ক্ষুদীরাম দাসের ছোট গল্প বেহিসেবী

‘গৌরি সেন’ নামটার মধ্যে ধনী ধনী অথবা বেহিসেবী উদারতার ভাব রয়েছে। এ নামে ডাকলে কমলেশ^র সেন খুবই খুশী হতেন। তাই এ নামেই সকলে ডাকতে পছন্দ করেন। তার চালচলনে একটা আলাদা উচ্চ উচ্চ ভাবের পাশাপাশি খানদানি ভাবটা তার রয়েছে। তার সাথে যারা চাকুরি করেন একই বেতন পেয়েও তিনি বেশ জাঁকজমকের সাথেই জীবনযাপন করতেন। খাওয়া দাওয়া হতে শুরু করে পোশাকেও আলাদা একটা জৌলসতা দেখা যেতো। সুতরাং সকলের অভাব থাকলেও মনে হতো যেন তার কোনো অভাব বলে কিছু নেই। সবসময় ভালোভাবে চলতে পছন্দ করতেন। স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের কোনো অভাব অপূরণ রাখতেন না, কোনো চাহিদাই বাকি রাখতেন না। দূর থেকে দেখে সকলেই গৌরি সেনের সংসারকে সুখী সংসার মনে করতেন। গৌরি সেনের সংসার একটি সমান্তরাল অভ্যাসের মধ্য দিয়ে স্ট্যান্ডার্ডভাবে চলছিলো।

হঠাৎ একদিন কমলেশ^র সেন মারা গেলেন। একদিন দু’দিন তিনদিন করে দুই মাস কেটে গেলো। ধীরে ধীরে অভাব শুরু হলো গৌরি সেনের সংসারে। ঠিক আগের মতো আর চলতে পারছিলো না সংসারটি। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে যে অভ্যাসে অভ্যস্ত সেভাবে তারা দিনাতিপাত করতে পারছেন না। পরিবারের সকলের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। ছেলেটি বয়স আঠারো পার হয়ে উনিশে পরলো মাত্র। মা নিলীমা সেন একদিন ছেলেকে বললেন ঃ তুমি কোনো কাজ করলে আমরা কোনো রকমে চলতে পারতাম।
রাখাল ঃ এটা কী বলছো মা? আমি এখন কী কাজ করবো? আমি তো কোনো কাজই করতে পারি না।

নিলীমা ঃ তাহলে আমরা কীভাবে চলবো? তোমার বোন কী খেয়ে বাঁচবে? জমানো হাতে যে টাকা ছিলো তা তো শেষ হয়ে গেছে।

রাখাল ঃ আমি কলেজে যাবো, আমার তো জুতা ছিঁড়ে গেছে, আরেক জোড়া ভালো জুতা দরকার, নতুন আরেকটা ব্যাগ দরকার।
নিলীমা ঃ এখন আর সেই আশা করার দরকার নেই।
পাশের রুম থেকে রাখালের ছোট বোন মিতু এসে ঢুকলো তাদের রুমে। বললো ঃ আমরা এখন কীভাবে চলবো?
কথাটি বলেই বিছানার উপর বসে পরলো। এভাবে সকলেই বসে রইলো। বেশ কিছুসময় তারা চিন্তা করতে লাগলো, এভাবে তারা কোনোদিন চিন্তা করেনি। ‘আমরা এখন কীভাবে চলবো?’ এই চিন্তা তাদের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কোনো উপায় তারা খুঁজে পেলো না। অন্যদিকে আশপাশের মানুষজনও তাদের জন্যে কোনো চিন্তা করার প্রয়োজনই মনে করেনা। কেননা সকলেই জানে পরিবারটি স্বচ্ছল। এতোদিন তারা দেখেছে গৌরি সেনের পরিবারটি স্বচ্ছলভাবেই চলেছিলো। সুতরাং এখনও আগের মতোই হবে। তাই চিন্তা করার কোনো প্রশ্নই আসে না।

