ব্যথা : ক্ষুদীরাম দাস

এক.
মনের আঘাত থাকে দীর্ঘদিন। সেই আঘাতের ব্যথা থেকে উদ্ধার পাওয়াটা কঠিন বিষয়। কাউকে ভালোবেসে যদি তারই কাছ থেকে আঘাতটা পাওয়া হয়, তখন সেই আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাটা কঠিন বিষয়। চন্দ্রলতার জীবনেও তাই ঘটেছিলো। ছোট বেলা থেকে কাকার বাসায় থাকতে হয়েছে। একেবারে যখন সে ছোট ছিলো তখনই তার বাবা মারা যায়। এই দুঃখটা সে কোনোদিনই ভুলতে পারে না। কেননা তার বাবা তাকে খুবই ভালোবাসতো। এখানে সেখানে ঘুরতে নিয়ে যেতো। একবার কোলো নিতো, আরেকবার কাঁধে চড়িয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে চলে যেতো। চন্দ্রলতার স্পষ্ট মনে আছে বাবার কথা। এখন বড় হয়ে গেলেও বাবাকে সে একেবারে ভুলতেই পারে না।
বাবার মৃত্যুর পর চন্দ্রলতার মায়ের দুঃখের সীমা ছিলো না। কিন্তু মায়ের মনে কেনো দুঃখটা ছিলো চন্দ্রলতা সত্যটা মোটেও জানতো না। সে মনে করতো বাবার জন্যেই তার মায়ের এতো দুঃখ। এদিকে যে মায়ের সাথে অন্য একজনের সম্পর্ক ছিলো, সেটা চন্দ্রলতার মোটেও বুঝতে পারেনি। আসলে বুঝতে পারাটা এতটুকুন মেয়েটার বোধে ছিলো না। সেই দুষ্ট লোকটা তাদের বাড়িতে আসতো, আর চন্দ্রলতাকে কোলে নিয়ে চকলেট, চিপস দিতো। এদিকে মায়ের মনকে ভুলিয়ে ছিলো। ইশারা ইঙ্গিতে কী বলাবলি করতো সেটা চন্দ্রলতা মোটেও বুঝতো না।
চন্দ্রলতাকে তার কাকা কোলে নিয়ে তার মায়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতো। তখন সে বলে দিতো আধো আধো বুলিতে, ‘আমাগো গলে একতা বেতা আসে, মার সাটে কটো কটা বলে, আর আমারে চকেট দিতো।’ এতে চন্দ্রলতার কাকা ক্ষ্যাপে যেতো। একদিন চন্দ্রলতার কাকা আচ্ছামতো লোকটা বকে দিয়েছিলো। এতে চন্দ্রলতার মা উল্টো তার সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। চন্দ্রলতার কাকা পরিস্কার বুঝতে পারে এখানে নীতিকথায় কোনো কাজ হবে না। সুতরাং নিজের সম্মান নিজেই রক্ষা করাটা শ্রেয় মনে করায়, চন্দ্রলতাকে একটু দূরে দূরে নিজেদের কাছেই রেখে দিতো। অবশ্য এটা চন্দ্রলতার মাও বেশ পছন্দ করতো। সে এটাই চাইতে চন্দ্রলতা যেন তাদের কাছ থেকে একটু দূরে দূরে থাকে।
গুরুজনদের মাধ্যমে চন্দ্রলতার মাকে অনেক বোঝানো হয়েছে, কিন্তু কোনোভাবেই তাকে সঠিক পথে আনা যায়নি। গুরুজনদের কথাও তার ভালো লাগতো না। কেননা চন্দ্রলতার মা ছিলো শিক্ষিত পরিবারের শিক্ষিত মহিলা। তাই তাকে কোনো বিষয়ে বোঝাতে গেলে উল্টো বুঝিয়ে দিতো। সুতরাং এমন যুক্তিবাদী মহিলার কাছে কেউ ঘেঁষতে চাইতো না। কিন্তু এমন শিক্ষিত মহিলার জঘন্য কার্যক্রম কেউ পছন্দ না করলেও নিজে কেনো এসব বুঝতো না, সেটাই মানুষের চিন্তার বিষয় ছিলো। অবশ্য গুরুজনরা তার মা-বাবাকেই বেশি বেশি গালাগালি দিতো। বলতো, এই মহিলাকে তার মা-বাবা কিছুই শিক্ষা দেয়নি। ভদ্রতা একটু শেখায়নি। গুরুজনকে কিভাবে সম্মান করতে হয় সেটা তাদের শিক্ষায় নেই। তাই কাউকে পরোয়া করে না। অতিরিক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেকে ভুলে ঊর্ধ্বে মনে করে-ইত্যাদি।’
