলো, আর তোমার বাবার সবজির ব্যবসা। আহা রে, লোকটা কতো ভালো মানুষ ছিলেন।
তপু ঃ তো আপনাকে দেখে আমি খুশি হয়েছি। আপনি আমাদের দেখতে আসলেন, এজন্যে আমরা আনন্দিত।
সুরেন্দ্র ঃ আমিও খুবই খুশি।
তপু ঃ বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন নাকি?
সুরেন্দ্র ঃ তোমাদের দেখতে আসাটাই সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য। তবে সেই সাথে অন্য একটি গুরত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য রয়েছে।
তপু ঃ বলুন!
সুরেন্দ্র ঃ আমার ছেলেটা বড় হয়েছে। সে মাস্টার্স পাস করেছে। তোমার বাবার সাথে কথা ছিলো, বড় হলে তোমার ছোট বোনটাকে আমার ছেলের বউ করে নিবো। সে অবশ্য আমার মেয়ের মতোই থাকবে।
তপুর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। লোকটিকে কী উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। তপু উঠে দাঁড়ালো।
সুরেন্দ্র ঃ না, না, তুমি যদি এ বিষয়ে বিব্রতবোধ কর, তাহলে তোমার মায়ের সাথেই কথা বলবো।
তপু ঃ সেটার দরকার হবে না কাকা। আমিই আপনাকে উত্তর দিতে পারবো।
সুরেন্দ্র ঃ অবশ্য তোমাদের যদি আপত্তি থাকে, আমার প্রস্তাবে যদি রাজি না থাক, তাহলে আমি আমার কথা ফিরিয়ে নেবো। এ নিয়ে কোনো মুখ কালাকালি হবে না।
তপু ঃ আমার কোনো বোন নেই।
সুরেন্দ্র ঃ কী বলছো বাবা তুমি।
তপু ঃ ঠিকই বলছি।
সুরেন্দ্র ঃ মানে কী? আমি তো জানি তোমরা দুই ভাই, একবোন। তোমাদের একটা ছোট বোন আছে।
তপু ঃ একসময় ছিলো। কিন্তু এখন নেই।
সুরেন্দ্র ঃ মানে? আমাকে একটু পরিস্কার করে বলতো তো বাবা।
তপু ঃ সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমাদের অমতে ভিন্ন ধর্মী ছেলেকে বিয়ে করে আমাদের মুখে চুন কালি মেখে চলে গেছে। এরপর থেকে আমরা তার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখি না। আমরা কোনো খোঁজ খবরও নিই না।
সুরেন্দ্র ঃ আর তোমার ছোট ভাই?
তপু ঃ সেও বিয়ে করে আলাদা থাকে।
সুরেন্দ্র ঃ কোথায় থাকে?
তপু ঃ দূরে থাকে। অন্য জেলাতে এনজিও তে চাকুরি করে। আমাদের সাথে যোগাযোগ নাই।
সুরেন্দ্র ঃ কেনো?
তপু ঃ কাকা, আপনাকে আমি দুঃখের কথা বলতে চাই না।
সুরেন্দ্র ঃ আমি শুনেছি, তোমার বাবার মৃত্যুর পর তুমিই এই সংসারের হাল ধরেছিলে। তুমি জীবনে অনেক কষ্ট করেছো। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে তোমার পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়েছে। দিনরাত তুমি পরিশ্রম করেছো। সবাইকে দিতে দিতে তোমার নিজেরই কিছুই রইলো না।
তপু ঃ থাক, কাকা এসব কথা বলে আর দুঃখ বাড়াতে চাই না। ওরা ওদের মতো ভালো থাকুক।
সুরেন্দ্র ঃ ওরা তো তোমার সেক্রিফাইসের মূল্য দিলো না। তোমার ছোটটা চলে গেলো; আর ভাইটা তোমার খোঁজ নেয় না। তোমাকে চিনে না।
তপু ঃ হয়তো এটাই আমার প্রাপ্য ছিলো।
সুরেন্দ্র ঃ বড় ভাই হিসেবে তোমার দায়িত্ব তুমি যথাযথভাবেই পালন করেছো। এ দিক থেকে তুমি কোনো কার্পণ্য করোনি, সেটা তোমাকে দেখেই বোঝা যায় না। এজন্যে তোমার মনে খুবই দুঃখ রয়েছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। আর সেই সাথে আমিও দুঃখ পেয়েছি।
তপু ঃ কেনো?
সুরেন্দ্র ঃ তোমার বোনটাকে নিতে পারলাম না। আমি তাহলে উঠি, আমি আর তোমার সাথে কথা বলতে পারছি না।
বাড়ির দিকে দৌঁড়াতে দৌড়াতে দু’জন লোক ঢুকলো। এজন বললো, আপনার ভাই সদর হাসপাতালে, এক্সিডেন্ট করেছে। তাড়াতাড়ি সেখানে চলে যান। মনে হয় বাঁচানো যাবে না।
শুনে বয়স্ক লোকটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তপুর দিকে। তারপর ঐ দু’জনের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না।
তপুর মনটা হু হু করে কেঁদে উঠলো। তাড়াতাড়ি তপু উঠে দৌঁড়াতে লাগলো ঐ দু’জনের সাথে। তার পেছন পেছন ঐ বয়স্ক লোকটাও দৌঁড়াতে লাগলো; আর মনে মনে বললো, এটাই ‘সেক্রিফাইস’।
— সমাপ্ত–