একদিন বাজার থেকে একজন মুদি দোকানদার গৌরি সেনের বাড়িতে হাজির। এসেই গৌরি সেনের বাড়ি খোঁজ করছিলো। মানুষজন দেখিয়ে দিলো।
বাড়িতে ঢুকতে দেখে নিলীমা সেন তাকে বসতে দিলেন। তারপর তাদের পরিবারের সকলের দিকে তাকালেন। তাদের কিছু সময় সান্ত¡না দিলেন গৌরি সেনের মৃত্যুর জন্যে। তারপর তিনি বললেন ঃ আমি শুনেছি তিনি মারা গেছেন। কিন্তু দেখতে আসা সম্ভব ছিলো না। তিনি আমার দোকানে প্রতিদিনই যেতেন। তাই তার সাথে আমার আলাদা সখ্যতা গড়ে উঠেছে। তিনি আমাকে খুবই ভালোবাসেন এবং পছন্দ করেন। মাঝে মাঝে তিনি আমাকে চা পানি খাওয়াতেন, আবার আমিও তাকে চা পানি খাওয়াতেন। এভাবে আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
নিলীমা ঃ ধন্যবাদ আপনি এসেছেন।
মুদি দোকানদার ঃ তবে দিদি একটা কথা বলবার জন্যে এসেছি।
নিলীমা ঃ কী কথা।

মুদি দোকানদার ঃ সেটি হলো আমার দোকানে বেশ কিছু টাকা বাকি করেছেন। দেখুন, এটা তো আমার পুঁজি। আমিও চলতে পারি না। আমার পুঁজিটা যদি এভাবে আটকে থাকে তাহলে আমি বাঁচতে পারবো না। যদি দয়া করে আমার টাকাগুলো দিতেন তাহলে আমার বড় উপকার হতো। আমার বাকির খাতায় তারিখ অনুযায়ী সবই লেখা রয়েছে কোনদিন কতো টাকা বাকি করেছেন।
নিলীমা ঃ কতো টাকা হবে?
মুদি দোকানদার ঃ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার মতো হবে।
টাকার পরিমাণের কথা শুনে সকলে হা হয়ে গেলো। পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলো। নিলীমা সেনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরেছে। রাখাল আর মিতু মাথা নিচু করে রইলো। তারা ভালো, ভাবা কীভাবে এতো টাকা বাকি করেছেন?
নিলীমা ঃ দাদা, আমাদের হাতে তো এতো টাকা নেই। এখন আমি দিতে পারবো না।
মুদি দোকানদার ঃ কী বলছেন এসব কথা। আমার তো আজই টাকার দরকার।
নিলীমা ঃ কীভাবে সম্ভব এতোগুলো টাকা পরিশোধ করা।

মুদি দোকানদার ঃ আমি তো জানি, আপনারা অনেক টাকার মালিক। তাছাড়া গৌরি দাদার চেহারা, হাবভাব দেখে তো সে রকমটি মনে হয়নি। তাছাড়া আমিও তো আপনাদের দেখে সে রকমই মনে করছি। এই কয়টা টাকা তো আপনাদের জন্যে কিছুই না। ইচ্ছা করলে তো যে কোনো সময়ই আপনারা পরিশোধ করতে পারেন।
নিলীমা সেন হাতজোড় করে অনুরোধ করলেন, আরো কিছু দিন সময় দেয়ার জন্যে। মুদি দোকানদার বিড় বিড় করতে করতে চলে গেলেন।

ঠিক দু’দিন পর কাপড় দোকানদার এসে তাদের বাড়িতে ্হাজির হলো। তিনিও ঘরে ঢুকে তাদের কাছে বাকি ত্রিশ হাজার ত্রিশ টাকার কথা বলে গেলেন। এভাবেই ঔষধের দোকান, মাছের বাজারের মাছ বিক্রেতা, তরকারি বাজারের তরকারি বিক্রেতারাও এসে বাকি টাকা চাইতে আসলেন। তাছাড়া ব্যাংকের লোকজন লোনের টাকা পরিশোধের জন্যে আসলেন, চারটি সমিতি থেকে লোনের টাকার জন্যেও মানুষজন তাদের বাড়িতে ঘন ঘন আসতে লাগলো।
নিলীমা সেন ও তার ছেলেমেয়ে রাখাল ও মিতু বিরক্ত হচ্ছিলো। তারা রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিলেন। ঘন ঘন তাদের বাড়িতে মানুষজনের আনাগোনায় তারা হাঁপিয়ে উঠছিলো। তাদের কিছুই ভালো লাগছিলো না। অপরদিকে আগের তো আর তারা চলতেও পারছিলেন না। এ বিষয়টি তাদের জন্যে আরো বেশি অসহ্যের হয়ে গেলো।