তবুও চন্দ্রলতার মা বলে কথা। অন্তত বাবা না থাকলেও মায়ের আদর সে পাচ্ছে একটু হলেও সেটাই সবচেয়ে বড় বিষয়। কিন্তু এই সুখটাও বেশিদিন টিকলো না চন্দ্রলতার। হঠাৎই একদিন উধাও হয়ে গেলো চন্দ্রলতার মা।
বেশ কয়েকদিন চন্দ্রলতা তার মায়ের জন্যে কেঁদেছিলো। মাঝে মাঝে অভিমান করেছিলো চন্দ্রলতার তার মায়ের উপর। বলতো, মা আসলে ইচ্ছামতো বকে দেবে। কেনো তাকে ফেলে চলে গেছে। এসব কথা শুনলে আশপাশের মানুষজন খুব কষ্ট পেতো। কিন্তু চন্দ্রলতা এটা বুঝতো না যে, তার মা আর কোনোদিন তার কাছে আসবে না।
পাড়ার গুরুজনরা হাহুতাশ করে বলতো, আহা রে, এমন অবুঝ মেয়েটাকে ফেলে কেনো যে চলে গেলো অসভ্য মহিলাটা। একজন শিক্ষিত মহিলা হয়ে এভাবে কেনো করলো। মেয়েটার কথা কি একবারও চিন্তা করলো না? এমন অমানুষ হতে পারলো? একজন মা কীভাবে পারলো এমন আচরণ করতে? মা নামের কলঙ্ক! এমন মায়ের শাস্তি কী হবে কে জানে। এসব কথা গুরুজনদের মুখে মুখে।
চন্দ্রলতা বড় হতে লাগলো, নিজেই বুঝতে পারলো তার মা আর কোনোদিন আসবে না। মনের ব্যথা বাড়তেই লাগলো। সমবয়সীরা কেউ কেউ টিটকারীও করতো মাকে নিয়ে বাবাকে নিয়ে। কিন্তু ওরা এটা বুঝতে চাইতো না যে, এতে মেয়েটির কোনো দোষ নেই। এই বোধ তাদের মনের মধ্যে কাজ করতো না। এতে চারিদিকের মানুষগুলোকে অসহ্য লাগতো তার কাছে। একদিকে বাবা নেই, অন্যদিকে মাও চলে গেছে। অপরদিকে কাকার ঘরে থাকলেও নিজের মা-বাবার মতো তো আর তারা ভালোবাসতো না। আবার কাকাতো ভাই বোনরাও আপন করে নিতে পারলো না চন্দ্রলতাকে। তবুও মনের মধ্যে একটা ব্যথা লুকিয়ে রেখে অন্য কোথাও যাওয়ার পথ না থাকায় সবই সহ্য করতো। আর সহ্য করাটা তার মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিলো।
চন্দ্রলতা বাড়ির সব কাজই করতে পারতো। তবুও নিজের কাকীকে খুশি করাতে পারতো না। এটা চন্দ্রলতার কাছে খুবই খারাপ লাগতো। মাঝে মাঝে চিন্তা করতো, এই মহিলা এতো খারাপ কেনো? নাকি নিজেরই অযোগ্যতা যে, তাদেরকে কাজ করে খুশি করাতে পারে না। আবার মাঝে মাঝে তার কাছে খারাপ লাগতো, নিজের মেয়েদের দিয়ে কোনো কাজই করায় না, অথচ তাকে দিয়ে বাড়ির সবই করায়।
চন্দ্রলতা ছিলো রূপে গুণে ভরপুর। তাছাড়া সংসারের কাজেও কোনো অংশে কম নয়।
একদিন চন্দ্রলতার কাকাতো বোনকে বিয়ের জন্যে দেখতে এসেছিলো। কিন্তু তাকে বরপক্ষ পছন্দ করেনি। পছন্দ করেছে চন্দ্রলতাকে। এটাতেই কাকীর ভীষণ আপত্তি ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়ে গেলো। চন্দ্রলতার প্রতি আরো ক্রোধ বেড়ে গেলো। এদিকে কাকা বিষয়টি লক্ষ্য করতে পেরে মাত্র একসপ্তাহের মধ্যে চন্দ্রলতাকে বিদায় করে দিলো বিয়ের দেয়ার মাধ্যমে।
বিয়ের পর চলে গেলো চন্দ্রলতা চিরদিনের জন্যে এই বাড়ি ছেড়ে। চন্দ্রলতা আর কোনোদিন কাকা-কাকীর বাড়িতে আসতো চাইতো না। এদিকে কাকাও চাইতো না যেন মেয়েটা আর তাদের বাড়িতে আসুক। কেননা চন্দ্রলতা স্বামীর বাড়িতেই বেশ ভালো আছে।
একদিন চন্দ্রলতার স্বামী জিজ্ঞাসা করেছিলো, কেনো সে আর তাদের বাড়িতে যেতে চায় না। সে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতেই চাইতো না। অবশ্য এ নিয়ে চন্দ্রলতার স্বামীও তেমন বাড়াবাড়ি করতো না।

দুই.
চন্দ্রলতা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ্একজন ভদ্র মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মহিলা বেশ বয়স্কা। মাথার চুল কিছুটা পেকে গেছে। একজন শিক্ষিতা মহিলা। অপরিচিত চন্দ্রলতার কাছে। কোনোদিন দেখেছে বলে মনেও হয় না। তবুও পেছন থেকে নাম ধরে ডাক দেয়া বেশ চমকে গেছে চন্দ্রলতা। হয়তো মহিলা চন্দ্রলতাকে ভালোভাবে চেনে; কিন্তু চন্দ্রলতা মহিলাকে চেনে না। তাই মনের বিশ^াসে থমকে দাঁড়ায় চন্দ্রলতা।
চন্দ্রলতা ঃ আপনি আমাকে ডেকেছেন?
নিহারীকা ঃ হ্যাঁ!
চন্দ্রলতা ঃ বলুন!
নিহারীকা ঃ আমি নিহারীকা। তোমাদের বাড়ির তিনটা বাড়ির পরে আমি থাকছি।
চন্দ্রলতা ঃ কিন্তু আপনি আমাকে চেনেন কীভাবে?
নিহারীকা ঃ আমি তোমাকে খুব ভালোভাবেই চিনি।
চন্দ্রলতা ঃ কীভাবে?
নিহারীকা ঃ না মানে, এই পথ দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করি, তাই তোমাকে আমি প্রায়ই আমি দেখতে পাই। তোমাকে আমার ভালো লাগে।
চন্দ্রলতা ঃ হুম!
নিহারীকা ঃ তোমাকে আমার ভালো লাগে। তাই তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই। তোমার চলাফেরা আমার খুবই পছন্দ হয়। তা তুমি এখানে কবে এসেছো?
চন্দ্রলতা ঃ আমি নতুন এসেছি এখানে। আমার বিয়ে হয়েছে মাত্র এগারো মাস হলো।
নিহারীকা ঃ সেটা আমি জানি।
চন্দ্রলতা ঃ ও আচ্ছা! আমার স্বামী–
নিহারীকা ঃ থাক, সেটাও বলতে হবে না। তোমার স্বামীকেও আমি খুব ভালো করেই চিনি।
চন্দ্রলতা ঃ হতে পারে। কারণ, আপনাদেরই পাড়াতে রয়েছে, আপনি তো চিনবেনই।
নিহারীকা ঃ তুমি কি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছো নাকি?
চন্দ্রলতা ঃ না, না, না। এটা কী বলছেন? আমি মোটেও বিরক্ত হচ্ছি না।
নিহারীকা ঃ তোমার জীবনে অনেক ব্যথা তাই না!
চন্দ্রলতা ঃ আপনি এসব কথা আমাকে বলছেন কেনো?
নিহারীকা ঃ তোমার বিষয়ে আমি সবই জানি।
চন্দ্রলতা ঃ আমার স্বামী বলেছে বুঝি?
নিহারীকা ঃ সে আমাকে কিছুই বলেনি।
চন্দ্রলতা ঃ তাহলে?