অভ্যাস মানুষকে আঁকড়ে ধরে। যে অভ্যাস রপ্ত করা হয় সেই অভ্যাসেই মানুষের দৈনন্দিন জীবন চলমান থাকে। সেই অভ্যাসে ব্যাঘাত ঘটলে চরমভাবে তিক্ততা চলে আসে। আবার সেই অভ্যাস থেকে বেড়িয়েও আসা যায় না। বেড়িয়ে আসতেও চায় না মন। তবে পরিস্থিতিতে মানুষ বাধ্য হয়। মানুষের জীবন সবসময় এক রকমভাবে চলে না। এটাকে সান্ত¡না হিসেবে বললেও ভুল নয়। চরম বাস্তব সত্য কথা এটি। আর গৌরি সেনের পরিবার যেভাবে সমাজের চোখে চলে এসেছিলো, তার মৃত্যুর পরই পরিবারটি আর সেভাবে চলতে সক্ষম নয়। উপরন্তু তিনি বেহিসেবীভাবেই চলছিলেন। তবে গৌরি সেন সংসারে যে সুখী ছিলেন সেটাও নয়। তিনি অত্যন্ত মানসিক যাতনায় জ¦লছিলেন। এই মানসিক যাতনার কথা নিজের মনের মধ্যেই চেপে রেখে ছিলেন। কাউকে বলেননি, অথবা বলার মতো পরিস্থিতিও ছিলো না। ভালো চাকুরি করতেন বটে, কিন্তু বেতনের টাকার চেয়ে বেশি টাকা সংসারের জন্যে তাকে খরচ করতে হয়েছিলো। একটি ধনী ঘরের মেয়ে নিলীমাকে বিয়ে করে এনে অসমযোয়ালিতে আবদ্ধ হলেন। ধনী ঘরের মেয়ে বিয়ে করায় বাপের বাড়ির মতো চাহিদা মেটাতে তিনি স্বামীর উপর চাপ দিতেন। গৌরি সেন তাকে অনেক বুঝিয়েও বোকা ও জেদি মহিলাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হলেন। অপরদিকে দুই ছেলেমেয়েকেও নিলীমা সেন নিজের মতো করে চলতে শিখিয়ে ছিলেন। কিন্তু এটা কোনো বুঝতে চেষ্টা করেননি যে, এভাবে তাদের জীবন চিরদিন যাবে না। গৌরি সেন মাঝে মাঝে বলতেন, যে পরিমাণ আয় সংসারের খরচ তার চেয়ে কম করা উচিত। এই খরচের মধ্যে যেভাবে সাধ্য ঠিক সেইভাবেই চলা বুদ্ধিমানের। এরচেয়ে বেশি দূর যাওয়া বোকামিই মাত্র। নিলীমা সেন সেটা কোনোদিন বুঝতে চেষ্টা করেননি। অন্যদিকে ছেলেমেয়েরাও কোনো সেটা বুঝেনি, বোঝার চেষ্টা করার কথাও নয়। আর এখন নিলীমা সেন বুঝলেও ছেলেমেয়েরা বুঝতেই চায় না। কিন্তু পরিস্থিতি তাদেরকে আরো যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে চলতে বাধ্য করছে, যদিও মেনে নেয়াটা তাদের জন্যে কষ্টের হচ্ছে।
ব্যাংকের লোন পরিশোধের জন্যে উকিল নোটিশ চলে এসেছে। অন্যদিকে পাওনাদাররা ঘন ঘন তাদের বাড়িতে আসায় তারা দিশেহারা হয়ে গেলো। অন্যদিকে নিলীমা সেনের বাপের বাড়ির লোকজনও তাদের খোঁজ খবর রাখা বন্ধ করে দিলেন। তারাও নিলীমা সেনের উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। কেননা নিলীমা সেনকে তারা অনেক বুঝিয়েছেন, অনেক উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু অবশেষে ব্যর্থ হয়ে তারাও নীরব হয়ে গেলেন। নিলীমা সেনের নির্বুদ্ধিতা ও আচরণের জন্যে তারাও ক্ষুব্ধ ছিলেন। এভাবেই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়; আর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেলে সেখানে ভালোবাসার বৈশিষ্ট্যগুলোরও মৃত্যু ঘটে।