নিহারীকা ঃ তোমার মা বাবা সম্পর্কে কিছু মনে আছে তোমার?
চন্দ্রলতা ঃ কী আশ্চর্য! আপনি আমার সম্পর্কে সবকিছু জেনেই বুঝি এমন প্রশ্ন করছেন?
নিহারীকা ঃ অবশ্য সে রকম কিছুই না। আমি একটু জানতে চাইছি।
চন্দ্রলতা ঃ বুঝতে পেরেছি কেনো আপনি এসব বলছেন?
নিহারীকা ঃ কী বুঝতে পেরেছো?
চন্দ্রলতা ঃ আমি আমার বাবার বাড়িতে যাই না, সেজন্যে এসব কথা বলছেন?
নিহারীকা ঃ তুমি কি আমার কথায় রেগে যাচ্ছো নাকি? যদি সে রকম কিছুই হয় তাহলে বলতে হবে না?
চন্দ্রলতা ঃ আমি রেগে যাচ্ছি না। তবে আপনার কথায় অবাক হচ্ছি।
নিহারীকা ঃ আমি এমনিতেই জিজ্ঞাসা করছিলাম!
চন্দ্রলতা ঃ আমার বাবা ছোট বেলাতেই মারা গেলেন। আর মা বড় স্বার্থপর। আমাকে ফেলে চলে যায়।
নিহারীকা ঃ বড়ই স্বার্থপর। বড়ই স্বার্থপর। এমন মায়েরা কলঙ্কিত! ঘৃণিত!
চন্দ্রলতা ঃ থাক, আমি আমার মা সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চাই না। মনে বড় ব্যথা লাগে। ভালো লাগে না তার কথা মুখে বলতে।
নিহারীকা ঃ এটা তো স্বাভাবিক। এমন স্বার্থপর মায়েরা তো কোনোদিন ভালো থাকতে পারে না। ঐ দেখ তোমার স্বামী চলে এসেছে। এখন তাহলে তুমি যাও। অন্যদিন কথা বলবো।
চন্দ্রলতা তার স্বামীর সাথে বাড়িতে চলে আসে। চন্দ্রলতা মনের মধ্যে খুৎ খুৎ করতে থাকে মহিলার কথাবার্তায়। ঐ মহিলাকে মোটেও ভুলতে পারে না। শুধু মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, কীভাবে সেই মহিলা চন্দ্রলতাকে চিনতে পারলো। তার সম্পর্কে এতকিছু জানেই বা কীভাবে-এটা ভেবে সে খুব আশ্চর্য হয়!
ঠিক একসপ্তাহ পর একদিন চন্দ্রলতা বারান্দায় পায়চারি করতে থাকে। এমন সময় দূরে রাস্তার উপর বেশ কিছু মানুষের চেঁচামেচি শুনতে পায়। চন্দ্রলতা তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। চন্দ্রলতার স্বামী ছুটে চলে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর কাছে। সাথে চন্দ্রলতাও আর থাকতে পারলো না। সেও তার সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায়। চন্দ্রলতা দেখে সেই মহিলাটি ট্রাকের চাপায় মরে গেছে। তার মাথা থেঁতলে গেছে। তার মনটা কেঁদে উঠে। চন্দ্রলতার স্বামী বলে ঃ চন্দ্রলতা, আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে পারলাম না। এটা আমার বড় ব্যথা।
চন্দ্রলতা অবাক হয়ে যায়। চন্দ্রলতার স্বামী বললো ঃ এই মহিলাটি তোমারই মা!
চন্দ্রলতা যেন আকাশ থেকে পড়লো। কিছুই তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছিলো না। ইচ্ছা করছিলো ছুটে পালিয়ে যেতে। ঘৃণা আর ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছিলো চন্দ্রলতা। যে মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে তার সাথেই বুঝি একদিন অপরিচিতি মহিলা হিসেবে কথা বলেছিলো! ভাবতে ভাবতে চন্দ্রলতার ব্যথার গভীরতা আরো বেড়ে যায়।
সবাই মহিলাকে বাঁচানোর জন্যে হুড়োহুড়ি করছিলো। এদিকে চন্দ্রলতা অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। চন্দ্রলতার স্বামী চন্দ্রলতাকে একটি রিক্সায় তুলে বাড়িতে নিয়ে আসে।