একদিন নিলীমা সেন তারা ছেলেমেয়েদের সাথে বসলেন। কীভাবে কী করা যায় সেই আলোচনা করতে লাগলেন।
নিলীমা ঃ আমাদের বাড়িটা বিক্রি করা দরকার। বাড়ির বিক্রির টাকায় লোনগুলো শোধ করতে হবে।
রাখাল ঃ আমাদের কত টাকা লোন রয়েছে?
মিতু ঃ বাড়ি বিক্রি করলে আমরা থাকবো কোথায়?
নিলীমা ঃ ভাড়া করতে হবে।
রাখাল ঃ বাড়ি ভাড়া করবে থাকবো? নিজের বাড়িতে থেকে যে স্বাধীনতায় ছিলাম, সেটাতো ভাড়া বাড়িতে পাবো না।
মিতু ঃ হুঁম!
নিলীমা ঃ এছাড়া উপায় কী?
রাখাল ঃ কতো টাকা লোন রয়েছে?
নিলীমা ঃ সবমিলিয়ে নয়শ লাখ টাকা!
মিতু ঃ বাড়ি বিক্রি করলে আমরা কতো টাকা পেতে পারি?
নিলীমা ঃ সাত লাখ টাকার মতো!

রাখাল ঃ মাত্র। এই টাকায় তো লোনের টাকা কোনোভাবেই পরিশোধ হবে না। বাকি টাকা কীভাবে পরিশোধ করবো?
নিলীমা ঃ আমারও তো মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো। কী করবো বুঝতে পারছি না।
রাখাল ঃ ‘কী করবো বুঝতে পারছি না’ সেটা আমাদের শেখানো উচিত ছিলো। আমাদের সেইভাবে চালানো দরকার ছিলো। বাবা তো মরে গিয়ে বেঁচে গেলেন। আমাদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে যেখানে সেখানে বাকি করা, আর বাকির টাকা পরিশোধ করতে লোন করার কোনো দরকারই ছিলো না।
নিলীমা ঃ বাঁচার জন্যেই তো এসব করেছিলাম।
মিতু ঃ তুমিই তো বাবাকে বেশি চাপ দিয়েছিলে।
রাখাল ঃ এভাবে মাকে দায়ী করা ঠিক হবে না। আমরাও কম দোষে দোষী নই। তাছাড়া বাবারও শক্ত হওয়া দরকার ছিলো। কিন্তু বাবা শক্ত হতে পারেননি। এজন্যে আমরা সকলেই দায়ী। আমাদের চাহিদাই বেশি ছিলো।
নিলীমা ঃ আমরা এখন আর কী করতে পারি?
মিতু বিড় বিড় করে বললো ঃ বেহিসেবীভাবে চললে জীবনে এমনই দুর্ভোগ নেমে আসে।
নিলীমা ঃ কী বলছো তুমি?
তাদের পরিবারের সকলেরই এখন একই প্রশ্ন-এখন কী করতে পারি? কিন্তু তারা অনেক ভেবে চিন্তেও কোনো কুলকিনার পেলো না। কেননা বাড়ি বিক্রির টাকাতেও ঋণের বোঝা মাথা থেকে নামবে না। তবে চারিদিকের পাওনাদারদের চাপাচাপিতে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিলো।

একদিন খুব ভোরে একজন ভদ্র মহিলা গৌরি সেনের ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, গৌরি সেনের ঘরে তালা ঝুলছে। তিনি এটিকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে কোনো প্রশ্ন মাথায় নিলেন না। পরের দিনও একই অবস্থা কয়েকজন লক্ষ্য করলেন। তারাও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। তারা ভেবেছেন, হয়তো তারা কোথাও বেড়াতে গিয়েছে। পাওনাদারেরা এসে তাদের খোঁজ করছিলেন, তখনই পাড়ার লোকজনদের হোঁশ হলো। লোকজন তাদের বাড়িতে ভিড় করা শুরু করলো। সকলে বলতে লাগলো, কয়েকদিন ধরে আমরা তো দেখছি তাদের ঘরে তালা ঝুলছে। মনে করলাম, হয়তো তারা কোথাও বেড়াতে গিয়েছে। তারাও তাই মনে করে ফিরে যেতো।

সকলের কানাকানিতে গৌরিসেনের পরিবারের এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে গেলো। তাদের পরিবারের কাউকে আর কোনোদিন দেখা যায়নি। — সমাপ্ত–